থাইল্যান্ডে গণতন্ত্রের নতুন দিন নাকি আবার সেনা সমর্থিত সরকার?

মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাত

পাঁচ বছর নিপীড়নমূলক সামরিক স্বৈরশাসনে থাকার পর ২০১৯ সালে থাইল্যান্ডে পার্লামেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। থাইল্যান্ডের ভোটাররা তাঁদের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও সে সময় সামরিক বাহিনীর পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত সরকারকে ক্ষমতায় আসতে দিয়েছিলেন।

 দেশটিতে চার বছর সামরিক বাহিনীর ছত্রচ্ছায়ায় সংসদীয় গণতন্ত্র চালু থাকার পর এবার থাইল্যান্ডের ভোটাররা তাতে তীব্র অনাস্থা জানিয়েছেন। গত রোববারের পার্লামেন্টে নির্বাচনে তাঁরা সামরিক জান্তা এবং তাদের প্রক্সি রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রবলভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন।

 থাইল্যান্ডের সবচেয়ে প্রগতিশীল দল মুভ ফরোয়ার্ড নতুন পার্লামেন্টে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক আসন পেয়েছে। খুব কাছাকাছি আসন পেয়ে দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে সিনাওয়াত্রা পরিবারের প্রতিষ্ঠিত এবং উদারপন্থী ফেউ থাই পার্টি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে বুজেথাই দলটি। ঐতিহ্যগতভাবেই ক্ষমতাসীন শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া দলটি থাইল্যান্ডের পরাজিত জোটেরও শরিক। সামরিক বাহিনীর প্রক্সি দল দুটি চতুর্থ ও পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে। এর মধ্যে সাবেক উপপ্রধানমন্ত্রী ও সাবেক সেনাপ্রধান প্রবিত ওংসুওয়ানের নেতৃত্বে থাকা পালং পাচারাত চতুর্থ অবস্থানে এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া প্রাউত চান-ওচার দল ইউনাইটেড থাই নেশন পার্টি পঞ্চম হয়েছে।

সামরিক বাহিনীর ভূমিকার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ

নির্বাচনের ফলাফল থেকে দেখা যাচ্ছে, মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রতি আগেরবারের চেয়ে এবার জনসমর্থন অনেক বেড়েছে। ২০১৯ সালের নির্বাচনে দলটি এবারের তুলনায় অর্ধেক আসন পেয়েছিল। ব্যাংককের ৩৩টি আসনের মধ্যে একটি ছাড়া সব কটিতেই জিতেছে দলটি। আগের নির্বাচনগুলোর ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ফেউ থাই পার্টি ব্যাংককে অনেক ভালো ফলাফল করত।

 ব্যাংককে সম্প্রতি নির্বাচিত নির্দলীয় গভর্নর চাদচার্ট সিটিপুনের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক নৈপুণ্য দেখে প্রভাবিত হয়েছেন সেখানকার ভোটাররা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহি ও কঠোর পরিশ্রমের নতুন একটা মান তৈরি করেছেন তিনি। মুভ ফরোয়ার্ড পার্টির প্রধান নেতা পিটা লিমজারোয়েনরাতের মধ্যেও একই গুণ রয়েছে। সাবেক ব্যবসায়ী পিটা হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়েছেন।

থাইল্যান্ডে যে নতুন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে, তারা যদি রাজনীতিতে সামরিক শক্তির সম্পৃক্ততার বিষয়টি কঠোরভাবে বিরোধিতা করতে পারে, তাহলে সেটাই হবে যৌক্তিক। সে ক্ষেত্রে পিটার নেতৃত্বে থাইল্যান্ডের রাজনীতি একটি গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল যুগে পদার্পণ করতে পারবে।

 দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর জন্য সেই ঘটনা হবে উত্তরণের প্রেরণা। ২০২১ সালে মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান এবং হুন সেনের নেতৃত্বে কম্বোডিয়ায় স্বৈরশাসনের তীব্রতা বৃদ্ধির কারণে অঞ্চলটিতে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে গণতন্ত্র ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

থাইল্যান্ডে সেনাসমর্থিত সরকারের সমর্থন এভাবে পড়ে যাওয়ার ঘটনা এই ইঙ্গিত করছে যে, সাধারণ মানুষ চেয়েছে সেনাবাহিনী ক্ষমতা থেকে সরে যাক। প্রাউত চান-ওচা ২০১৪ সালের মে থেকে থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইংলাক সিনাওয়াত্রা সরকারকে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সরিয়ে তিনি ক্ষমতায় আসেন। এর পর থেকে থাইল্যান্ডের জনগণ তার স্বৈরতান্ত্রিক ঘরানার শাসন, অল্পতেই রেগে যাওয়া আচরণ এবং মাঝারি মানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মানিয়ে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।

আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো, ফেউ থাই পার্টি কি থাইল্যান্ডের ডাকুনিয়ান বা নিবর্তনমূলক লেজ-মেজেস্ট্রি আইন সংস্কারের যে বিতর্কিত নীতি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি ঘোষণা করেছে, তাতে সমর্থন দেবে কি না? রাজতন্ত্রকে অবমাননা করা হলে এই আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইন সংস্কার হলে, বিরোধী রাজনীতিকদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাবে। যদিও মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি বলেনি যে তারা থাইল্যান্ডকে রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে চায়।

