শ্রীলঙ্কায় নির্বাচনী হাওয়া: ভারত, চীনের সঙ্গে এবার শরিক আমেরিকাও

রনিল বিক্রমাসিংহেছবি : এএফপি

দুই বছর আগেও শ্রীলঙ্কা আন্তর্জাতিক মিডিয়ার শিরোনাম হতো ঘন ঘন। দেশটির অর্থনৈতিক করুণ হাল বাংলাদেশেও বিস্তর শঙ্কা তৈরি করে তখন। দেশটির মানুষ খুব কষ্ট করেছে গত দুই বছর। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উভয় দিক থেকে কোণঠাসা অবস্থা ছিল তাদের। একদিকে জিনিসপত্রে নিয়ন্ত্রণহীন দরদাম, অন্যদিকে অতি ক্ষমতাবান এক প্রেসিডেন্টের আমলাতান্ত্রিক শাসন টুঁটি চেপে আছে সেখানকার মানুষের। কিন্তু শেষমেশ প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে নতুন নির্বাচন দেওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছেন। নির্বাচনের আওয়াজ ওঠামাত্র কলম্বোয় কূটনীতিবিদদের আড্ডাও বেশ সরগরম এখন। বরাবরই শ্রীলঙ্কার নির্বাচন নিয়ে ভারত ও চীনের রয়েছে গভীর আগ্রহ; পাশাপাশি দুশ্চিন্তাও। এবার তাতে শরিক যুক্তরাষ্ট্রও।

নির্বাচন হবে—নির্বাচন হবে না!

নির্বাচনের নির্দিষ্ট দিনক্ষণ এখনো ঠিক হয়নি। নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা অক্টোবরের প্রথম দিকে নির্বাচন করতে চায়। প্রেসিডেন্ট পদের মেয়াদ অনুযায়ী সেটাই করণীয়। নির্বাচন কমিশনার সমন রত্নায়েক বলেছেন, আগস্টে তারিখ জানিয়ে দেওয়া হবে। তবে দেশটিতে অনেকে এমনও ভাবছেন, শেষ মুহূর্তে হয়তো নির্বাচন স্থগিতের ঘোষণা আসতে পারে। কারণ, বর্তমান প্রেসিডেন্ট যদি দেখেন নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা কম, তাহলে সেই নির্বাচন হতে দিতে তাঁর আগ্রহ থাকার কথা নয়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) নির্বাচন চায় না বলেই মনে হচ্ছে। জনপ্রিয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে কাজ করতে বরাবরই তাদের অস্বস্তি।

সমাজে আয়বৈষম্য বেশ বেড়ে গেছে

শ্রীলঙ্কার সাবেক প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের কথা বাংলাদেশে অনেকের মনে আছে হয়তো। অর্থনৈতিক কেলেঙ্কারি আর জনরোষের মুখে তিনি প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়েছিলেন একসময়। তাঁর ওই পলায়নের ভেতর দিয়েই রনিল বিক্রমাসিংহের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ তৈরি হয়। তখনকার ক্ষমতাসীন রাজাপক্ষেদের দলের পরোক্ষ সমর্থনে রনিলকে প্রেসিডেন্ট বানিয়ে সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্র ২০২২ সালে গণ-অভ্যুত্থানের হাত থেকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে রক্ষা করে। তখন থেকে রনিল প্রায় একনায়কের মতো দেশ চালাচ্ছেন। আইএমএফ তাঁকে মদদ দিয়ে যাচ্ছে। 

রনিল চমৎকারভাবে ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পেরেছেন। আইএমএফের তিন বিলিয়ন ডলার অর্থনীতিকে খাদের কিনার থেকে খানিকটা ফিরিয়েছে। কারখানাগুলো আবার উৎপাদন বাড়াচ্ছে। জ্বালানির দাম কিছুটা কমানো হয়েছে। বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ডগুলোর কেউ কেউ ফিরে আসছে। তবে ধনী-গরিব এবং শহর-গ্রাম ধনবৈষম্য ও আয়বৈষম্য খুব বেড়ে গেছে। সঙ্গে নতুন যুক্ত হয়েছে ভিক্ষাবৃত্তি। আগে যা খুব একটা দেখা যেত না। দুর্নীতিও লাগামহীন। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আবার মনকাড়া সার্ফিং বিচ হচ্ছে ক্রমাগত। কলম্বোয় আকাশছোঁয়া দালানকোঠাও বাড়ছে।

