বিশ্লেষণ
বাশারমুক্ত সিরিয়ায় বিদেশি শক্তির পাশাখেলা
কীভাবে একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার সমৃদ্ধ কোনো দেশের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং সেই ঝুঁকিকে ব্যবহার করে আবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তি কীভাবে নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়, আজকের সিরিয়া তার এক পাঠকক্ষ। বাশারমুক্ত সিরিয়ায় বিদেশি শক্তির পাশাখেলা নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ
সিরিয়ায় আসাদ বংশকে ক্ষমতা থেকে সরানোর সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু ২০১১ সালে এবং সফল হয় ২০২৪–এর ডিসেম্বরে। চলতি ডিসেম্বরে বাশার আল–আসাদহীন সিরিয়ার এক বছর হলো। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ওঠে, বাথ পার্টিবিরোধী ‘বিপ্লবী’রা ক্ষমতায় এসে এক বছরে মানুষের জন্য কী করলেন, দেশটির কী অবস্থা?
বাশার এখন মস্কোতে
আসাদকে পালানোতে বাধ্য করে মুখ্যত হায়াত তাহরির আল-শামস (এইচটিএস)। এই নামের বাংলা অর্থ দাঁড়ায়, ‘সিরিয়ার মুক্তির জন্য গঠিত সংস্থা’। এটা ছিল হঠাৎ সৃষ্ট ধর্মীয়-রাজনৈতিক শক্তিগুলোর সশস্ত্র জোট। চূড়ান্ত যুদ্ধকালে তুরস্কের সহায়তাপুষ্ট সিরিয়ান ন্যাশনাল আর্মিও (এসএনএ) এইচটিএসের পাশে ছিল। এসএনএ গড়ে ওঠে বাশারের বাহিনী ছেড়ে আসা কয়েকজন সেনা কর্মকর্তার নেতৃত্বে। গৃহযুদ্ধের শুরুতে দেশটির বিভিন্ন দিকে অনেকগুলো সংগঠন বাশারবিরোধী যুদ্ধে নামে। ক্রমে তারা টেলিগ্রাম চ্যানেলকে ব্যবহার করে যত যূথবদ্ধ হয়েছে, তত প্রতিপক্ষকে কাবু করায় সফল হয়েছে।
সিরিয়ায় আসাদ বংশ ক্ষমতায় ছিল প্রায় ৫০ বছর। পরিবারের সর্বশেষ শাসক ক্ষমতাচ্যুত বাশার আল-আসাদ এখন মস্কোতে। ২০২৪ সালের ৮ ডিসেম্বর তিনি সেখানে পালান। বাশারের ক্ষমতাচ্যুতির ভেতর দিয়ে বিগত শতাব্দীর শেষ দিকে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বিকাশমান বাথ পার্টির শেষ দুর্গের পতন হয়।
বাশারের পর
বাশার আল-আসাদ ডিসেম্বরে পালিয়ে গেলেও আহমেদ আল-শারা দেশটির প্রেসিডেন্ট হন দু-তিন মাস পর। বাশারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের শুরুতে তিনি ছিলেন আল-কায়েদার সিরিয়া শাখা আল-নুসরা ফ্রন্টের নেতা। এইচটিএস ওই আল-নুসরার পরিবর্তিত এক ধরনের নাম।
শারার সরকার এ মুহূর্তে অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধানের আওতায় পরিচালিত হচ্ছে। আরও চার বছর এই সংবিধানের অধীনে দেশ চলবে। এত দিনকার বাশারবিরোধী সশস্ত্র গ্রুপগুলো নতুন সরকারের প্রতিরক্ষা বাহিনী হিসেবে একসঙ্গে কাজ করতে সম্মত হয়েছে।
নতুন সরকারের এক বছর পূর্তিকালে সবচেয়ে বড় চমক হলো, এইচটিএস বলছে, আইএস (ইসলামিক স্টেট) গেরিলাদের নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে সিরিয়া।
মানবাধিকার দলন উল্টো চেহারা নিয়েছে
বাশার বংশ দামেস্ক থেকে চলে গেছে—এটা প্রচারিত হওয়ামাত্র সিরিয়াজুড়ে ব্যাপক লুটপাট হয় বেশ কয়েক দিন। লুটের প্রধান শিকার হয় বাশারের সহযোগী, রাষ্ট্রীয় নানান প্রতিষ্ঠান এবং বিশেষভাবে সংখ্যালঘু আলাউইত ও দ্রুজ পরিবাগুলো। কোথাও কোথাও কবরস্থানগুলোও ভাঙচুর হয়। এ রকম একটা স্থান হলো বাশার আল-আসাদের বাবা হাফেজ আল-আসাদের কবর। হাফেজ আসাদ ও সাদ্দাম হোসেন ছিলেন আরব জাতীয়তাবাদী বাথ পার্টির দুই বড় চরিত্র। আট দশক আগে সিরিয়াতেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ওই রাজনৈতিক আন্দোলনের জন্ম হয়েছিল।
