গাজায় গণহত্যা চালিয়ে তেল আবিবের ‘ললিতা’ সিনেমা দেখা কেন

ললিতা ইন তেহরান -এর চলচ্চিত্রের একটি দৃশ্য

যখন পুরো বিশ্ব গাজায় ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতার বিরুদ্ধে স্তম্ভিত, তখন জায়নবাদী শাসন একটি ইরানি উপন্যাসকে সিনেমায় রূপান্তর করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই উপন্যাসটি একসময় আমেরিকান নব্য রক্ষণশীলরা খুব প্রচার চালিয়েছিল।

এই সময়েও, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ফিলিস্তিনি নারী, শিশু এবং তাদের পরিবারের ওপর গণহত্যা চালানোর ব্যস্ততা থেকে সময় বের করে ইরানি নারীদের প্রতি ভালোবাসা ও সংহতির বার্তা পাঠিয়েছেন। এই অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী অত্যন্ত সৌজন্যের সঙ্গে ইরানি নারীদের আশ্বস্ত করছেন যে, তিনি তাঁদের বাধ্যতামূলক হিজাব থেকে মুক্ত করতে এবং আজাদি স্কয়ারে জিন্স ও টি-শার্ট পরে ইসরায়েলি পতাকা ওড়াতে দেখতে চান।

অক্সফামের মতে, ‘ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর হাতে গাজায় অন্যান্য সাম্প্রতিক সংঘর্ষের তুলনায় এক বছরে বেশি নারী ও শিশু নিহত হয়েছে।’ আর এই সময়ই ইসরায়েল হঠাৎ ইরানি নারীদের ভাগ্য নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে কেন?

এই লেখাটি যখন লিখছি, তখন বিদায়ী মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রতিযোগিতা করছেন যে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে একটি তথাকথিত ‘যুদ্ধবিরতি’ আয়োজনের কৃতিত্ব কে নেবে। অথচ ইসরায়েলি বাহিনী অবিরাম ফিলিস্তিনিদের হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। এদিকে নেতানিয়াহু আবার তাঁর মার্কিন মিত্রদের সঙ্গে একটি লোক দেখানো বিরোধের নাটক করছেন।

এই চলমান হত্যাযজ্ঞের মধ্যেও ইসরায়েলি জনগণ ইরানের নারীদের অধিকার নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে? কেন একটি সামরিক রাষ্ট্র, এক মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী যন্ত্রের সামরিক ঘাঁটি হঠাৎ ইরানি নারীদের ভাগ্য এবং তাঁদের হিজাব পরা না–পরা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে?

ইরানি নারীদের উদ্দেশে তাঁর সম্প্রচারিত বার্তায় গণহত্যাকারী ইসরায়েলি নেতা এখন সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা পাচ্ছেন আজার নাফিসির কাছ থেকে। নাফিসি ভুয়া স্মৃতিকথা ললিতা ইন তেহরান -এর লেখিকা।

২০০৩ সালে বইটি বিশ্বব্যাপী সাড়া ফেলে দেয়। এই সাফল্যের পেছনে ছিলেন তাঁর বন্ধু পল উলফোভিৎস। পল ছিলেন জর্জ ডব্লিউ বুশের অধীন মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি সেক্রেটারি। বইটি তাঁকেই উৎসর্গ করা হয়েছিল। বইটির মাধ্যমে ইরান-বিরোধী সামরিক অভিযানের ন্যায্যতা প্রমাণেরও চেষ্টা করা হয়।

নাফিসির মতো প্রতারকেরা নিজেদের জায়নবাদী প্রোপাগান্ডার সেবায় নিয়োজিত করেছে ইরানকে ধ্বংস করার জন্য। তাঁদের লক্ষ্যও স্পষ্ট। ইরানকে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে পরিণত করা। তাহলে ইসরায়েলি উপনিবেশ জঙ্গলের মাঝে একটি প্রাসাদ হয়ে টিকে থাকতে পারবে।

নাফিসি সফলভাবে তাঁর নিজের দেশকে এমনভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলেন তা যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের একটি পুরো জাতির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে সহায়ক হয়েছিল। এর সঙ্গে মিল পাবেন কুয়েতি রাষ্ট্রদূতের ১৫ বছর বয়সী মেয়ে নায়িরাহ আল-সাবাহর ১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে মার্কিন কংগ্রেসে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার সঙ্গে। সেই সাক্ষ্য এক অর্থে ইরাকের বিরুদ্ধে মার্কিন যুদ্ধ শুরু করেছিল।

যখন বইটি প্রথম প্রকাশিত হয়, বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় ইরানি সাহিত্য গবেষক বইটির কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। ফাতেমেহ কেশাভার্জ ২০০৭ সালে জেসমিন অ্যান্ড স্টারস : রিডিং মোর দ্যান ললিতা ইন তেহরান নামে একটি বই লিখে নাফিসির ভুয়া দাবি খণ্ডন করেন।

এখন, দুই দশকের বেশি সময় পরে, ইসরায়েলি পরিচালক এরান রিকলিস রিডিং ললিতা ইন তেহরান বইটি নিয়ে একটি চলচ্চিত্র তৈরি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে পরিচালক যতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো, কে এই সিনেমার জন্য অর্থায়ন করেছে। টাকার উৎস খুঁজে বের করলে অনেক কিছু পরিষ্কার হয়ে যায়।
সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো সিনেমা বানানোর সময়টা। যখন পুরো বিশ্ব ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের নিষ্ঠুরতা দেখে হতবাক ও ক্ষুব্ধ, তখন কেন ইসরায়েল নাফিসি এবং ভ্লাদিমির নবোকভের উপন্যাস পড়ানোর গল্প নিয়ে আগ্রহী হয়ে উঠল?

