কংগ্রেস কি পারবে নেহরু-গান্ধী প্রভাব বলয় থেকে বের হতে

ভারতীয় কংগ্রেস অতীতে নেতা নির্বাচনে উদারতা, যোগ্যতা ও সমন্বয়ের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেছবি : রয়টার্স

রাজনৈতিক দলের প্রধান পদে গণতান্ত্রিক প্রথা ও পদ্ধতি অনুসরণ করে নেতা নির্বাচন অনেক দেশের রাজনৈতিক দলব্যবস্থার একটি অপরিহার্য বাধ্যবাধকতা। সেই নেতা নির্বাচন সংসদীয় দল বা মূল দলের ব্যবস্থাপক ও দলীয়প্রধান উভয় ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সাম্প্রতিক কালে যুক্তরাজ্যের একজন প্রধানমন্ত্রীকে ‘অসত্য বিবৃতি ও অনৈতিক আচরণ’–এর অভিযোগ এনে নিজ দলীয় সংসদ সদস্যরা দলে অনাস্থা দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করেছেন। রাষ্ট্রের নির্বাহী আদেশে করোনাকালে সব জমায়েত বন্ধ থাকার পরও ১০নং ডাউনিং স্ট্রিটে তিনি ককটেল পার্টি করেও অসত্য তথ্য দিয়েছিলেন। উপমহাদেশ তথা আমাদের এ অঞ্চলের রাজনীতিতে এ–জাতীয় নৈতিকতা অনুসৃত হতে দেখা না গেলেও ভারতে দলে গণতন্ত্রচর্চার ঐতিহ্য পুরোপুরি তিরোহিত হয়নি। অনেক দিন পর ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ চলতি বছরের অক্টোবর মাসের ১৭ তারিখ সভাপতি পদের নির্বাচন করতে যাচ্ছে।

১৮৮৫ সাল থেকে হয়ে আসা ‘কংগ্রেস’ অধিবেশন ও সেসব অধিবেশনে নেতা নির্বাচনের যে প্রথা ও ঐতিহ্য, তাতে একটি ‘বিপ্লবী ব্যতিক্রম’ ঘটতে পারে। কমবেশি ১৩৭ বছরের মধ্যে সোনিয়া গান্ধী ৯৭তম কংগ্রেস সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে নেহরু-গান্ধী পরিবারের বাইরে থেকে সভাপতি নির্বাচনের ব্যবস্থা নিয়েছেন। সারা দেশের প্রদেশ কংগ্রেস ও কেন্দ্রের ৯ হাজার নির্বাচকমণ্ডলীর সদস্য এ ভোটে অংশ নেবেন। রাজীব গান্ধী খুন হওয়ার পর সোনিয়া গান্ধী ১৯ বছর সভাপতি থাকার পর ২০১৭ সালে সে পদ রাহুল গান্ধীর হাতে যায়। সুদীর্ঘ চুয়ান্ন বছর এককভাবে সাতবার এবং আরও তিনবার জোটবদ্ধভাবে কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় থাকা এই দল গত দুই দশকে মারাত্মক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। একদিকে সর্বভারতীয় পর্যায়ে বিজেপি, অপর দিকে আঞ্চলিক দলগুলোর দাপটে কংগ্রেস একরকম দিশেহারা।

এ মাসে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে কি কংগ্রেসের নেতৃত্ব নেহরু-গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) প্রভাব বলয়ের বাইরে যাওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তা আবারও পুরোনো বৃত্তে আবর্তিত হবে? এখানে শশী থারুরের অবস্থা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ৬৫ বছর আগের নেতাজি সুভাষ বসুর মতো। অক্টোবরে ২০ তারিখের পর ফলাফল জানা যাবে। নতুন নেতৃত্বের জন্য কায়েমি কংগ্রেস কতটুকু ছাড় দেবে এবং ক্ষয়িষ্ণু দলটি কতটুকু নবজীবন লাভ করবে– তার ওপর ২০২৪–এর জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করবে।