বাশার পরিবারের পলায়নমাত্র দেশটির অনেক মানবাধিকারকর্মী ওই আমলের অন্যায়-অবিচারের ডকুমেন্টেশন শুরু করেন, যাতে বিচারের দাবি তোলা যায়। তাঁদের সমস্যা হলো, আসাদদের পরে অন্যায়-অবিচারের ভিন্ন আরেক সুনামি বইছে সিরিয়াজুড়ে এবং এর শিকার মুখ্যত অ-সুন্নি জনগোষ্ঠী। আলাউইত ও দ্রুজদের বাইরে খ্রিষ্টানরাও নিয়মিত আক্রান্ত ও অপহৃত হচ্ছে। কেউ কেউ মারা পড়ছে। বড় অংশ পালাচ্ছে। তবে আল-শারার মন্ত্রিপরিষদে দ্রুজ, খ্রিষ্টান, কুর্দি ও আলাউইত সম্প্রদায়ের একজন করে সদস্য রাখা হয়েছে। মন্ত্রিসভার এই অন্তর্ভুক্তিমূলক চেহারা দেশ-বিদেশে প্রশংসিতও হয়েছে।
নতুন সরকারের এক বছর পূর্তিকালে সবচেয়ে বড় চমক হলো, এইচটিএস বলছে, আইএস (ইসলামিক স্টেট) গেরিলাদের নির্মূলে যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করবে সিরিয়া। শারা রীতিমতো ওয়াশিংটন সফরে গিয়ে এই অঙ্গীকার করে এসেছেন গত নভেম্বরে। একদিকে সাবেক আইএস সহযোগীরা ক্ষমতায়, আবার তারাই অন্য আইএসদের ধরপাকড়ে সহযোগিতা করতে চায়—এ রকম সবই একধরনের ধাঁধার মতো।
যুক্তরাষ্ট্রের তরফ থেকে নতুন সিরিয়ার কাছে আরেক নীরব চাওয়া, দামেস্ক যেন ক্রমে ইসরায়েলের বন্ধু হয়ে ওঠে। একে ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ই বলতে হবে; কারণ, বহুকাল ধরে সিরিয়া প্যালেস্টাইন গেরিলাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তাদের বড় কূটনৈতিক বন্ধু। এখন শারার কল্যাণে পুরোনো সিরিয়ার পুরোনো ইসরায়েল নীতি অনেকটা বদলে যাবে বলে মনে হচ্ছে।
ভূরাজনৈতিক পাশাখেলা
সিরিয়ায় আসাদের পতনের পর সবচেয়ে নাটকীয় পরিবর্তন দেখা গেল যুক্তরাষ্ট্রের নীতিতে। ১৩ বছর বিচ্ছিন্ন থাকার পর যুক্তরাষ্ট্র দারুণ উৎসাহের সঙ্গে ‘নতুন সিরিয়া’র সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়েছে। অথচ আজকের সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের রাজনৈতিক-সামরিক উত্থান সেই সংগঠনের সহযোগী হিসেবে, যারা যুক্তরাষ্ট্রে বিমান হামলার দায়ে অভিযুক্ত।
আল-শারা ও আল-নুসরা ফ্রন্ট ২০২৪ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কালোতালিকাভুক্ত থাকলেও এখন ওয়াশিংটনের শাসকেরা সিরিয়ার নতুন সরকারের বড় মিত্র। পূর্বের ‘সন্ত্রাসী’ মোহাম্মদ আল-জোলানিকেই এখন মার্কিন মিডিয়া ‘আল-শারা’ নামে ‘মডারেট লিডার’ বলছে! ট্রাম্প দেশটির ওপর থেকে এত দিনকার অর্থনৈতিক অবরোধও তুলে নিয়েছেন। এসব দেখে মধ্যপ্রাচ্যের অনেক রাজনৈতিক ভাষ্যকার বলছেন, যুক্তরাষ্ট্র শারার মাধ্যমে সিরিয়ার ‘বিপ্লব’ ছিনতাই করেছে।
সময়টা এখন তুরস্কের
বাশার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার কৃতিত্বের বড় অংশ বিদেশিদেরও প্রাপ্য। যুক্তরাষ্ট্র ও তুরস্ক এ বিষয়ে বড় দাবিদার। শেষ মুহূর্তের ঘটনাবলির প্রধান কৃতিত্ব যুক্তরাষ্ট্রের বদলে তুরস্কের প্রাপ্য। ইসরায়েলের মতো তুরস্কও চায় বাশার–উত্তর সিরিয়ার একাংশ তার প্রভাবে থাকুক। প্রায় ৯০০ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে সে চেষ্টাই করছে তারা, যে সীমান্তের দুই দিকে আছে কুর্দিরা। সিরিয়ায় আঙ্কারার প্রভাব বাড়ামাত্র কুর্দিরা এরদোয়ান সরকারের সঙ্গে আপস চুক্তির মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম বন্ধে রাজি হয়েছে।
নতুন সিরিয়া মধ্যপ্রাচ্যে কুর্দিদের জন্য কোণঠাসা এক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দিচ্ছে। সিরিয়াতেও কুর্দিদের সংগঠন এসডিএফ নতুন সরকারের সঙ্গে সমঝোতা চুক্তি করেছে। এ চুক্তির একটা অংশ হলো দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কুর্দিদের যে স্বঘোষিত স্বায়ত্তশাসিত এলাকা রয়েছে, তাকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে আনার বিষয়।
আল-শারা ও আল-নুসরা ফ্রন্ট ২০২৪ সালেও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে কালোতালিকাভুক্ত থাকলেও এখন ওয়াশিংটনের শাসকেরা সিরিয়ার নতুন সরকারের বড় মিত্র।
এটা একটা স্পর্শকাতর অধ্যায়, যার বাস্তবায়ন কীভাবে হয়, সেটা দেখার অপেক্ষায় আরও কিছুদিন থাকতে হবে। তুরস্ক তার দেশের কুর্দি তো বটেই, সিরিয়ার কুর্দিদেরও কোনো ধরনের স্বশাসনের বিপক্ষে। কুর্দিদের প্রশাসনিক ও নিরাপত্তাগত ভবিষ্যতরর প্রশ্নে তুরস্কের বিপরীত অবস্থানে আছে যুক্তরাষ্ট্র। শারার পক্ষে এই দুই শক্তির মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা সহজ হবে না।
সিরিয়ায় গৃহযুদ্ধ শুরুর পরপরই ২০-৩০ লাখ মানুষ তুরস্কের ভেতরে আশ্রয় নিয়েছে। এ ঘটনা এবং কুর্দিদের স্বায়ত্তশাসনের দাবি মোকাবিলার অজুহাতে তুরস্ক সিরিয়ার ভেতরে বেশ বড় একটা এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে রেখেছে। নতুন সরকারের আমলে সিরিয়ায় সফরকারী প্রথম বিদেশি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন তুরস্কের গোয়েন্দাপ্রধান ইব্রাহিম কালিন। বাস্তব কারণেই আহমেদ আল-শারাকেও প্রথম বিদেশ সফরে তুরস্কে যেতে হয়।
এর মধ্যেই ২০১২ সাল থেকে বন্ধ তুরস্ক দূতাবাস খুলেছে দামেস্কে। সিরিয়ার বাজারব্যবস্থায় তুরস্কের কোম্পানিগুলো ব্যাপকভাবে যুক্ত হবে বলে সবার ধারণা। আঙ্কারা শরণার্থীদেরও ফেরত পাঠাতে ইচ্ছুক। সিরিয়ায় এর প্রভাব থাকলে মিসর ও ইসরায়েলকে বাদ দিয়েই সন্নিহিত সাগরের খনিজ উত্তোলনের চেষ্টা চালাবে তারা। তবে তুরস্কের এ রকম সব পরিকল্পনার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে সিরিয়া নিয়ে ইসরায়েলের চাওয়ার ওপর।
ইসরায়েলের নির্বিঘ্ন উপস্থিতি
বাশারের সঙ্গে ইসরায়েলের বিবাদের মূলে ছিল সিরিয়ায় ইরানের উপস্থিতি। যেহেতু তেহরান হামাস ও হিজবুল্লাহকে অস্ত্র জোগাত, সে কারণে ইসরায়েল সিরিয়ার মাটিতে ইরানিদের দেখতে অনিচ্ছুক ছিল। গৃহযুদ্ধে ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থনে আসাদের বিজয় হতো ইসরায়েলের জন্য সম্ভাব্য ভূরাজনৈতিক বিপদ। এতে ইরান-ইরাক-সিরিয়া-লেবাননজুড়ে লম্বা এক সামরিক রুটে ইরানের সহজ চলাচল কায়েম হয়ে যেত।
সেই হিসাব থেকে ইসরায়েল শারাদের বিপ্লবী অভিযানের এক দূরবর্তী সহযোগী ছিল। গৃহযুদ্ধের মধ্যে তারা বারবার বাশারের সহযোগী ইরানের সামরিক স্থাপনা ও সরবরাহ লাইনে হামলা করে আগুয়ান গেরিলাদের জন্য বন্ধুসুলভ ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েল-তুরস্ক মিলে বাশারকে সরাতে ইতিহাসের ওই সময় বাছাই করেছে এ কারণেও যে ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়া এত বেশি যুক্ত হয়ে পড়েছিল, বাশারের সমর্থনে বাড়তি জনবল ও অস্ত্র নিয়ে এগিয়ে আসা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
ভূরাজনৈতিক পাশাখেলায় সিরিয়ার শারা ও তাঁর সহযোগীরা ধর্মীয় আবরণে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু দেশটিতে কথিত বিপ্লবের পর শান্তি আসবে কি?