আরও পড়ুন

কিন্তু জনগণ নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসনের জন্য হাঁপিয়ে উঠেছে বলা যায়। ভারতের সর্বশেষ নির্বাচনের উৎসাহ-উদ্দীপনারও সরাসরি ছাপ পড়েছে পাশের শ্রীলঙ্কায়। জনগণের নির্বাচনী প্রত্যাশার ওপর রনিলও বাজি ধরতে চাইছেন মনে হচ্ছে। গত দুই বছর ক্ষমতায় থাকার সুবিধা ব্যবহার করে প্রভাবশালী অনেক সামাজিক শক্তিকে পাশে জড়ো করতে পেরেছেন তিনি। বিশেষ করে শক্তিশালী আমলাতন্ত্রের সমর্থন আছে তাঁর প্রতি। অনেকে বিদেশি শক্তিও তাঁকে পছন্দ করছে। এসব মিলেই ‘সরাসরি নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট’ হওয়ার প্রলোভনে পড়েছেন তিনি। 

তবে এ বিষয়ে রনিল বিক্রমাসিংহকে দোদুল্যমানও মনে হচ্ছে। তাঁর দল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির সেক্রেটারি সংবাদমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে নির্বাচন স্থগিতের আহ্বান জানিয়েছেন। এ রকম বিবৃতির পর নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে অনিশ্চয়তাও বেশ পাখা মেলেছে। দলের সভাপতির ইঙ্গিত ছাড়া সাধারণ সম্পাদক পালিথা রঙে বন্দরা এমন বিবৃতি দিয়েছেন বলে অনেকেই বিশ্বাস করতে নারাজ। অর্থনৈতিক অবস্থার দোহাই দিয়ে গত বছর একই প্রেসিডেন্ট স্থানীয় সরকার নির্বাচন স্থগিত করেছিলেন। তবে এবারও যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়বে নিঃসন্দেহে।

জনতা বিমুক্তি পেরামুনার উত্থান

প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ইঙ্গিত পাওয়ামাত্র অনেকেই প্রার্থিতার ঘোষণা দিয়েছেন। কে কে প্রার্থী হতে পারেন, তার একটা ধারণাও প্রচার আছে সমাজে। সম্ভাব্য সেসব প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত জনতা বিমুক্তি পেরামুনার অনুরাধা কুমার দেশনায়েকে। দেশজুড়ে যিনি ‘একেডি’ নামে পরিচিত। ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার বা এনপিপি নামের একটি জোটও তাঁকে সমর্থন দিচ্ছে। খানিকটা বামপন্থী, কিন্তু অনেকটা জাতীয়তাবাদী এই জোট রনিল ও আইএমএফের অর্থনৈতিক সংস্কার কর্মসূচি নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বারবার। মনে হচ্ছে, তাদের কথায় জনগণের সম্মতি আছে। 

অর্থনৈতিক সংকট এবং ডলারের দুষ্প্রাপ্যতার সুযোগ নিয়ে আইএমএফ ইতিমধ্যে দেশটির অনেক রাষ্ট্রীয় সংস্থা বেসরকারীকরণ করিয়েছে। সর্বশেষ লোকসানের হাত থেকে বাঁচতে দক্ষিণের মাত্তালা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ব্যবস্থাপনা ৩০ বছরের জন্য যৌথভাবে ভারত ও রাশিয়ার কোম্পানিগুলোর হাতে ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ এসব সিদ্ধান্ত প্রেসিডেন্ট একাই নিচ্ছেন। জনগণ কেবল সংবাদমাধ্যম থেকে সেগুলো জানতে পারছে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো প্রতিনিয়ত প্রেসিডেন্টকে প্রশংসা করছে তাঁর এ রকম ‘গতিশীল’ শাসনে। বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ভারত রনিল বিক্রমাসিংহের বিশেষ অনুরাগী। 

আরও পড়ুন

দ্বীপজুড়ে পোর্ট, হোটেল, রিসোর্টসহ বিভিন্ন খাতে আদানিদের ব্যবসা যেভাবে প্রসারিত হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে চীন তুলনামূলকভাবে গুটিয়ে আছে এখন। নির্বাচনে জনতা বিমুক্তি পেরামুনার (জেভিপি) অনুরাধা কুমার দেশনায়েকের প্রতি তাদের পক্ষপাত থাকবে বলে কলম্বোয় প্রচার আছে। সে ক্ষেত্রে রনিলকে সমর্থন করবে যুক্তরাষ্ট্র-ভারত অক্ষশক্তি। সমীকরণটি অনেকটা কিছুদিন আগে শেষ হওয়া মালদ্বীপের নির্বাচনের মতো। তবে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আরও শক্তিশালী প্রার্থী আছেন। প্রধান বিরোধী দল ‘সঙ্গী জন বালাওয়েগায়া’র সজীব প্রেমাদাসাও এই নির্বাচনে একজন শক্তিশালী প্রার্থী। নির্বাচনে দাঁড়াতে চান তাঁর দলের শরথ ফনসেকাও। 

