এই লড়াইটা কেবল একটি চাকরি পাওয়ার জন্য নয়

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের সূচনা হয়েছিলফাইল ছবি

জুলাই-পরবর্তী নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে যুব কর্মসংস্থানের সংকট। সরকারের নানা সংস্কার ও প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন। দেশে ৩ কোটি ৮০ লাখ যুবশক্তির মধ্যে (যাঁদের বয়স ১৫ থেকে ২৯ বছরের মধ্যে) প্রায় ২৬ শতাংশ বেকার। ২০২৩ সালের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই তথ্য আমাদের জানিয়ে দেয়, একটি প্রজন্মের স্বপ্ন ও সম্ভাবনা কীভাবে থমকে আছে। শুধু তা–ই নয়, বিশ্বব্যাংকের মতে, দেশের যুবদের মধ্যে ৪৭ শতাংশের দক্ষতার ঘাটতি রয়েছে, যা চাকরি পাওয়ার পথে বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এই সংকট নিছক অর্থনৈতিক নয়; এর গভীরে রয়েছে আমাদের রাষ্ট্র ও সমাজের কাঠামোগত অসংগতি। বাংলাদেশে আজ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তাকে অর্থনীতিবিদেরা বলেন ক্রোনি পুঁজিবাদ—স্বজনপোষণমূলক পুঁজিবাদ। এ ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় সম্পদ, ব্যাংকঋণ, বাণিজ্যিক সুবিধা—সবই কুক্ষিগত থাকে কিছু গোষ্ঠী ও তাদের রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকদের হাতে। ফলে বৈষম্য শুধু বেড়েই চলেছে।

দেশের শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী জনগোষ্ঠী জাতীয় আয়ের ৪১ শতাংশ ভোগ করছেন, অথচ নিচের ১০ শতাংশ পান মাত্র ১ শতাংশ। ব্যাংক খাতের চিত্রও ভয়াবহ; বড় ঋণের ৫৭ শতাংশ যাচ্ছে মাত্র ২ শতাংশ প্রভাবশালী ঋণগ্রহীতার কাছে, যাঁদের অনেকে রাজনৈতিক প্রভাবে ঋণখেলাপি হয়ে যাচ্ছেন।

এই ক্রোনি পুঁজিবাদ উৎপাদনশীল বিনিয়োগ বা শিল্পায়নের পরিবর্তে তৈরি করছে রেন্ট-সিকিং বা অনুগ্রহনির্ভর আয়ের সংস্কৃতি। তৈরি পোশাক খাত ছাড়া অন্যান্য শিল্প খাতে যুব কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি যেখানে ৫ থেকে ৬ শতাংশ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে দাঁড়িয়েছে মাত্র ২ দশমিক ৩ শতাংশ। এরপরও ২০২৩ সালের ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের এক জরিপে দেখা যাচ্ছে, ৬৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, দেশে চাকরি পেতে যোগ্যতার চেয়ে পরিচিতি বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

আমাদের মেগা প্রকল্পগুলোর কথাই ধরা যাক—পদ্মা সেতু, মেট্রোরেল, বিদ্যুৎ খাতের নানা উদ্যোগ। এগুলোর অনেকের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অনিয়মের অভিযোগ, অকার্যকর ব্যয় ও দুর্নীতির অভিযোগ। অথচ এই বিপুল অর্থ যদি শিক্ষাক্ষেত্র, কারিগরি প্রশিক্ষণ, ডিজিটাল দক্ষতা বা যুব উদ্যোক্তা বিকাশে বিনিয়োগ হতো, তাহলে ছবিটা ভিন্ন হতে পারত।

আমাদের স্পষ্ট করে বুঝতে হবে, যুব কর্মসংস্থান সংকট এবং ক্রোনি পুঁজিবাদের মূল কারণ নিহিত আছে দেশের উৎপাদনের উপায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানার ভেতর

বাংলাদেশের এই কাঠামো বৈশ্বিক অর্থনীতির সঙ্গেও গভীরভাবে যুক্ত। বিশ্বমন্দা, মুদ্রাস্ফীতি, রপ্তানি আয়ে ধস, রেমিট্যান্সের অস্থিরতা—সব মিলিয়ে নতুন চাপ তৈরি করছে দেশের যুবশক্তির ওপর। ২০২৪ সালে বৈশ্বিক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে বলে আইএমএফ আশঙ্কা করছে, যা বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের জন্য বড় অশনিসংকেত।

এ অবস্থায় যুব সংগঠনগুলোকে কেবল অসন্তোষ জানিয়েই থেমে থাকলে হবে না; এখন তাদের দরকার বাস্তবসম্মত কর্মপরিকল্পনা ও বিকল্প গড়ার সাহস। যুব সংগঠনগুলোকে প্রথমত যুবদের দক্ষতা উন্নয়নে উদ্যোগ নিতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি, গ্রিন জবস, ফ্রিল্যান্সিং—এ ধরনের উদীয়মান খাতে প্রশিক্ষণ বিস্তারে কাজ করতে হবে। এটুআইয়ের এক জরিপ অনুযায়ী, দেশের ৬৫ শতাংশ যুবক এখনো ডিজিটাল দক্ষতায় পিছিয়ে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বের ভিত্তিতে কারিগরি শিক্ষাকে জনপ্রিয় করা সময়ের দাবি।

