সিরিয়ার কৌশল নিয়ে ইউক্রেন যুদ্ধে কতটা সফল হবেন পুতিন

ভ্লাদিমির পুতিন

রাশিয়া ২০১৫ সালে সিরিয়ায় সামরিক অভিযান চালানোর পর সেখানে যে নৃশংসতা দেখা গিয়েছিল, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের জন্য যুদ্ধ থেকে দূরে থাকার একটি তাৎপর্যপূর্ণ শিক্ষা ছিল। জাতিসংঘের একাধিক কমিশন এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক সংস্থাগুলো সে সময় ছবি, ভিডিও চিত্র ও প্রত্যক্ষদর্শীর জবানবন্দি দিয়ে অকাট্যভাবে সেই সব নৃশংসতার রেকর্ড রেখেছে।

সিরিয়ার হাসপাতালগুলোতে বিমান হামলা চালানোর পর ধসে পড়া ভবনের ইট–সুরকির ভেতর থেকে রক্তাক্ত শিশুদের বের করার অগণিত দৃশ্য বিশ্ব দেখেছে। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সিরিয়ায় বেসামরিক মানুষের ওপর হত্যাযজ্ঞ চালানোর পর বিশ্ব সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা পুতিনকে প্রতিবেশী দেশ ইউক্রেনের ভূখণ্ডে আরেকটি নৃশংস হামলা চালানোর সবুজসংকেত দিয়েছে।

আরও পড়ুন

গত মার্চে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছিলেন, ‘সিরিয়ার সাধারণ মানুষ পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা পাননি এবং সেটিই ক্রেমলিন ও তাদের সহযোগীদের মধ্যে দায়মুক্তির বোধ জাগিয়েছে।’ তিনি বলেছিলেন, ‘যেভাবে রাশিয়া সিরিয়ার শহরগুলো বোমা ফেলে ধ্বংস করেছে, একইভাবে তারা এখন ইউক্রেনে বোমা ফেলছে। ক্রেমলিনের বর্তমান আগ্রাসী আচরণ এই দায়মুক্তির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে আছে।’

জেলেনস্কির কথা শতভাগ ঠিক। বেসামরিক মানুষ হত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) থেকে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা পাওয়া পুতিন সিরিয়ায় তাঁর অনুসরণ করা পুরোনো কৌশল ইউক্রেনে খাটাচ্ছেন। গত শরৎকাল থেকে আমরা ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার ধরনকে সিরিয়ানীকরণ করা হচ্ছে।

সিরিয়ায় নির্বিচার বোমা ফেলার জন্য কুখ্যাতি পাওয়া রুশ জেনারেল সের্গেই সুরোভিকিনকে গত অক্টোবরের শুরুতে ইউক্রেন অভিযানের নতুন অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করেছেন পুতিন। ৫৬ বছর বয়সী এই জেনারেল ২০১৯ সালে সিরিয়ার ইদলিব শহরে ক্লিনিক, হাসপাতালসহ বেসামরিক আবাসন পরিকাঠামোকে নিশানা করে লাগাতার বোমা হামলা চালিয়েছিলেন। সেই নির্বিচার হামলার কারণেই সিরিয়ার বাসিন্দারা প্রাণ বাঁচাতে তুরস্ক হয়ে ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

জেলেনস্কি এবং ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে ইউক্রেনের পরিস্থিতির কতটা মিল আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি তার বুঝমাফিক ব্যবস্থা নেবে?

এখন ইউক্রেনকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করতে সেই একই কায়দায় পুতিন ইউক্রেনের সাধারণ মানুষকে নিশানা করে হামলা চালাচ্ছেন। বাশার আল–আসাদ সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইরত সশস্ত্র গ্রুপগুলো যে এলাকাগুলো নিয়ন্ত্রণ করছিল, পুতিনের প্রচারণা যন্ত্রগুলো সেই এলাকার সব বাসিন্দাকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা দিয়েছিল। একইভাবে তারা এখন ইউক্রেনে তাদের দখলাভিযানকে নাৎসিমুক্ত করা অভিযান বলে দাবি করছে। রুশ বাহিনী যেভাবে সিরিয়ার আলেপ্পো, ঘৌতা ও হোমস শহরকে ঘিরে ফেলে সমানে বোমাবর্ষণ করছিল; সেই একই কায়দায় তারা ইউক্রেনের মারিউপোল অবরুদ্ধ করেছিল।

১২ বছর ধরে সিরিয়ার বেসামরিক মানুষের ওপর বাশার আল–আসাদের বাহিনীর ব্যারেল বোমা এবং রাশিয়ান ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালানো হচ্ছে। রাশিয়ার প্রতিরক্ষামন্ত্রী দম্ভভরে বলেছেন, তাঁরা সিরিয়ার মাটিতে ৩২০ পদের বেশি অস্ত্র ব্যবহার করেছেন এবং বিভিন্ন সূত্রের খবর অনুযায়ী, এই রুশ অভিযানে ৮৭ হাজার ৫০০ সিরীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন।

ইউক্রেনের স্বাস্থ্যমন্ত্রী সম্প্রতি আমার স্বাস্থ্যসেবা সংস্থা মেডগ্লোবালের সহায়তা চেয়েছেন। তিনি আমাদের জানিয়েছেন, রাশিয়া সিরিয়ায় যেভাবে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করেছে, একইভাবে তা ইউক্রেনেও করা হতে পারে। আমরা যেন সে ধরনের সংকট মোকাবিলার প্রস্তুতি নিয়ে রাখি, সেটি তিনি আমাদের বলে রেখেছেন। বাইডেন প্রশাসনও সে ধরনের একই হুঁশিয়ারি দিয়েছে।

আরও পড়ুন

রাশিয়া বলেছে, বেলারুশে শিগগিরই তারা পারমাণবিক অস্ত্র মোতায়েন করবে। এ অবস্থায় ইউক্রেনে এখন যা ঘটছে, তাকে যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে গণহত্যা হিসেবে ঘোষণা দেওয়া উচিত। রাশিয়া যে ইউক্রেনের লাখ লাখ নাগরিককে দেশের বাইরে তাড়িয়ে দিয়ে এবং ইউক্রেনীয় শিশুদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রেখে তাদের জাতিগত পরিচয় ও সংস্কৃতিকে শেষ করে দিতে চাইছে, এ বিষয়ে ভূরি ভূরি তথ্য–প্রমাণ আছে।

জেলেনস্কি এবং ইউক্রেনের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন, সিরিয়ায় ঘটে যাওয়া পরিস্থিতির সঙ্গে ইউক্রেনের পরিস্থিতির কতটা মিল আছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতারাও নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। কিন্তু বড় প্রশ্ন হলো, যুক্তরাষ্ট্র কি তার বুঝমাফিক ব্যবস্থা নেবে?

  • জাহের সাহলুল দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া মানবিক এনজিও মেডগ্লোবাল–এর প্রেসিডেন্ট

    আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