২০১৪ সালে লোকসভার ৫৪৩ আসনের মধ্যে কংগ্রেসের আসন ৪৮–এ নেমে আসে। ২০১৪ থেকে ২০২১ পর্যন্ত সময়ে কংগ্রেসের বিধানসভা, লোকসভা ও রাজ্যসভার ১৭৭ সদস্য দলত্যাগী হন। এতে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছেন বর্ষীয়ান নেতা গোলাম নবী আজাদ। এ অবস্থায় আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে দল পুনর্গঠন অপরিহার্য হয়ে ওঠে এবং অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও রাহুল গান্ধী সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করার স্থির সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেন। সোনিয়া গান্ধীও কায়েমি নেতৃত্বের পক্ষ থেকে কাউকে সমর্থন বা কারও বিরোধিতা করবেন না বলে জানিয়ে দেন। এখন কেরালার লোকসভা সদস্য শশী থারুর ও কর্ণাটক থেকে একনাগাড়ে ১০ বারের বিধানসভা, লোকসভা ও রাজ্যসভার নির্বাচিত সদস্য ও মন্ত্রী মল্লিকার্জুন খাড়গে কংগ্রেস সভাপতি পদে লড়ছেন। শশী থারুর আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিক, লেখক, গবেষক ও বক্তা। তিনি জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন এবং বান কি মুনের সময় সেক্রেটারি জেনারেল পদের প্রার্থী হন। সুবক্তা হিসেবে বিশ্বখ্যাত শশী থারুরের ২০১৭ সালের অক্সফোর্ড ইউনিয়নের ভাষণটি ৮১ লাখ মানুষ নেটের মাধ্যমে দেখেছেন। অন্যদিকে মল্লিকার্জুন খাড়গে গান্ধী বলয়ের প্রার্থী বলে ধারণা করা হচ্ছে। তিনি বর্তমানে রাজ্যসভার কংগ্রেস দলের নেতা, প্রবীণ ও পরীক্ষিত রাজনীতিবিদ। শশীর জন্ম ১৯৫৬ সালে, আর খারগে ১৯৪২–এ। বয়স ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফারাক বিস্তর। কিন্তু শশী আধুনিক, মননশীল, উচ্চশিক্ষিত ও কম বয়সীদের মধ্যে দারুণ জনপ্রিয়।

ভারতীয় কংগ্রেস অতীতে নেতা নির্বাচনে উদারতা, যোগ্যতা ও সমন্বয়ের সমৃদ্ধ ঐতিহ্য অনুসরণ করেছে। ধর্মীয় দিক থেকে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্শি, ভারতীয়, অ–ভারতীয় অনেকেই কংগ্রেস সভাপতির পদ অলংকৃত করেছেন। এ্যানি ব্যাসান্ত ও সরোজিনি নাইডুর মতো নারী এবং রহিমুল্লা সায়ান, ছৈয়দ হাসান ইমাম, বদরুদ্দিন ত্যায়াবজী, হাকিম আজমল খান, মোহাম্মদ আলী জোহার, মুখতার আহমদ আনসারী, মৌলানা আবুল কালাম আজাদের মতো প্রমুখ মুসলমান নেতা সফল কংগ্রেস সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৮৮৫ থেকে ১৯০০, ১৯০১ থেকে ১৯৪৭, ১৯৪৮ থেকে ১৯৮৪ এবং ১৯৮৫ থেকে ২০২২ পর্যন্ত এ চার অধ্যায়ে নেতৃত্ব নির্বাচনকে বিশ্লেষণ করলে চমকপ্রদ না হলেও বিস্মিত হওয়ার মতো কিছু প্রবণতা দেখা যায়।

