সাংবাদিকতাকে ভয় দেখাচ্ছে প্রেস কাউন্সিল

কে বলে আওয়ামী লীগ সরকার ও বিএনপি সরকারের মধ্যে মিল নেই। রাজনীতির মঞ্চে যত ঝগড়াঝাঁটি থাকুক না কেন, সংবাদপত্র তথা গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বকারী আইনের ক্ষেত্রে তারা পরস্পরের পরিপূরক হয়ে কাজ করে আসছে।

১৯৭৪ সালে প্রবর্তিত বিশেষ ক্ষমতা আইনের বিরুদ্ধে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা ক্ষমতায় থাকতে মাঠ গরম করা বক্তৃতা দিয়েছেন; কিন্তু আইনটি বাতিল করেননি। এরশাদের পতনের পর বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ ক্ষমতা আইনের সংবাদপত্রসংক্রান্ত ধারাগুলো বাতিল করে দেন।

এটাই এখন পর্যন্ত সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের অন্যতম রক্ষাকবচ। এর পরে ও আগে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্বকারী অনেক আইন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো পেনাল কোড ১৮৬০ (ধারা ৪৯৯—মানহানি), ফৌজদারি কার্যবিধি ১৮৯৮ (ধারা ৯৯, ১০৮, ১৪৪) অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট (১৯২৩), প্রিন্টিং প্রেস অ্যান্ড প্রকাশনা আইন ১৯৭৩, প্রেস কাউন্সিল আইন ১৯৭৪, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন ২০০৬, আদালত অবমাননা আইন ২০১৩, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮, ডিজিটাল সোশ্যাল মিডিয়া ও ওটিটি প্ল্যাটফর্মের জন্য বাংলাদেশে টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) রেগুলেশন ২০২১।

বিএনপি সরকার যখন আইসিটি আইন করে, তখন আওয়ামী লীগ কঠোর ভাষায় এর সমালোচনা করেছিল। কিন্তু ক্ষমতায় এসে তারা আইনটি বাতিল না করে শাস্তির মেয়াদ আরও বাড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস করে স্বাধীন সাংবাদিকতার কফিনে শেষ পেরেকটি ঠুকে দেয়। এ আইনের বেশির ভাগ ধারা অজামিনযোগ্য। অতি সম্প্রতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় ২৯টি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে সংরক্ষিত পরিকাঠামো ঘোষণা করা হয়েছে। অনেক প্রতিষ্ঠানে আগে থেকেই সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহের ওপর কড়াকড়ি ছিল।

আজ আমরা যে আইন নিয়ে আলোচনা করব, সেটি হলো সম্প্রতি মন্ত্রিপরিষদে নীতিগত অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইন। এর খসড়াও প্রস্তুত হয় ২০০৫ সালে বিএনপি আমলে। স্বাধীনতা সমুন্নত রাখার পাশাপাশি সংবাদপত্র ও সাংবাদিকেরা দায়িত্বশীল সাংবাদিকতা করেন কি না, সেসব দেখভাল করার জন্য ১৯৭৪ সালে আওয়ামী লীগ সরকার বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল গঠন করেছিল।

প্রেস কাউন্সিলের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রেস কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্য এ আইন অনুমোদন করেছেন। অথচ সাংবাদিক ও সম্পাদকদের মধ্যে যাঁরা কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁদের কেউই  মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া খসড়া আইনটি দেখেননি। প্রেস কাউন্সিলের একজন সদস্য আমাকে জানিয়েছেন, ২০০৫ সালে বিএনপি আমলে প্রথম প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারপর দফায় দফায় বৈঠক হয়। কিন্তু আইন সংশোধনের নামে যা তৈরি হয়েছে, তাতে প্রেস কাউন্সিল একটি স্বৈরতান্ত্রিক ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

প্রেস কাউন্সিল আধা বিচারিক একটি প্রতিষ্ঠান। এর দায়িত্ব ও কর্তব্যের মধ্যে আছে সাংবাদিকতার নীতিমালা প্রণয়ন এবং তা লঙ্ঘিত হলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। এ ক্ষেত্রে প্রেস কাউন্সিল অভিযুক্ত সংবাদপত্রকে ভর্ৎসনার পাশাপাশি পুরো রায় ছাপতে বাধ্য করে থাকে। অনেক সংবাদপত্র ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত স্বার্থ উদ্ধারে ভিত্তিহীন, উদ্দেশ্যমূলক ও বিকৃত তথ্যও পরিবেশন করে থাকে। এই প্রেক্ষাপটে সাংবাদিকেরাই প্রেস কাউন্সিলকে শক্তিশালী করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু তাঁরা সাংবাদিক ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা খর্বকারী আইন চাননি। 

বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল আইনে আছে, ১ জন চেয়ারম্যান ও ১৬ জন সদস্য নিয়ে এটি গঠিত হবে। সুপ্রিম কোর্টের বর্তমান কিংবা সাবেক কোনো বিচারক এ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান হবেন এবং তিনি রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত হবেন। রাষ্ট্রপতি দ্বারা মনোনীত মানে সরকার দ্বারা মনোনীত। ভারতের প্রেস কাউন্সিল আইনে কিন্তু এককভাবে সরকারকে এই ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। লোকসভার স্পিকার, রাজ্যসভার চেয়ারম্যান ও প্রেস কাউন্সিলের একজন প্রতিনিধি মিলে চেয়ারম্যান বাছাই করবেন। সদস্যদের ক্ষেত্রে বলা হয়, পত্রিকার সম্পাদক, সাংবাদিক, মালিক বা সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্যদের মধ্য থেকে সদস্য হবেন।

বাংলাদেশে প্রেস কাউন্সিল আইন অনুযায়ী ১৬ সদস্যের মধ্যে স্পিকার মনোনীত দুজন সংসদ সদস্য, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক প্রতিনিধি, মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়ের একজন প্রতিনিধি, বার কাউন্সিল থেকে একজন প্রতিনিধি, বাংলা একাডেমি ও প্রেস ইনস্টিটিউট থেকে একজন করে প্রতিনিধি, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার তিনজন মালিক প্রতিনিধি, সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থার তিনজন সম্পাদক প্রতিনিধি এবং সাংবাদিকদের ইউনিয়ন বা সমিতি থেকে তিনজন প্রতিনিধি থাকবেন।

বাংলাদেশে সাংবাদিক ইউনিয়ন বিভক্ত, যার একটি আওয়ামী লীগ ও অপরটি বিএনপির সমর্থক হিসেবে পরিচিত। ফলে সরকার সমর্থক সাংবাদিক ইউনিয়নের সদস্য না হলে তঁারা প্রেস কাউন্সিলেও প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেন না।

প্রস্তাবিত প্রেস কাউন্সিল আইনের প্রধান আপত্তির বিষয় হলো, এর বিচারিক ক্ষমতা। এতে দোষী সাব্যস্ত সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা, সম্পাদক, প্রকাশক বা সাংবাদিককে কাউন্সিল ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করার বিধান এবং সেই জরিমানার টাকা তাৎক্ষণিকভাবে আদায় করার কথা বলা আছে। এর চেয়েও ভয়ংকর বিধান হলো, দোষী সাব্যস্ত সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থাকে সরকারি-বেসরকারি বিজ্ঞাপনসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা অনূর্ধ্ব ১ (এক) বছর পর্যন্ত স্থগিত করার আদেশ দিতে পারবে কাউন্সিল। এ ছাড়া দোষী সাব্যস্ত সাংবাদিকের অ্যাক্রেডিটেশন কার্ড বাতিল করার কথাও বলা আছে। 

ঙ উপধারায় বলা যায়, ১২ ধারায় প্রদত্ত আদেশ অমান্য বা প্রতিপাদন হয়নি মনে করলে সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থা বা সম্পাদক বা প্রকাশককে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবে কাউন্সিল। উপধারা (১) বা (২)-এর অধীনে প্রদত্ত কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত ক্ষেত্রমতে চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে এবং এ বিষয়ে কোনো আদালতে কোনো প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না। 

দেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান। যেকোনো আইন বা আদেশ সংবিধানপরিপন্থী হলে তার বিরুদ্ধে আইনি প্রতিকার চাওয়ার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। এ আইন দ্বারা প্রেস কাউন্সিল সাংবাদিকদের সেই অধিকারও কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনের ১৪ ধারায় আরও ভয়ংকর কথা আছে: সংবাদপত্র বা প্রিন্ট ও অনলাইন, সংবাদ সংস্থায়  রাষ্ট্রীয় ও জনস্বার্থ ক্ষুণ্ন হয় এমন সংবাদ বা প্রতিবেদন প্রকাশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বপ্রণোদিত হয়ে প্রেস কাউন্সিল-সংশ্লিষ্ট সংবাদপত্র, সংবাদ সংস্থা সম্পর্কে তদন্তকাজ পরিচালনা এবং সমন জারি ও প্রয়োজনে আদেশ দিতে পারবে। এর মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি পুলিশি দায়িত্ব হাতে নিতে চাইছে। প্রেস কাউন্সিলকে রাষ্ট্রীয় বা জনস্বার্থপরিপন্থী বিষয়ে বিচার করার এখতিয়ার দেওয়া হয়নি। তাদের কাজ  হলো সাংবাদিকতার নীতিমালা ভঙ্গ করেছে কি না, তা বিচার করা। প্রেস কাউন্সিল শক্তিশালী করার অর্থ একে সরকারের একটি আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা নয়।

