কৌতুকগুলো মিলান কুন্ডেরার কাছ থেকে নেওয়া

মিলান কুন্ডেরা
ছবি: এএফপি

কথাসাহিত্যিক মিলান কুন্ডেরা মারা গেছেন। আমার নিয়মিত পাঠকেরা জানেন, বিভিন্ন সময় আমার কলামগুলোয় আমি কুন্ডেরার বই থেকে নানা ধরনের কৌতুক কিংবা মজার ঘটনার উদ্ধৃতি দিয়েছি। সেগুলো আবারও আজ স্মরণ করা যেতে পারে।

১.

মিলান কুন্ডেরা একটা সত্যিকারের কাহিনি শুনিয়েছিলেন প্রাগ শহর নিয়ে; এটি সেই সময়ের কাহিনি, যখন তা সোভিয়েতদের নিয়ন্ত্রণে ছিল।

এক ইঞ্জিনিয়ার একটা সেমিনারে অংশ নিতে প্রাগ শহর থেকে গেছেন লন্ডনে। ফিরেও এসেছেন ঠিক সময়ে। এসে দেখেন, খবরের কাগজে ছাপা হয়েছে—এই ইঞ্জিনিয়ার চেক সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে লন্ডনে বক্তব্য দিয়েছেন এবং তিনি আর দেশে ফিরবেন না।
যা ছাপা হয়েছে, তা ঘোরতর মিথ্যা। তিনি ছুটলেন খবরের কাগজের অফিসে।

সম্পাদক দোষ স্বীকার করলেন। বললেন, এই খবর এসেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দোষ স্বীকার করে বলল, ‘কিছু করার নেই, এটা এসেছে আমাদের লন্ডন দূতাবাস থেকে। গোয়েন্দারা পাঠিয়েছেন এই খবর।’

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এক দপ্তর থেকে আরেক দপ্তরে ছোটাছুটি করে অবশেষে একদিন সত্যি সত্যি দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। বাঁচার তাগিদে। মিলান কুন্ডেরা বলেন, ফ্রানৎস কাফকার গল্পে এ রকম ঘটে। আগে শাস্তি হয়, পরে অপরাধ খোঁজা হয়। কাফকার ট্রায়াল উপন্যাসে একদিন জোসেফ কে নামের প্রধান চরিত্রটি দেখে, তার ঘরে দুজন লোক ঢুকে গেছে। তারা তাকে বলে, ‘তোমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’ জোসেফ কের নাশতা তারা খেয়ে ফেলে। জোসেফ কে তখনো রাত্রিপোশাকে। তার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলতে কিছুই থাকে না।

প্রাগে এক লোকের শাস্তি হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রের বিরোধিতাকারী হিসেবে। তিনি জেলে ছিলেন, কিন্তু আজীবন তিনি সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে গেছেন। কারণ তিনি বলেন, না হলে তো আমার পুরো জীবন ব্যর্থ হয়ে যায়, সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস বজায় রাখলে তবু সান্ত্বনা আসে, মহান সমাজতন্ত্র রক্ষার জন্য আমাকে কারাবাস করতে হচ্ছে।

আরও পড়ুন

২.

মিলান কুন্ডেরার একটা উপন্যাস আছে—ফেয়ারওয়েল পার্টি। ওই উপন্যাসে মিলান কুন্ডেরা এক চিকিৎসকের চরিত্র সৃষ্টি করেন। তাঁর নাম ডাক্তার স্ক্রেটা। যেসব নারীর সন্তান হয় না, ডাক্তার স্ক্রেটা তাদের চিকিৎসা করেন। তিনি নিজের স্পার্ম ওই নারীদের ইনজেক্ট করে দেন। তাদের অনেকেই সন্তান লাভ করে। উপন্যাসের একটা জায়গায় বর্ণনা আছে, ডাক্তার স্ক্রেটা পথ দিয়ে যাচ্ছেন, বাচ্চারা মাঠে খেলছে, তিনি তাকিয়ে দেখছেন, কয়টা বাচ্চা দেখতে তাঁর মতো হয়েছে।

মিলান কুন্ডেরা বলেন, তিনি এই চরিত্র ও ঘটনা লিখেছেন একেবারেই হালকা চালে। কৌতুক করার জন্য। কিন্তু ব্যাপারটা কৌতুক রইল না। একদিন মেডিসিনের এক অধ্যাপক তাঁর কাছে এসে হাজির।

অধ্যাপক বললেন, ‘আমি আপনার লেখার খুব সিরিয়াস পাঠক। আপনার প্রতিটা লাইন আমার মুখস্থ। আমি একটা সেমিনারের আয়োজন করছি। এটার বিষয় হলো “বন্ধ্যত্ব ও স্পার্ম ডোনেশন”। আপনার উপন্যাস “ফেয়ারওয়েল পার্টি”তে ব্যাপারটা আছে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এভাবে একটা কঠিন সমস্যার সমাধান হতে পারে। আপনি অবশ্যই আমার সেমিনারে আসবেন। আপনি বক্তব্য দেবেন।’

কুন্ডেরা বললেন, ‘আমার উপন্যাসকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। আমি এটা নিতান্তই কৌতুক করার জন্য লিখেছি।’
অধ্যাপক পরম বিস্ময়ে কুন্ডেরার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার উপন্যাসকে আমরা গুরুত্ব দেব না? আপনি নিজে লেখক হয়ে এ কথা বলতে পারলেন? আপনার লেখাকে আমরা গুরুত্ব দেব না?’
কুন্ডেরা বললেন, ‘ভাই, লেখকদের সব কথায় গুরুত্ব দেবেন না।’

আরও পড়ুন

৩.

স্তালিনের পুত্র জ্যাকব কেন মারা গিয়েছিলেন জানেন? আমার কলামে মিলান কুন্ডেরার বই থেকে আমি বার তিনেক ঘটনাটা লিখেছি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জ্যাকব ছিলেন মিত্রবাহিনীতে। তিনি টয়লেটে গিয়ে দেখেন, টয়লেট নোংরা। তিনি তাঁর অফিসারকে অভিযোগ করেন, ‘আমি স্তালিনের ছেলে, এই নোংরা টয়লেটে বর্জ্য ত্যাগ করতে পারব না।’

অফিসার তাঁকে বলেন, ‘নিজেই পরিষ্কার করে নাও।’ জ্যাকব সেটা করতে অস্বীকৃতি জানান। অফিসার তাঁকে শাস্তি দেন। রাগে-দুঃখে জ্যাকব ঝাঁপিয়ে পড়েন কাঁটাতারের বেড়ায়। সেটা ছিল বিদ্যুতায়িত। জ্যাকব মারা যান।

লেখক মিলান কুন্ডেরা বলেছেন, জ্যাকব মারা গেছেন মলের জন্য। হি ডায়েড ফর শিট।

৪.

মিলান কুন্ডেরা আমাদের জীবন ও জগৎকে ‘শ্বাসরোধকারী কাফকায়েস্ক’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কারণ, এখানে আমরা কাচের ঘরে বসবাস করছি। তিনি বলেন, কাফকার জগতে এ ঘটনা ঘটে। তাঁর উপন্যাসে দুই লোক ‘কে’র শোবার ঘরে ঢুকে পড়ে। কে নামের লোকটার আর কোনো গোপনীয়তা থাকে না। এখনকার দুনিয়াটা হয়ে পড়েছে সে রকম।

গোপনীয়তার অধিকার একটা অধিকার। গোপনীয়তা কেড়ে নেওয়াকে কুন্ডেরা বলছেন ধর্ষণের তুল্য। আমরা এ রকম একটা সময়ে বসবাস করছি যে আমাদের প্রতিনিয়ত নিপীড়ন করা হচ্ছে গোপনীয়তার অধিকার কেড়ে নিয়ে। তার কতকটা আমরা নিজেরাই ডেকে নিচ্ছি। ফেসবুকে সারাক্ষণ ছবি দিচ্ছি, আমার অবস্থান বলে দিচ্ছি।

আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের ঘরের বা হাতের যন্ত্রগুলো আমাদের অবস্থান কেবল জানাচ্ছেই না, আমাদের বন্ধ ল্যাপটপ খুলে ফেলে ক্যামেরা অন করে আমাদের ঘরের সবকিছু নাকি বাইরে থেকে দেখা ও রেকর্ড করা সম্ভব। বলে কী!

মিলান কুন্ডেরার আইডেনটিটি উপন্যাসে একটা টার্ম আছে—‘মাস্টারবেটিং ফিটাস’। মাতৃগর্ভে ভ্রূণ কী করছে, এটা বাইরের মানুষ দেখে। এই ভ্রূণ কি আপনাকে অনুমতি দিয়েছে যে সে কী করছে, তা আপনারা দেখবেন?

আমাদের সমাজে, আমাদের বিশ্বেও আমরা কী করছি না করছি, তার ওপর সারাক্ষণ নজর রাখা হয়। ক্যামেরায় ছবি তোলা হয়। সেগুলো মনিটর করা হয়। এই জগৎ কাফকার জগৎ।

‘আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। গুরুগাম্ভীর্য তোমাকে রক্ষা করে আসছে। তুমি যদি গাম্ভীর্য কমিয়ে দাও, তাহলে তুমি ক্ষুধার্ত নেকড়েদের সামনে পড়ে যাবে। তুমি জানো, তারা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নেকড়েরা।’

৫.

‘তুমি কী বানাচ্ছ? উপন্যাস?’ সে ব্যথাদীর্ণ কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে।
আমি আমার মাথা নত করি।

‘তুমি আমাকে অনেকবার বলেছ যে তুমি একটা উপন্যাস লিখতে চাও, যাতে তুমি একটাও গুরুগম্ভীর শব্দ লিখবে না। একটা বড় অনর্থক লেখা, যা তুমি লিখবে তোমার নিজের আনন্দের জন্য। আমার ভয় হচ্ছে, সেই সময় এসে গেছে। আমি তোমাকে সাবধান করে দিচ্ছি, খুব সতর্ক থাকবে।’

আমি আমার মাথা আরও বেশি নত করি।

‘তোমার কি মনে আছে, তোমার মা তোমাকে কী বলতেন? আমি তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে পাই, যেন মাত্র গতকালই তিনি এটা বলেছেন, “মিলানকু, ঠাট্টা কোরো না। তোমার রসিকতা কেউ বোঝে না। তুমি সবাইকে আহত করবে এবং শেষে সবাই তোমাকে ঘৃণা করবে।” তোমার মনে আছে?’
‘হ্যাঁ। মনে আছে?’
‘আমি তোমাকে সতর্ক করে দিচ্ছি। গুরুগাম্ভীর্য তোমাকে রক্ষা করে আসছে। তুমি যদি গাম্ভীর্য কমিয়ে দাও, তাহলে তুমি ক্ষুধার্ত নেকড়েদের সামনে পড়ে যাবে। তুমি জানো, তারা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। নেকড়েরা।’

এই ভয়াবহ ভবিষ্যদ্বাণী করে ভেরা আবার ঘুমিয়ে পড়ল।
(স্লোনেস, মিলান কুন্ডেরা। অনুবাদ: আনিসুল হক)

প্রিয় পাঠক। আমার স্ত্রী ও কন্যা আমাকে প্রায়ই এ কথা বলেন। তাঁরা বলেন, ‘তুমি যেসব রসিকতা করো, মানুষ তা ধরতে পারে না। রসিকতা কোরো না।’ ভেরা তার স্বামীর উদ্দেশে যে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছে এবং মিলান কুন্ডেরার মা ছেলেকে যে উপদেশ দিয়েছেন, তা আমি আমার জন্যও শিরোধার্য মনে করছি। আমার খুবই সিরিয়াস থাকা উচিত। কারণ, হালকা কিছু লিখলে ক্ষুধার্ত নেকড়েরা আমাকে ছিঁড়ে খাবে।