ললিতা ইন তেহরান -এর চলচ্চিত্র সংস্করণের অর্থায়ন করেছে একটি ইসরায়েলি ‘রাষ্ট্র-সমর্থিত’ ইশুয়া রবিনোভিচ ফাউন্ডেশন ফর দ্য আর্টস। এই ইসরায়েলি প্রোপাগান্ডাকে ন্যায্যতা দিয়ে চলচ্চিত্রটির পরিচালক বলেছেন, ‘ইসরায়েলি দৃষ্টিকোণ থেকে - একটি ভালো গল্প মানে একটি ভালো গল্পই... আপনার কিছু বলার থাকলে আপনি তার জন্য অর্থায়ন খুঁজে পাবেন।’ আহ, কি সুন্দর কথা!

ঠিক কী এই ফাউন্ডেশন, যা ইরানের বিরুদ্ধে এই প্রোপাগান্ডামূলক কাজের পেছনে অর্থায়ন করছে? এই ফাউন্ডেশন ১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত। তহবিল আসে এর প্রাথমিক মূলধনের আয়ে, তেল আবিব-ইয়াফো পৌরসভার বাজেটিং, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের সহায়তা, ইসরায়েলি ফিল্ম কাউন্সিল, মিফাল হাপায়িস [ইসরায়েলের সরকারি মালিকানাধীন লটারি কোম্পানি] এবং অন্যান্য উৎস থেকে। স্পষ্টত, এই সিনেমা ইরান ও ইরানিদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি গোয়েন্দা ও সামরিক অভিযানের একটি অংশ। এই তথ্য জানার পর সবকিছুরই যেন অর্থ বোঝা যাচ্ছে।

কিছুদিন আগে নারীদের মর্যাদা নিয়ে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে, তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী সোহা কামারিয়ান, হিজাব পরিহিত অবস্থায়, ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান এবং তাঁর কন্যার সামনে বাধ্যতামূলক হিজাবের বিরুদ্ধে একটি সাহসী ও অসাধারণ বক্তৃতা দেন।

দর্শকদের উচ্ছ্বসিত করতালির মাঝে থেমে থেমে, কামারিয়ান বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের নিরাপত্তা বাহিনী নারীদের হিজাবের জন্য হয়রানি করে, অথচ ক্যাম্পাসে যৌন হয়রানি নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নেয় না। তিনি গর্ভবতী নারীদের পেশাগত অগ্রগতি থেকে বঞ্চিত করার নিন্দা করেন। তিনি নারীদের পেশাগত উন্নতির পথে তৈরি দেয়াল এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনে লিঙ্গবৈষম্যের কথা তুলে ধরেন। অসংকোচ ভাষায় তিনি সতর্ক করেন, যদি নারীদের পেশাগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়, তবে তাঁদের ইরান ছেড়ে যাওয়া ছাড়া উপায় থাকবে না।

তবে কামারিয়ান এবং তাঁর মতো লক্ষ লক্ষ সাহসী নারীদের কি তাঁদের সাহস জোগানোর জন্য আজার নাফিসির মতো কাউকে প্রয়োজন হয়? ওয়াশিংটনে বসে নাফিসি তাঁর বেস্টসেলিং কল্পকাহিনির সাফল্য উপভোগ করছেন। এদিকে কামারিয়ান এবং ইরানের সাহসী নারীরা তাঁদের লড়াই নিজেরাই লড়ে যাচ্ছেন।

নাফিসির মতো প্রতারকেরা নিজেদের জায়নবাদী প্রোপাগান্ডার সেবায় নিয়োজিত করেছে ইরানকে ধ্বংস করার জন্য। তাঁদের লক্ষ্যও স্পষ্ট। ইরানকে ফিলিস্তিন, লেবানন, সিরিয়া এবং ইয়েমেনে পরিণত করা। তাহলে ইসরায়েলি উপনিবেশ জঙ্গলের মাঝে একটি প্রাসাদ হয়ে টিকে থাকতে পারবে।

তবে সেই জঙ্গল আরও শক্তিশালী হয়ে উঠলে এই প্রাসাদগুলোর ভিত্তি ধসে পড়বে।

  • হামিদ দাবাশি লেখক ও নিউইয়র্কের কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির ইরানিয়ান স্টাডিজের অধ্যাপক
    মিডল ইস্ট আই-এর ইংরেজি থেকে ঈষৎ সংক্ষিপেত অনুবাদ জাভেদ হুসেন