নির্বাচনের বছরে প্রবৃদ্ধির বাড়া-কমা, অতীত কী বলে

কোনো দেশের জাতীয় নির্বাচনের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওঠা-নামার কতটা সম্পর্ক রয়েছে, তা জানার ও বোঝার প্রচেষ্টা অনেক দিনের। এই সম্পর্ক বা যোগসূত্র কতটা জোরদার হয় বা বাস্তবে কতটা বজায় থাকে, তা অবশ্য এককথায় বলা কঠিন।

অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এ নিয়ে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন রকম গবেষণা করেছেন। এর মধ্য দিয়ে পলিটিক্যাল বিজনেস সাইকেল বা রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের তত্ত্ব বা ধারণার উদ্ভব হয়েছে।

অর্থনীতি শাস্ত্রে বাণিজ্য চক্র বলতে বোঝায় নিয়মিত বিরতিতে প্রধান অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডগুলো তথা উৎপাদন, কর্মসংস্থান, আয় ও বিক্রয়ের উত্থান ও পতন। সহজভাবে বললে অর্থনীতি চাঙা অবস্থা থেকে মন্দায় পতিত হয়, আবার তা ঘুরেও দাঁড়ায়। এভাবে যে চক্র আবর্তিত হয়, তা–ই বাণিজ্য চক্র বা বিজনেস সাইকেল।

আর রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রকে এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা সংজ্ঞায়িত করেছে ‘বাইরে থেকে রাজনীতিকদের হস্তক্ষেপের ফলে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের উত্থান-পতন’ হিসেবে।

আরও পড়ুন

এতে বলা হয়েছে, বিদ্যমান সরকার পুনর্নির্বাচিত হওয়ার সম্ভাবনা জোরদার করার তাগিদে প্রধানত নির্বাচনের ঠিক আগে অর্থনীতিতে যে উদ্দীপনা ঘটায়, সেটা ব্যাখ্যা করা হয় রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের ধারণা দিয়ে।

মানে হলো, ক্ষমতাসীন সরকারের নেতারা নির্বাচন পর্যন্ত অর্থনীতিকে চাঙা রাখতে কিছু পদক্ষেপ নেন, যা বাণিজ্য চক্রের সম্প্রসারণ ঘটায় এবং ভোটারদের কাছে তাঁদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ানোয় ভূমিকা রাখে।

তবে কৃত্রিমভাবে অর্থনীতিকে সাময়িক চাঙা রাখার ক্ষতি সংশোধনের জন্য নির্বাচনের পর বাণিজ্য চক্রের সংকোচন ঘটে। তবে নানা প্রয়াস সত্ত্বেও এই তত্ত্বকে পর্যাপ্ত তথ্য-উপাত্ত দিয়ে খুব জোরালোভাবে প্রতিষ্ঠা করা যায়নি। তারপরও বিষয়টি কৌতূহলোদ্দীপক এবং বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের কারণে প্রাসঙ্গিকও বটে।

আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ‘পলিটিক্যাল বিজনেস সাইকেলস অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার পলিসিজ ইন ডেভেলপিং কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে বাংলাদেশসহ ৩৫টি উন্নয়নশীল দেশের রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের ওপর আলোকপাত করা হয়।

আরও পড়ুন

এতে গবেষক লুডগার সচুকনেটচ এসব দেশে ১৯৭০ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনকে নমুনা হিসেবে ব্যবহার করেন। সে হিসেবে বাংলাদেশের প্রথম পাঁচটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন (১৯৭৩, ১৯৭৯, ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯১) এবং এর বাইরে স্বাধীনতার আগে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের নির্বাচন অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কথা। তবে কোন দেশের কোন কোন নির্বাচন বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে, তা বিস্তারিত উল্লেখ না করায় এ বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

এ গবেষণায় বলা হয় যে নির্বাচনের প্রাক্কালে ক্ষমতাসীন সরকারগুলো পুনর্নির্বাচিত হওয়ার অভিপ্রায় থেকে সম্প্রসারণমূলক ব্যয়নীতি গ্রহণ করে। আর তাই নির্বাচনের আগে রাজস্ব ঘাটতি বেড়ে যায়। আর নির্বাচনের পর নবনির্বাচিত বা পুনর্নির্বাচিত সরকারকে রাজস্ব সুসংহত করার নীতি গ্রহণ করতে হয় বা ব্যয় সংকোচনের দিকে যেতে হয়।

আইএমএফের এই গবেষণা অনুসারে, এ ধরনের রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্র সাধারণত সেই সব দেশেই দৃশ্যমান হয়, যেসব দেশ তুলনামূলক কম বাণিজ্যমুখী বা স্থির বিনিময় হারনীতি অনুসরণ করে।

যখন এই গবেষণা পরিচালনা ও সম্পন্ন করা হয়, তখন বাংলাদেশের অবস্থা এ রকমই ছিল। বাংলাদেশ ১৯৯৪ সালে প্রথম নিজস্ব বিহিত মুদ্রা টাকাকে আংশিক রূপান্তরযোগ্য করে, যা স্থির বিনিময় হারনীতি বাজারমুখী করার প্রথম পদক্ষেপ ছিল।

তাহলে আলোচ্য সময়কালে বা বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রথম দুই দশকে কি রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের উপস্থিতি দেখা গেছে? দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ১৯৭৮-৭৯ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরের তুলনায় কমেছে।