নিশ্চয়তা নেই

নির্বাচনের ফলাফল এই নিশ্চয়তাও দিচ্ছে না যে থাইল্যান্ডের বিরোধী দলগুলো সরকার গঠন করতে সক্ষম হবে। নির্বাচনের ফলাফলে এগিয়ে থাকলেও বিরোধীদের সামনে প্রথম চ্যালেঞ্জটা হলো সংবিধান। ২০১৭ সালে সংবিধানে এমন একটি বিধি যুক্ত করা হয়েছে, যেখানে বলা হয়েছে, অনির্বাচিত ও সামরিক বাহিনীর নিয়োগ করা ২৫০ জন সিনেটর এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যৌথভাবে বসে পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করতে হবে। সংবিধানের সেই বিধির জোরেই, সামরিক বাহিনী সমর্থিত প্রক্সি দলগুলো জোট গড়ে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারে।

সেনাসমর্থিত দল দুটি যদি এখন আগে সরকারি জোটে ছিল এমন দলগুলোর সমর্থন আদায় করে নিতে পারে, তাহলে তাদের আসনসংখ্যা হবে ১৭০টি। সামরিক জান্তার নিয়োগ করা ২৫০ সিনেটরের সমর্থন নিয়ে তারা তখন অনায়াসেই সরকার গঠন করতে পারবে।

সেটা সত্যি সত্যিই ঘটলেও তারা পার্লামেন্টে সংখ্যালঘু সরকার হবে। বিরোধীদের সমর্থন ছাড়া তারা পার্লামেন্টে কোনো আইন পাস করতে পারবে না। নিজেদের মধ্যেও আস্থার সংকট তৈরি হবে। কিন্তু সেনাসমর্থিত দলগুলোর এই আশা থাকতে পারে যে মন্ত্রিসভায় সদস্যপদসহ নানা সুবিধা দিয়ে তারা পার্লামেন্টে বিরোধী দলকে বশে রাখতে পারবে।

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জটি হলো, বিরোধী দলগুলোকে নিয়ে একটি গণতান্ত্রিক জোট গঠন করা। প্রশ্ন হলো, নিজেদের প্রার্থীদের বাদ দিয়ে ফেউ থাই পার্টি কি পিটাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে? সাবেক প্রধানমন্ত্রী থাকসিন সিনাওয়াত্রার মেয়ে পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে কি ফেউ থাই পার্টি সামনে আনার চেষ্টা করবে না?

আরেকটি বড় প্রশ্ন হলো, ফেউ থাই পার্টি কি থাইল্যান্ডের ডাকুনিয়ান বা নিবর্তনমূলক লেজ-মেজেস্ট্রি আইন সংস্কারের যে বিতর্কিত নীতি মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি ঘোষণা করেছে, তাতে সমর্থন দেবে কি না? রাজতন্ত্রকে অবমাননা করা হলে এই আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। এই আইন সংস্কার হলে, বিরোধী রাজনীতিকদের শায়েস্তা করার ক্ষেত্রে সরকারের ক্ষমতা সীমিত হয়ে যাবে। যদিও মুভ ফরোয়ার্ড পার্টি বলেনি যে তারা থাইল্যান্ডকে রাজতন্ত্র থেকে প্রজাতন্ত্রের দিকে নিয়ে যেতে চায়।

মুভ ফরোয়ার্ড ও ফেউ থাই পার্টি—এই দুটি দলের জোট সরকারে বুজেথাই দলকে নিয়ে আসতে পারলে জোটটি আরও শক্তিশালী হবে। এই দলটি বহু বছর ধরে থাইল্যান্ডের রাজনৈতিক পরিসরে দুই শিবিরেই ঘোরাফেরা করে আসছে। কিন্তু এর মানে অবশ্য এই নয় যে এই দলটি মারিজুয়ানা ইস্যুতে মুভ ফরোয়ার্ড ও ফেউ থাই পার্টির অবস্থান গ্রহণ করবে। দুটি দলই চিকিৎসার উদ্দেশ্যে মারিজুয়ানার ব্যবহারে বিধিনিষেধ আরোপ করতে চায়।

আরও পড়ুন

বিচার বিভাগীয় অভ্যুত্থানের ভয়

বিরোধী দলগুলোর সামনে তৃতীয় চ্যালেঞ্জটা সম্ভবত সবচেয়ে উদ্বেগজনক। এ সম্ভাবনাও আছে যে থাইল্যান্ডের রক্ষণশীল এস্টাবলিশমেন্ট (সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক সম্প্রদায়) আদালতের মাধ্যমে নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করে দিতে পারে। থাইল্যান্ডে এমন ঘটনা আগেও ঘটেছে।

যা–ই হোক, লক্ষণ দেখা বোঝা যাচ্ছে পার্লামেন্টে যৌথ অধিবেশন খুব দ্রুতই অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এবং সরকার গঠনের উদ্দেশ্য জোটের জন্মও এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র। আর তখনই বলা যাবে, সত্যিকারেই জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটল কি না।

এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে

  • গ্রেগ রেমন্ড অস্ট্রেলিয়ার ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক