শামীমা বেগমদের ব্যাপারে যুক্তরাজ্য হাত ধুয়ে ফেলতে চাইছে

শামীমা বেগম

বছর পাঁচেক আগে উত্তর-পূর্ব সিরিয়ার একটি বন্দিশিবিরে শামীমা বেগমকে খুঁজে পেয়েছিলেন টাইমসের এক সাংবাদিক। তাঁর কাছেই যুক্তরাজ্যে ফেরার আকাঙ্ক্ষার কথা প্রকাশ করেছিলেন তিনি। আদালতের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্তে এটা পরিষ্কার যে শামীমার আশা পূরণের সম্ভাবনা সুদূরপরাহত।

শুক্রবার আদালত যে রুল জারি করেছেন, তাতে তারা বলেছে যুক্তরাজ্যের সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদ ব্রিটিশ নাগরিক শামীমা বেগমের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার যে সিদ্ধান্ত দেন, তা আইনানুগ ছিল। এই রুল শামীমা বেগমের বিরুদ্ধে গৃহীত বিচারিক সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে সর্বশেষ সিদ্ধান্ত। শামীমা ১৫ বছর বয়সে তাঁর দুই বন্ধুসহ পূর্ব লন্ডনের বাড়ি ছেড়ে ইসলামিক স্টেটে (আইএস) যোগ দিতে যান।

স্পেশাল ইমিগ্রেশন অ্যাপিলস কমিশন (সিয়াক) এর আগে বলেছিল, শামীমা বেগম (২৪) কোনো পক্ষ দ্বারা ‘প্রভাবিত’ ও ‘কারসাজির শিকার’ হয়েছিলেন। ভুক্তভোগী শিশু হিসেবে শামীমা খুব সম্ভবত কারও কারও যৌনলিপ্সা বা উগ্রবাদী যুক্তির খপ্পরে পড়েছিলেন। জাভিদ নিজেও এই বিষয়গুলো বিবেচনা করেছিলেন, যদিও পরে তিনি সব যুক্তিই খারিজ করে দেন। সবশেষ আপিল আদালতও সিয়াকের এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে একমত পোষণ করে।

একই কারণে তাঁর আইনজীবীরা যুক্তি তুলে ধরেন যে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শামীমা ‘রাষ্ট্রহীন’ হয়ে পড়েছিলেন। তিনি যুক্তরাজ্য ও বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিক, কিন্তু বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন না। সে কারণে যুক্তরাজ্যের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া বেআইনি। তাঁদের এই যুক্তি আদালত গ্রহণ করেননি।

আদালতের সর্বসম্মত রায়ে উল্লেখ ছিল, ‘শামীমার কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই এটা জানার পরও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাকে নাগরিকত্ব বঞ্চিত করার সিদ্ধান্ত নেন। কারণ, তিনি জনস্বার্থ ও জাতীয় নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করেছেন।’

শামীমার আইনজীবীরা লড়াই চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে, এই লড়াইয়ের ফল তাঁর পক্ষে যাবে কি না, সে নিয়ে আইনজীবীরা সন্দিহান। কারণ, তিনটি আপিল আদালতই সিয়াকের কথার প্রতিধ্বনি করেছেন। তাঁরা বলেছেন, এই ইস্যুতে উত্থাপিত নানা যুক্তিতর্ক নিজের মতো করে বিবেচনা ও মূল্যায়ন করার পূর্ণ স্বাধীনতা জাভিদের রয়েছে। সিদ্ধান্ত গ্রহণে যতক্ষণ পর্যন্ত না আইনের ব্যত্যয় হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি এই স্বাধীনতা ভোগ করবেন।

রিপ্রিভের অবৈধ আটকাদেশবিষয়ক প্রধান ক্যাথেরিন করনেট শামীমা বেগমসহ সিরিয়ার বন্দিশিবিরে আটক ব্যক্তিদের মামলা তত্ত্বাবধান করছেন। আপিল আদালতের রায় সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমার মনে হয়, এই রায় থেকে আমরা যা দেখছি তা হলো শামীমার যুক্তরাজ্যে ফেরার বিষয়টি একটা রাজনৈতিক সমস্যা এবং এর সমাধানও রাজনৈতিক।’

রাজনৈতিক সমস্যা বলতে করনেট আসলে শামীমা বেগম ছাড়াও আরও যেসব ব্রিটিশ নাগরিকের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের কথা বোঝাতে চেয়েছেন। এই মানুষগুলো উত্তর-পূর্ব সিরিয়ায় আইএসের সঙ্গে সম্পৃক্ততার অভিযোগে কুর্দিদের পরিচালিত বন্দিশিবিরে আছেন।