ফনসেকা গৃহযুদ্ধকালের সেনাপ্রধান। তামিলদের হারানোর কাজে নেতৃত্ব দিয়ে তিনি বিশেষ সম্মানিত দেশটিতে। তবে নির্বাচনে এখন পর্যন্ত প্রধান কৌতূহলের দিক হলো আগের নির্বাচনে সিংহলি সমাজে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া রাজাপক্ষেদের ‘পদুজানা পেরামুনা’ পার্টি কী করবে? তারা বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিলকে সমর্থন করবে কি না, নাকি নিজেদের কাউকে প্রার্থী করবে? এ দুই প্রশ্নের ওপর নির্বাচনের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে। রাজাপক্ষেরা রনিলকে সমর্থন না করলে এবং নিজেরা কাউকে প্রার্থী করলে এই নির্বাচনে রনিলের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। সে ক্ষেত্রে তিনি নির্বাচন না দিয়েই ক্ষমতায় থেকে যেতে চাইবেন।

আরও পড়ুন

দেশটির প্রধান জাতি সিংহলিদের মধ্যে রাজাপক্ষেদের দল ফ্রিডম পার্টির আগের মতো সমর্থন আছে কি না, সেটিও এক ধাঁধা হয়ে আছে এখন। ২৪ মাস আগের গণ-আন্দোলনের পর থেকে সিংহলিদের মধ্যে একেডির জনতা বিমুক্তি পেরামুনার সমাবেশগুলো বড় হতে দেখা যাচ্ছে। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলকে পেছনে ফেলে জেভিপির এগিয়ে যাওয়া থেকে বোঝা যায়, অর্থনৈতিক সংকটে জনগণের রাজনৈতিক পছন্দে পরিবর্তন ঘটেছে।

সামাজিক আরেকটি পরিবর্তন হলো নির্বাচনে একক কোনো দলের প্রতি সিংহলিদের পক্ষপাত থাকবে বলে মনে হয় না। তামিলদেরও একক পছন্দের কোনো প্রার্থী দেখা যাচ্ছে না। সজীব প্রেমাদাসা বা রনিল বিক্রমাসিংহের মধ্যে তাদের ভোট ভাগ হবে। সিংহলি ও তামিল উভয় সমাজের এ রকম বহুমুখী ভোট ভাগাভাগিতে শ্রীলঙ্কায় এবার ভারত না চীনের পছন্দ জয়ী হবে, সেটা অনুমান করা বেশ দুরূহ হয়ে উঠেছে।

এ দেশের সমাজের একটা ঐতিহ্যের দিক হলো, অনিশ্চিত বিষয়ে অনুমানে আসতে ‘গণক’ সম্প্রদায়কে ডাকে তারা। তবে কে প্রেসিডেন্ট হবেন, সেই অনুমানের পাশাপাশি গণকদের পক্ষে এ-ও অনুমান কঠিন হয়ে থাকবে, নির্বাচন আদৌ দেশটিকে চলতি দুর্দশা থেকে টেকসই ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যেতে পারবেন কি না।

গত ৭৫ বছর এখানে রাজনীতিবিদদের বড় এক প্রতিশ্রুতি ছিল তামিল সমস্যার সমাধান নিয়ে, সেটা হয়নি; বরং তামিলদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখিয়ে সিংহলি সমাজ থেকে কেবল সামরিক আমলাতন্ত্রকে শক্তিশালী করার পক্ষে সমর্থন আদায় করা হয়েছে। ক্ষুদ্র দেশের ওই মহাশক্তিধর আমলাতন্ত্র এখন দেশটির গণতান্ত্রিক বিকাশের পথই রুদ্ধ করে দাঁড়িয়েছে এবং রনিল বিক্রমাসিংহে ও গোতাবায়া রাজাপক্ষেরা কেবল অদৃশ্য সেই শক্তির প্রকাশ্য প্রতিনিধি হয়ে ধোঁকা দিয়ে যাচ্ছেন।


আলতাফ পারভেজশ্রীলঙ্কার তামিল ইলম (ঐতিহ্য) গ্রন্থের লেখক