১৮৮৫ থেকে ১৯২০ পর্যন্ত যে উদারনৈতিক ধারা পরবর্তী সময়ে কিছুটা রক্ষণশীলতা ও কায়েমি কর্তৃত্ববাদিতায় আক্রান্ত হয়। এর পেছনে মোহনদাস করমচাঁদ  গান্ধীর অদৃশ্য হাত থাকত। গান্ধী কোনো র‌্যাডিক্যাল মত সহ্য করতেন না। ১৮৮৫ থেকে ১৯৪০ পর্যন্ত সভাপতি পদের কার্যকাল ছিল মোটামুটি এক বছর বা কোনো ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে কিছু বেশি। ১৯২৪ সালে গান্ধীজি একবার সম্ভবত আনুষ্ঠানিকভাবে কংগ্রেস সভাপতির পদ গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৯২০ থেকে ১৯৪৭ পর্যন্ত সময়ে তাঁর মতের বাইরে কেউ এ পদের উপযুক্ত বিবেচিত হতেন না। ১৯৩৭–এ সুভাষ বসু গান্ধীর প্রার্থী সিতারামাইকে পরাজিত করে কংগ্রেস সভাপতি নির্বাচিত হন।

আরও পড়ুন

গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত হয়েও সুভাষ সভাপতির প্রথমত দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। তাঁর অমতে ওয়ার্কিং কমিটির অন্যান্য সদস্য নিয়োগ পেয়ে যান এবং সিতারামাইয়ার পরাজয়কে ‘মহাত্মা’ নিজের ব্যক্তিগত পরাজয় বলে ঘোষণা দেন। তাতে ভদ্র, শিষ্টাচারসম্পন্ন, সংস্কৃতিমান ও ব্যক্তিত্বশালী সুজন সুভাষ বিব্রত হন। তিনি বলেন, ‘বাপু’র পরাজয় আমি চাইনি এবং তা মেনে নেওয়া যায় না। তিনি পদত্যাগ করেন। তার পরের ইতিহাস অন্য রকম। নেতাজি সুভাষের অন্তর্ধান, আজাদ হিন্দ ফৌজ গঠন ও মিত্রশক্তির বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধে নেতৃত্বদান উপমহাদেশের ইতিহাসের অন্য একটি অধ্যায়। এখানে গান্ধী-নেহরু বলয়ের একটি আশ্চর্যজনক নীরবতা।

১৯৪০-১৯৪৬ মৌলানা আবুল কালাম আজাদ ছিলেন কংগ্রেস সভাপতি। কিন্তু ১৯৪৭–এর স্বাধীনতার সময়ের কৃতিত্বটি তাঁকে দেওয়া গেল না। নেহরু সভাপতির পদটি কৌশলে নিয়ে নিলেন। গান্ধীর অবর্তমানে পুরো নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব ১৯৬২ পর্যন্ত নেহরুর করতলগত থাকে। যদিও শেষ সময়ে কামরাজ ছিলেন সভাপতি। কামরাজই মোরাজী দেশাইকে বাদ দিয়ে অপেক্ষাকৃত দুর্বল লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগে মুখ্য ভূমিকা রাখেন এবং শাস্ত্রী–পরবর্তী সময়ে ইন্দিরা গান্ধীকে সামনে নিয়ে আসা হয়। মিসেস গান্ধী প্রধানমন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর সরকারে এবং দলে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হন। এই একই ধারায় ২০২১ পর্যন্ত নেহরু-গান্ধী পরিবার কংগ্রেস এবং সরকার প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করে আসে।

এ মাসে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, তাতে কি কংগ্রেসের নেতৃত্ব নেহরু-গান্ধী (ইন্দিরা গান্ধী) প্রভাব বলয়ের বাইরে যাওয়ার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে, নাকি তা আবারও পুরোনো বৃত্তে আবর্তিত হবে? এখানে শশী থারুরের অবস্থা পুরোপুরি না হলেও কিছুটা ৬৫ বছর আগের নেতাজি সুভাষ বসুর মতো। অক্টোবরে ২০ তারিখের পর ফলাফল জানা যাবে। নতুন নেতৃত্বের জন্য কায়েমি কংগ্রেস কতটুকু ছাড় দেবে এবং ক্ষয়িষ্ণু দলটি কতটুকু নবজীবন লাভ করবে– তার ওপর ২০২৪–এর জাতীয় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভাগ্য অনেকটাই নির্ভর করবে।

  • ড. তোফায়েল আহমেদ শাসনবিশেষজ্ঞ ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
    E-mail:[email protected]