যে এক নীতিতেই হবে অনেক সমস্যার সমাধান

তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে গণতন্ত্রের চর্চার অভাব লক্ষণীয় মাত্রায় উপস্থিত। সেই সঙ্গে আছে সংবিধানকেন্দ্রিক অপরাজনীতি। বাংলাদেশ এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সংবিধানের মূলনীতিবিষয়ক বিতর্ক ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত চলছে। এ বিতর্কের বয়স প্রায় বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বয়সের সমানুপাতিক।

সংবিধান সংস্কার কমিটি ধর্মনিরপেক্ষতাসহ রাষ্ট্র পরিচালনার তিন মূলনীতি বাদ দিয়ে গণতন্ত্র বহাল রেখে নতুন ৪ মূলনীতির সুপারিশ করছে। এ সংবাদ এখন আলোচিত। কিছু ক্ষেত্রে তা প্রশংসিত, কিছু ক্ষেত্রে আবার সমালোচিত। এই প্রস্তাবের মাধ্যমে অন্তত একটি বিষয় প্রমাণিত হলো যে গণতন্ত্রে কারও ‘এলার্জি’ নেই।

গণতন্ত্রের ব্যাখ্যা ও এর প্রতি প্রদর্শিত প্রতিশ্রুতি নিয়ে আলোচনা করলেই বুঝা যাবে যে গণতন্ত্র (লিবারাল ডেমোক্রেসি অর্থে) একক মূলনীতি হিসেবেই যথেষ্ট অন্য সব কুতর্ক কিংবা রাজনৈতিক আত্মীকরণ থেকে দূরে থাকতে। কেননা গণতন্ত্রের ভেতরেই রয়েছে আইনের শাসন, ন্যায়বিচার, ধর্মনিরপেক্ষতা, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মতো গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার (মূল্যবোধ অর্থে), যা যেকোনো রাষ্ট্রের উৎকর্ষতার জন্য অপরিহার্য।

গণতন্ত্র সবাইকে সমান অধিকার দেয় এবং সমাজে বৈষম্য দূর করার সুযোগ সৃষ্টি করে। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় জনগণের ইচ্ছা পূর্ণতা পায়, তাই অন্য কোনো নীতির প্রয়োজন হয় না। সংবিধান সংস্কার কমিটির সুপারিশের আলোকে এবং সংবিধান বারবার কাটাছেঁড়ার বিপরীতে গণতন্ত্রের মতো একটি একক নীতিই যথেষ্ট হতে পারে বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। এর জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর রাজনৈতিক হয়ে ওঠা। আর দরকার রাজনৈতিকভাবে সচেতন বৃহৎ জনগোষ্ঠী।

গণতন্ত্র একক মূলনীতি হিসেবে সর্বজনীন ও যথেষ্ট। গণতন্ত্র মানে জনগণের শাসন। গণতন্ত্র এমন একটি শাসনব্যবস্থা, যা জনগণের মতামত, ইচ্ছা ও অংশগ্রহণের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়। এটি সর্বজনীন। কারণ, এটি জাতি, ধর্ম, সংস্কৃতি বা মতাদর্শনির্বিশেষে সবার জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। গণতন্ত্র ন্যায়ের ভিত্তিতে গঠিত একটি ব্যবস্থা, যা প্রতিটি মানুষের অধিকার ও মর্যাদা নিশ্চিত করতে অঙ্গীকারবদ্ধ। জনগণের শাসন হিসেবেই গণতন্ত্রকে পাঠ করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র বিদ্যমান। সেখানে কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষের সমানাধিকার হরণ করা হয় না বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে এর নীতিগুলো চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার বিধানের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার মজবুত প্রতিফলন ঘটায়।

গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু হলো জনগণ। জনগণই রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থার প্রকৃত মালিক এবং তাদের ইচ্ছা, মতামত ও অংশগ্রহণই শাসনব্যবস্থার বৈধতা নির্ধারণ করে। এটি কেবল একটি তত্ত্ব নয়, বরং একক কর্তৃত্ববাদের থেকে সর্বজনীন ব্যবস্থার রূপান্তর। উদাহরণস্বরূপ, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় গণতন্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো ভোটাধিকার। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ তাদের শাসক নির্বাচন করে। যেমন শত সমস্যা সত্ত্বেও প্রতিবেশী ভারত নিয়মিত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণকে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচনের সুযোগ দেয় এবং গণতান্ত্রিক পরিচয়কে জনমনে মূর্তমান রাখে। এটি নিশ্চিত করে যে জনগণের ইচ্ছা শাসনব্যবস্থায় প্রতিফলিত হয়।

নৈতিক নীতির চর্চা ও অংশগ্রহণ জরুরি গণতন্ত্র নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে। জনগণের অংশগ্রহণ কেবল ভোট দেওয়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ নয়। গণতন্ত্রে জনগণ আইন প্রণয়ন, নীতিনির্ধারণ ও শাসকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে (যেমন নরওয়ে বা সুইডেন) জনগণের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করে নীতিগুলো গঠিত হয়। ফলে সুশাসনের পাশাপাশি সামাজিক ন্যায়বিচার নিশ্চিত হয়।