একই সঙ্গে যুব উদ্যোক্তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। দেশে যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগগুলো (এমএসএমই) আছে, তাঁরাই ৮০ শতাংশ কর্মসংস্থান তৈরি করেন। তাই স্টার্টআপ ফান্ড, মেন্টরশিপ, সহজ শর্তে ঋণের মতো উদ্যোগকে কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি যুববান্ধব নীতিমালা তৈরি ও তার যথাযথ বাস্তবায়নে যুব সংগঠনগুলোকে আরও সক্রিয় হতে হবে। শ্রমবাজার সংস্কার, ন্যূনতম মজুরি নিশ্চিতকরণ, স্থানীয় সরকারের সঙ্গে সমন্বয়ে যুব কর্মসংস্থান নীতি পর্যবেক্ষণ সেল গঠন—এসব উদ্যোগ সময়োপযোগী।

বাংলাদেশে যুব রাজনৈতিক সংগঠনগুলো নিজেদের স্বতন্ত্র অধিকার নিয়ে আন্দোলন গড়ে তোলা বা সরকারকে চাপ প্রয়োগ করার মতো যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই সংগঠনগুলো তাদের মূল দলের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তবায়নের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। তরুণদের সমস্যা ও অধিকার নিয়ে স্বতন্ত্র কর্মসূচি দেওয়ার ক্ষেত্রে খুব বেশি সক্রিয় হতে দেখা যায় না। তাই এখন সময় এসেছে নিজেদের কাঠামোগত সংস্কার করার।

সংগঠনের ভেতরেই গণতান্ত্রিক চর্চা জোরদার করতে হবে যেন নেতৃত্ব আর কোনোভাবে স্বজনপোষণমূলক পুঁজিবাদীদের ও তার রাজনৈতিক মিত্রদের হাতে পুতুল হয়ে না থাকে। শ্রমিক, কৃষক, নারী, ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সঙ্গে বৃহত্তর রাজনৈতিক জোট গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা এখন আরও বেশি। ক্রোনি পুঁজিবাদকে চ্যালেঞ্জ করতে হলে এ লড়াই কেবল যুবদের নয়, প্রান্তিক ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সম্মিলিত লড়াই হতে হবে।

অর্থনৈতিক বিকল্প চিন্তা হিসেবে সহযোগিতামূলক অর্থনীতি বা সামাজিক ব্যবসায়িক মডেলকে উৎসাহিত করা যেতে পারে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, কো-অপারেটিভ মডেল, ডিজিটাল ইকোনমিতে যুবদের অংশগ্রহণ বাড়িয়ে রেন্ট-সিকিং কালচার থেকে মুক্তি পাওয়ার রূপরেখা তৈরি করা জরুরি। পাশাপাশি ট্যাক্স জাস্টিস ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ধনীদের কর ফাঁকি বন্ধ করে সেই অর্থ যুব কর্মসংস্থানে বিনিয়োগের জন্য রাষ্ট্রের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। ব্যাংকঋণ বিতরণে স্বচ্ছতা আনতে হবে এবং নিশ্চিত করতে হবে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত ঋণ প্রদান, যাতে প্রকৃত উদ্যোক্তা যুবকেরা এগিয়ে আসতে পারেন।

শেষ কথা হলো, এ লড়াই কেবল একটি চাকরি পাওয়ার জন্য নয়, এটি লড়াই এক অন্যায্য ও বৈষম্যমূলক অর্থনৈতিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের জন্য। আমাদের স্পষ্ট করে বুঝতে হবে, যুব কর্মসংস্থান সংকট এবং ক্রোনি পুঁজিবাদের মূল কারণ নিহিত আছে দেশের উৎপাদনের উপায়ের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও মালিকানার ভেতর।

রাষ্ট্র ও অর্থনীতি কিছু গোষ্ঠীর স্বার্থে বন্দী হয়ে আছে বলেই সুযোগ, সম্পদ ও ন্যায়বিচার যুবসমাজের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। সুতরাং প্রকৃত পরিবর্তন আনতে হলে প্রয়োজন হবে উৎপাদনের উপায়ের মালিকানায় বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন, যেখানে সম্পদ ও উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ জনগণের হাতে যাবে, কয়েকজন সুবিধাভোগীর হাতে নয়।

অবশ্য এ ধরনের কাঠামোগত রূপান্তর দূরগামী ও জটিল লক্ষ্য হতে পারে। তাই পরিবর্তনের পথে অন্তর্বর্তীকালীন বিকল্পও ভাবতে হবে। সমবায়ভিত্তিক অর্থনীতি, সামাজিক ব্যবসা, ডিজিটাল উদ্যোক্তাবান্ধব কাঠামো, শ্রমিক-কৃষক যৌথ উদ্যোগ কিংবা কর ন্যায়বিচার ও স্বচ্ছ ঋণ বিতরণের মতো উদ্যোগগুলোও ক্রোনি পুঁজিবাদকে দুর্বল করতে সহায়ক হতে পারে।

এসব পদক্ষেপ অন্তত একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও গণতান্ত্রিক অর্থনীতির পথে দেশকে এগিয়ে নেবে। যুবসমাজই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ, আর তাদের শক্তিই হতে পারে কাঙ্ক্ষিত কাঠামোগত পরিবর্তন ও সমাজতান্ত্রিক ন্যায়বোধের প্রধান চালিকা শক্তি।

  • কাজী মারুফুল ইসলাম অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়