সিরিয়ায় সশস্ত্র সুন্নি শক্তিকে ক্ষমতায় বসিয়ে সেখান থেকে শিয়া ইরানকে দূরে রাখাকে ইসরায়েল আপাতত বেশ সুবিধাজনক মনে করলেও নিজেদের তারা পুরো বিপদ–মুক্ত ভাবে না। সে জন্য গত এক বছর ইসরায়েলের বিমানগুলো সিরিয়াজুড়ে উন্নত অস্ত্রপাতির গুদামগুলো বেছে বেছে ধ্বংস করেছে। পাশাপাশি তুরস্কের মতো সীমান্ত–সংলগ্ন সিরিয়ার একাংশজুড়ে বিশাল এক ‘নিরাপদ অঞ্চল’ গড়ে তুলেছে। বাস্তবে এখন তুরস্ক ও ইসরায়েল সীমান্তে সিরিয়ার ভেতর ওই দুই দেশের দুটি বাফার জোন রয়েছে।
ইসরায়েল যেটা চাইছে, তা হলো সিরিয়া জাতিগত সংঘাতে কমবেশি ব্যর্থ রাষ্ট্র হয়ে থাকুক আর তুরস্ক সিরিয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকুক।
ইরান ও রাশিয়া এখন কী করবে
বাশারের পলায়নে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ইরান। সিরিয়ায় ইরানের বিপুল সামরিক বিনিয়োগ ছিল। গৃহযুদ্ধে যুক্ত হয়ে তারা বহু সামরিক প্রতিভাও হারিয়েছে।
ইরানের আহ্বানে ও প্রভাবে বাশারকে রক্ষায় লেবাননের অনেক হিজবুল্লাহ সৈনিকও এসেছিলেন। এ রকম সবাইকে সিরিয়া ছাড়তে হয়েছে দ্রুত। বাশারের পলায়নে মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের রাজনৈতিক-সামরিক প্রভাব কমে গেছে অনেকখানি। আশপাশে সব মৌসুমে ভরসা করার মতো বন্ধু নেই আর তাদের। সিরিয়ায় প্রভাব হারিয়ে হিজবুল্লাহকে সহায়তার সরবরাহ লাইনও বিপর্যস্ত। হামাসও অনেকখানি ধ্বংসপ্রাপ্ত। ফলে ইসরায়েলের সঙ্গে দীর্ঘদিনের ছদ্মযুদ্ধে তেহরান এখন প্রায় কোণঠাসা।
সিরিয়ার মাটিতে ক্রমে ইসরায়েলের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি মধ্যপ্রাচ্যে ভূরাজনৈতিক ভারসাম্য আমূল পাল্টে যাওয়ার পাশাপাশি ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের জন্যও মোটাদাগের এক বিপর্যয়। ধর্মীয়ভাবে বেশ র্যাডিক্যালদের শাসনকালেই এই পালাবদল ঘটছে।
ইরানের জন্য দূরবর্তী একটা আশার আলো হলো সিরিয়ায় ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এবং ফিলিস্তিনিদের পক্ষে নীরব জনমত আছে। এই দুই বিষয়ে ইরানের অবস্থানের প্রতি সিরিয়ার মানুষের সহানুভূতি আছে, যদিও বাশারের প্রতি ইরানি নীতি এই মানুষেরা সমর্থন করত না।
নতুন সিরিয়ায় ইরানের পাশাপাশি রাশিয়ার ভূমিকাও বেশ নগণ্য হয়ে গেছে। তবে সেটা ইরানের মতো বিপর্যয়কর নয়। রাশিয়া পুরোনো সিরিয়ার প্রধান অস্ত্র সরবরাহকারী ছিল। শারা সিরিয়ায় রুশদের উপস্থিতি পুরো সরাতে বলছেন না। হয়তো সেটা ইসরায়েলের দিক থেকে ভবিষ্যৎ বিপদের শঙ্কায়। ইতিমধ্যে মস্কো সফর করেছেন তিনি এবং এর পর থেকে সিরিয়ায় রুশদের পুরোনো তিনটি সেনা স্থাপনায় বেশ স্বাভাবিক পরিবেশ দেখা যাচ্ছে।