তবে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনকালে ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে (সারণি-১)। তবে তা ১৯৭২-৭২ ভিত্তিবছরের হিসাব অনুসারে। নতুন বা ১৯৮৪-৮৫ ভিত্তিবছর ধরে জাতীয় গণনা শুরু হয় ১৯৮৫-৮৬ অর্থবছর থেকে। তাই নতুন ভিত্তিবছরে এই সময়কালের প্রবৃদ্ধির কোনো হালনাগাদ হিসাব নেই।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের বিষয়টি সম্ভবত ২০১৩ সালে প্রথম বেশ জোরেশোরে আলোচিত হয়। সে বছর ২২ অক্টোবর বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ ‘২০১৪ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতি: বাজেটের তিন মাস পরে, নির্বাচনের তিন মাস আগে’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা তুলে ধরে।

Galib Mujahid

তাতে বলা হয়, ‘বিশ্বের বহু দেশই জিডিপি প্রবৃদ্ধির ওপর রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের প্রভাবের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যায়। নির্বাচনের বছরগুলোয় বাংলাদেশও প্রকৃত জিডিপি প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়া প্রত্যক্ষ করেছে। অবশ্য রাজনৈতিক ক্রান্তিকালগুলোয় বাংলাদেশে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেওয়ার প্রবণতাও প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার অন্যতম কারণ।’

সিপিডির বিশ্লেষণে আরও দেখানো হয়েছিল যে প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার পাশাপাশি রাজস্ব আদায়ও নির্বাচনের বছরে কমে যায়, যা আবার নির্বাচনপরবর্তী বছরে বাড়ে। আবার নির্বাচনী বছরগুলোয় রাজস্ব ব্যয় বাড়ে, তবে সরকারি বিনিয়োগ সাধারণত কমে যায়। সিপিডি মূলত ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৯ সালের জাতীয় নির্বাচনকে ধরে বিশ্লেষণটি তৈরি করেছিল।

অবশ্য এর কয়েক দিন আগে (অক্টোবর ৬, ২০১৩) বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের তখনকার প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এক সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের বিষয়টি তুলে ধরেন। তাতে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধির ক্ষেত্রে এই চক্রের উপস্থিতি দেখা যায়। বিগত পাঁচটি নির্বাচনী বছরে (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৭ ও ২০০৯) জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার হ্রাস পেয়েছে।

আরও পড়ুন

উল্লেখ্য যে ২০০৭ সালের শুরুতে নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও তা হয়নি, হয়েছে প্রায় দুই বছর পর ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর। কিন্তু নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংঘাত-সহিংসতার নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে, যা প্রবৃদ্ধি কমিয়ে দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন জাহিদ হোসেন।

আবার গত এক দশকের রাজনৈতিক বাণিজ্য চক্রের পরিস্থিতিটা কেমন ছিল? তার আগের দুই দশকের ধারাবাহিকতার ব্যত্যয় ঘটিয়ে ২০১৪ নির্বাচনী বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। উল্লেখ্য, পুরোনো হিসাব মানে ২০০৫-০৬ ভিত্তিবছরে পরিমাপকৃত জিডিপি অনুসারে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৬ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, যা তার আগের অর্থবছরের চেয়ে সামান্য কম। আর হালনাগাদকৃত (বা ২০১৫-১৬) ভিত্তিবছর অনুসারে আলোচ্য নির্বাচনী অর্থবছরে এই হার দাঁড়ায় সাত শতাংশে, যা আগের বছর বা ২০১২-১৩ অর্থবছরে ছিল ৬ দশমিক ৬০ শতাংশ। তার মানে হলো, নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে (সারণি-২)।

একই রকম পরিস্থিতি দেখা গেছে ২০১৮ সালের নির্বাচনী বছরে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ৩২ শতাংশ, যা ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৮৮ শতাংশে।

Galib Mujahid

এখানে একটু খেয়াল রাখা প্রয়োজন যে বিগত তিনটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে অর্থবছরগুলোর একেবারে মাঝখানে। এবারও তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

অর্থবছরের মাঝখানে নির্বাচন হওয়ার ফলে বছরের প্রথমার্ধে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ডামাডোলের যে নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়ে, তা নির্বাচনের পর কাটিয়ে ওঠার সুযোগ হয়। এতে বছরের শেষ ভাগে গিয়ে অর্থনীতি অনেকটাই চাঙা হয়, যা সার্বিকভাবে প্রবৃদ্ধি বাড়ায়। বিষয়টা শেষ দুটি নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধি বেড়ে যাওয়ার পেছনে অন্যতম নিয়ামক হিসেবে কাজ করতে পারে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে, গত তিন দশকে যে সাতটি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে (১৯৯৬ সালে চার মাসের ব্যবধানে দুটি নির্বাচনসহ), তাতে শেষ দুটি নির্বাচনী বছর ছাড়া অন্য নির্বাচনী বছরগুলোয় প্রবৃদ্ধি তার আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমেছে।

শেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনী বছরে একই রকম প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৬ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ হারে (সাময়িক হিসাব) প্রবৃদ্ধি অর্জনের পর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে (যা নির্বাচনী বছরও বটে) প্রবৃদ্ধির হার কত হবে, তা অর্থবছরের মাঝামাঝিতে এসে অনুমান করা কিছুটা কঠিন।

আরও পড়ুন

সরকার চলতি অর্থবছরে বাজেট ঘোষণার সময় সাড়ে সাত শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল।

মূল্যস্ফীতি ক্রমাগত বেড়ে চলা এবং দেশে ডলারের অব্যাহত সংকটের মুখে গত ডিসেম্বর মাসে এই লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে সাড়ে ছয় শতাংশ পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

যদি এর কাছাকাছিও প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয় আর যদি চূড়ান্ত হিসাবে গত অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার সাময়িক হিসাবের চেয়ে তেমন একটা না বাড়ে, তাহলে হয়তো আরেকটি নির্বাচনী বছরে প্রবৃদ্ধি বাড়ার দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে।

  • আসজাদুল কিবরিয়া লেখক ও সাংবাদিক।
    [email protected]