 যুক্তরাজ্যের প্রেস কাউন্সিলের সঙ্গে সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই। সংবাদপত্রের অংশীজনেরা এটি করেছেন। আগে এর নাম ছিল প্রেস কমপ্লায়ান্টস কমিশন। পরে নাগরিকদের গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠলে এটি বিলুপ্ত করে দুটি সংগঠন করা হয়। ইমপ্রেস ও ইনডিপেনডেন্ট প্রেস স্ট্যান্ডার্ড অ্যসোসিয়েশন। সংবাদপত্র মালিকদের অর্থায়নেই এটি চলে। ভারতের প্রেস কাউন্সিলেরও অর্থায়ন করেন সংবাদপত্রের মালিকেরা। তবে সরকার বার্ষিক অনুদান দিয়ে থাকে। 

আরও পড়ুন

সরকার আইনের খসড়া ওয়েবসাইটে দেওয়ার কথা জানিয়েছেকিন্তু প্রেস কাউন্সিল আইনের চূড়ান্ত খসড়াটি সেখানে পাওয়া যায় না। তাহলে কি অংশীজনেরা যেসব প্রস্তাব ও সুপারিশ করেছেন, সেগুলো বাতিল করে আমলারা মনগড়া খসড়া চূড়ান্ত করে সংবাদপত্র ও সাংবাদিকদের ওপরে চাপিয়ে দিয়েছেন? এর আগে সম্প্রচার আইনের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটেছে। খসড়া ও চূড়ান্ত আইনের মধ্যে বিস্তর ফারাক ছিল।

প্রেস কাউন্সিলকে স্বশাসিত ও শক্তিশালী করতে হলে তথ্য মন্ত্রণালয় তথা সরকারের হস্তক্ষেপমুক্ত রাখতে হবে। ডেইলি স্টার পত্রিকায় সম্পাদক ও সংবাদপত্র পরিষদের সভাপতি মাহ্‌ফুজ আনাম প্রস্তাবিত আইন প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিল রক্ষক কি ভক্ষকে পরিণত হচ্ছেন?’ (২৬ আগস্ট ২০২২)

২০২২ সালের ২০ জুন মন্ত্রিপরিষদ সচিব সাংবাদিকদের ব্রিফিংয়ে যে খসড়ার কথা উল্লেখ করেছেন, সেটি কখনো অংশীজনদের দেখানো হয়নি বলে গুরুতর অভিযোগ আছে।

আরও পড়ুন

সম্পাদক পরিষদ প্রেস কাউন্সিলের কাছে মন্ত্রিপরিষদে বিবেচিত খসড়াটির অনুলিপি চেয়েও পায়নি। তাঁরা বলেছেন, কাউন্সিলের পাঠানো খসড়া বেশ কয়েকবার সংশোধন করা হয়েছে এবং তাঁদের কাছে সর্বশেষ খসড়াটি নেই। নেই মূল খসড়ার অনুলিপিও।

প্রেস কাউন্সিলের বর্তমান চেয়ারম্যান বিচারপতি মোহাম্মদ নাসিম বলেছেন, প্রেস কাউন্সিলের প্রত্যেক সদস্য এ আইন অনুমোদন করেছেন। অথচ সাংবাদিক ও সম্পাদকদের মধ্যে যাঁরা কাউন্সিলে প্রতিনিধিত্ব করেছেন, তাঁদের কেউই  মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে চূড়ান্ত হয়ে যাওয়া খসড়া আইনটি দেখেননি। প্রেস কাউন্সিলের একজন সদস্য আমাকে জানিয়েছেন, ২০০৫ সালে বিএনপি আমলে প্রথম প্রেস কাউন্সিল আইন সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয়। তারপর দফায় দফায় বৈঠক হয়। কিন্তু আইন সংশোধনের নামে যা তৈরি হয়েছে, তাতে প্রেস কাউন্সিল একটি স্বৈরতান্ত্রিক ও সরকারের আজ্ঞাবহ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হবে।

আইন তৈরির প্রক্রিয়ায় এ ধরনের অস্বচ্ছতা ও লুকোচুরি কেবল জনমনে প্রশ্ন তোলে না; এর উদ্দেশ্য সম্পর্কেও সন্দেহ তৈরি করে। মন্ত্রিপরিষদের প্রাথমিক অনুমোদন যাতে চূড়ান্ত অনুমোদন না পায়, সেই দাবিই সংবাদপত্রের অংশীজনদের।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

[email protected]