পুনর্গঠনের অপেক্ষায় অর্থনীতি
দীর্ঘ গৃহযুদ্ধের পর স্বাভাবিকভাবে সিরিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা চলছে। প্রান্তিক অঞ্চলগুলোতে অবকাঠামোর অর্ধেকই ধ্বংসপ্রাপ্ত। এগুলোর পুনর্নির্মাণ এবং ত্রাণের জন্য বিশেষজ্ঞদের হিসাবে প্রায় ৪০০ বিলিয়ন ডলার দরকার। তুরস্ক ও উপসাগরীয় দেশগুলো এ বিষয়ে সহায়তা করতে ইচ্ছুক। অনেক বিনিয়োগ ঢুকছেও দেশটিতে। তবে এসবের সুফল পেতে সামাজিক পূর্বশর্ত হিসেবে শান্তি দরকার। সমস্যা হলো, শারার সরকারের পক্ষে সেসব উগ্র গ্রুপকে সংখ্যালঘুবিরোধী সহিংসতা থেকে টেনে ধরা কঠিন, যারা বাশারবিরোধী যুদ্ধে মিত্র ছিল।
যুদ্ধকালে দক্ষিণের কুইনেত্রা ও দাররা প্রদেশের সীমান্ত এলাকায় ইসরায়েল ১০-১৫টি সশস্ত্র গ্রুপকে লালন-পালন করত। দামেস্কের কেন্দ্রীয় সরকার এদের নিয়ন্ত্রণে নিতে পারছে কি না, সেটা এখনো অনিশ্চিত।
আরেক সমস্যা ইসরায়েলের বোমাবর্ষণ। বাশার পালালেও গত ১২ মাসে ইসরায়েল বহুবার দেশটিতে হামলা চালিয়েছে। সিরিয়ার ভেতর বহু জায়গায় তাদের চেকপোস্ট। সন্দেহ হলে নানাজনকে ধরেও নিয়ে যাচ্ছে তারা। নতুন সরকার এসব বিষয়ে দায়সারা বিবৃতি দিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে।
সিরিয়া যা শেখাল
কীভাবে একটা কর্তৃত্ববাদী সরকার সমৃদ্ধ কোনো দেশের ভবিষ্যৎকে ঝুঁকিতে ফেলে এবং সেই ঝুঁকিকে ব্যবহার করে আবার আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তি কীভাবে নিজস্ব ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধার করে নেয়, আজকের সিরিয়া তার এক পাঠকক্ষ।
শারার সরকার যতই আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পক্ষকে সন্তুষ্ট করার চেষ্টা করুক, এটা রূঢ় বাস্তবতা যে দেশটির ভাগ্য নির্ধারক এখন তুরস্ক, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র। ভূরাজনৈতিক ওই পাশাখেলায় শারা ও তাঁর সহযোগীরা ধর্মীয় আবরণে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে কেবল। কিন্তু বিশ্বের মানুষের কৌতূহল একটাই, দেশটিতে কথিত বিপ্লবের পর শান্তি আসবে কি না?
বিলাদ আল–শাম মধ্যপ্রাচ্যের এমন এক জায়গা, যেখানে শান্তি না আসা পর্যন্ত পুরো অঞ্চলে শান্তি আসবে না। শাম অঞ্চলে ফ্যাসাদ সৃষ্টির ধর্মীয় ভবিষ্যদ্বাণীর কথাও মনে করিয়ে দেয় বর্তমান বাস্তবতা।
আলতাফ পারভেজ ইতিহাস বিষয়ে গবেষক
*মতামত লেখকের নিজস্ব