যুক্তরাজ্য এ সমস্যাকে আর আমলে নিতে চাইছে না। তারা বন্দিশিবিরে থাকা নাগরিকদের ব্যাপারে হাত ধুয়ে ফেলেছে।

আইএসের বিরুদ্ধে সরাসরি যুদ্ধের চার বছর পর, মাত্র দুজন প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৫টি শিশুর প্রত্যাবাসন করে যুক্তরাজ্য অন্য দেশগুলোর তুলনায় ভিন্ন একটি পথ বেছে নিয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ফ্রান্স ১৬০টি শিশু ও ৫০ নারীকে ফিরিয়ে নিয়েছে। জার্মানি ১০০ নারী ও শিশুর প্রত্যাবাসন করেছে। এদিকে কানাডা ও অস্ট্রেলিয়া তাদের নাগরিকদের দেশে ফিরতে দিয়েছে।

২০২১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, নিরাপত্তা বিবেচনায় প্রত্যাবাসনই সঠিক পদক্ষেপ এবং উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সেরা বিকল্প।

ব্রিটিশ নাগরিকত্ব আছে এমন ২০-২৫ জন নারী ও তাঁদের পরিবার সিরিয়ার শিবিরগুলোয় অবস্থান করছে। তাঁদের প্রত্যেকেরই নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়া হয়েছে এবং তাঁরা যুক্তরাজ্যের আদালতে এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনি লড়াই করছেন।

করনেট বলেন, ‘এখানে আসলে কী ঘটছে সে সম্পর্কে এই মামলা জনমত গঠন করবে। আমরা অল্প কিছু পরিবার নিয়ে কথা বলছি। তাদের মধ্যে আবার বেশির ভাগ শিশু এবং তারা অন্যায়ভাবে বন্দিশিবিরে আটকা পড়ে আছে। এ নিয়ে কোনো প্রশ্ন ওঠার কথা নয়। তারা ভয়ংকর পরিস্থিতিতে আছে। তাদের দেশে ফিরিয়ে আনা যায়, যদি কোনো অভিযোগ থেকে থাকে, সে সম্পর্কে প্রশ্নও করা যায়।’

বিদেশে যুদ্ধক্ষেত্রে সংঘটিত অপরাধের বিচার যুক্তরাজ্যে করা সহজ নয়। এ নিয়ে সরকারি আইন সংস্থার সাবেক পরিচালক কেন ম্যাকডোনাল্ড কেসি এর আগে সংসদ সদস্য ও সহকর্মীদের বলেছিলেন, প্রযোজ্য ক্ষেত্রে যুক্তরাজ্যেই বিচারের ব্যবস্থা থাকা উচিত। তিনি প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ না নেওয়া এবং যারা নিজেরাই ভুক্তভোগী, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার কঠোর সমালোচনা করেন। উল্লেখ্য, নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার এই কৌশল যুক্তরাজ্য ও বাহরাইন নিয়মিত প্রয়োগ করে থাকে।

গত বছর সন্ত্রাসবাদবিষয়ক আইনের স্বাধীন একজন বিশ্লেষক জোনাথন হল বলেন, যুক্তরাজ্যের উচিত, সিরিয়ায় আটকে পড়া ব্রিটিশ নাগরিকদের ব্যাপক পরিসরে প্রত্যাবাসনের অনুমতি দেওয়া। তাঁর মতে, শামীমা বেগমকে প্রত্যাবাসনের সুযোগ দিলে নিরাপত্তাঝুঁকির হার খুব সামান্য। তিনিও অবশ্য বলেছেন, এই সমস্যার সমাধান রাজনৈতিকভাবে হওয়া প্রয়োজন।

এখন পর্যন্ত আদালত কিংবা রাজনীতিকদের কেউই কোনো পথ দেখাতে পারেননি। ফলে শামীমা এবং অন্যদের ভাগ্যও ঝুলছে। বন্দিশিবিরে তাঁরা বিনা বিচারে আটকা পড়ে আছেন। না আছে আশ্রয়, না স্বাস্থ্যসেবা, না পরিষ্কার পানি। দিনরাত তাঁদের পাহারা দিয়ে রেখেছে সশস্ত্র প্রহরীরা।

মূল নিবন্ধটি গার্ডিয়ানে ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত। লেখক হারুন সিদ্দিক এই পত্রিকার আইনবিষয়ক প্রতিনিধি।