অথচ আমরা এই সামাজিক ন্যায়বিচার টার্ম হিসেবে সংবিধানে রাখা না–রাখা নিয়ে প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছি, জাতি হিসেবে বিভাজিত হচ্ছি। আমরা জানি, গণতন্ত্র এমন এক সর্বজনীন নীতি, যা ধর্ম, সংস্কৃতি ও যেকোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর মতাদর্শের ঊর্ধ্বে। সবার জন্যই গণতন্ত্র কাজ করে। যেমন ধর্মনিরপেক্ষতা নিশ্চিতকরণে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের শাসন ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত হয় না।

যুক্তরাষ্ট্র ও ফ্রান্সে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্র বিদ্যমান। সেখানে কোনো বিশেষ ধর্মের মানুষের সমানাধিকার হরণ করা হয় না বললেই চলে। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ শব্দটি অন্তর্ভুক্ত নেই। তবে এর নীতিগুলো চার্চ ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণ নিশ্চিত করার বিধানের মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতার মজবুত প্রতিফলন ঘটায়।

গণতন্ত্র সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে স্বীকৃতি দেয়। যেমন দক্ষিণ আফ্রিকা একটি বহুজাতিক দেশ, যেখানে বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতির মানুষ বাস করে। তাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেও গণতান্ত্রিক নীতিমালা তৈরি করা হয়েছে। গণতন্ত্রে সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের মাধ্যমে সব নাগরিক সমান অধিকার পায়। কানাডা ও নিউজিল্যান্ডের মতো দেশে আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অধিকার গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নিশ্চিত করা হয়েছে।

সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠনে মূলনীতি হিসেবে এককভাবে গণতন্ত্রই যথেষ্ট। যেমন সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে একটি সুশৃঙ্খল ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গঠন সম্ভব। আইনের শাসন প্রতিষ্টায় গণতন্ত্রে প্রত্যেকের জন্য আইন সমানভাবে প্রযোজ্য, যা নিশ্চিত করে—কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। যেমন যুক্তরাজ্যে প্রধানমন্ত্রীও আদালতে জবাবদিহি করতে বাধ্য। গণতান্ত্রিক শাসনে নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা বজায় থাকে। যেমন জার্মানিতে রাষ্ট্রীয় কার্যক্রমে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন আইনি কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে নারী, সংখ্যালঘু ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সামাজিক ন্যায়বিচার অর্থে অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব।

গণতন্ত্র কোনো বিশেষ গোষ্ঠী বা মতাদর্শের জন্য নয়, বরং একটি সর্বজনীন নীতি, যা সমাজের প্রতিটি স্তরে ন্যায়ের ভিত্তি তৈরি করে। যখন ব্যক্তিগত বা দলের স্বার্থ রাষ্ট্রের স্বার্থের ওপরে স্থান পায়, তখন গণতন্ত্রের প্রকৃত অর্থ নষ্ট হয়ে যায়। গণতন্ত্র যদি সঠিকভাবে চর্চা করা হয়, তবে এটি একক নীতিমালা হিসেবেই একটি কাঙ্ক্ষিত রাষ্ট্র গঠন করার জন্য যথেষ্ট।

ব্যক্তির চিন্তার দৃঢ়তা ও ইনসাফ যেমন একজনকে নৈতিক ও সৎ পথে পরিচালিত করে এবং সমাজে অনন্য হিসেবে প্রতিস্থাপন করে, গণতন্ত্রও তেমনি রাষ্ট্রের জন্য একটি পবিত্র একক নীতিমালা হতে পারে, যদি তা সঠিকভাবে অনুসরণ করা হয়। গণতন্ত্রের নীতি জনগণের জন্য কল্যাণকর, ন্যায়ের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ এবং সবার মতামতকে মূল্যায়ন করার যথেষ্ট সুযোগ তৈরি করে।

তবে সবকিছুর মূলে সমস্যা একটাই। আর তা হলো গণতন্ত্রের রাজনৈতিক অপব্যাখ্যা ও দুরভিসন্ধিমূলক অপব্যবহার। মূলনীতি হিসেবে গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে প্রয়োগ না করলে তা শুধুই নামমাত্র রয়ে যায়। যেমনটা রয়ে গেছে বিগত দিনগুলোতে ব্যাক্তি ও দলকেন্দ্রিক একাধিক রাষ্ট্রীয় মূলনীতি প্রণয়ন, বাতিলকরণ, পুনঃস্থাপনের মধ্য দিয়ে। ক্ষমতাসীন দল বা গোষ্ঠী যদি গণতন্ত্রকে ক্ষমতার অপব্যবহার বা নিজস্ব স্বার্থে ব্যবহার করে এবং অপব্যবহারকারী দলগুলো অতীত থেকে শিক্ষা না নেয়, তবে বহুমাত্রিক মূলনীতিও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক রূপান্তরে কাজে আসবে না।

গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি অশ্রদ্ধা কেবল ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বা দলীয় গোষ্ঠীর জন্য নয়, আপামর জনগণের জন্যও অকল্যাণ বয়ে আনে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত এই দেশকে ক্ষমতাসীনদের অগণতান্ত্রিক হয়ে ওঠার পরিপ্রেক্ষিতে বারবার খেসারত দিতে হয়েছে। অতীতে অগণতান্ত্রিক হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে প্রাপ্ত ‘দণ্ড’ হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য আগামীর পথ চলার সবচয়ে বড় শিক্ষা। গণতন্ত্র তখনই ফলপ্রসূ হবে, যখন তা সঠিকভাবে চর্চা করা হবে। এ জন্য দরকার শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে একটি প্রজন্ম গড়ে তোলার জন্য রাজনৈতিক চুক্তি।

ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এবং ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান