গ্রাম–মফস্‌সলে স্বজনের মতো পাশে চাই প্রথম আলোকে

\

আড়াই দশক আগের কথা। প্রথম আলো বেরোনোর আগে নাম চেয়ে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হলো। একটি পুরস্কার ছিল রেডিও। তারপর একদিন পত্রিকাটি বের হলো। ১৯৯৮ সালের ৪ নভেম্বর। আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী থেকে ফরহাদ মজহার, জাফর ইকবাল থেকে আনিসুল হক। কার লেখা নেই প্রথম আলোয়? ব্রহ্মপুত্রে এসে সব নদী মেশার মতো বৈচিত্র্যময় চিন্তার সমাবেশ ঘটল। সেগুলো আমাদের যৌবনকে গড়ে দিতে থাকল। আমরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করলাম—একদিন আমরাও।

শুক্রবারের সাহিত্য সাময়িকীর জন্য সে সময় আমাদের সে কী অপেক্ষা! কার কার কবিতা থাকবে? যাঁর গুচ্ছ কবিতা থাকবে, তিনি তারকা কবি। একদিন আমাদেরই আড্ডার বড় ভাই কামরুজ্জামান কামুর একগুচ্ছ কবিতা ছাপা হলো।  মাসুদ খান, শাহীন মোমতাজ, ফিরোজ এহতেশামের কবিতা ছাপা হলো। সত্তর ও আশির দশকের কবিতার স্বাদ বদলে গিয়ে মেধাবী কবিরা জায়গা করে নিতে থাকলেন বাংলা সাহিত্যে। কবিতা চলে গেল পাঠকদের পাত থেকে বুদ্ধিজীবীদের ঘরে।

এই সাময়িকীতেই আমরা পড়লাম ‘ক্রুসেড, জেহাদ ও শ্রেণীসংগ্রাম’। লিখলেন ফরহাদ মজহার। আহমদ ছফা, সলিমুল্লাহ খান,  হুমায়ুন আজাদের লেখায় আমরা মন্ত্রমুগ্ধ। বাংলাদেশের সেরা চিন্তকেরা লিখছেন উপসম্পাদকীয়তে। শনিবারের ছুটির দিনে বছরের সেরা ১১ তারকাকে নিয়ে পোস্টার হলো। তাঁরা হয়ে উঠলেন আমাদের হিরো।

নাসির আলী মামুন পথে পথে ঘুরে বিচিত্র মানুষের সাক্ষাৎকারে নেন। খেলা দেখে আনন্দ উপভোগ করছি প্রথমবার, পরের দিন উৎপল শুভ্রের ক্রীড়াভাষ্য পড়ে দ্বিতীয়বার। ’৯৮ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত এমনই দৃশ্যের পর দৃশ্য। তারপর পরিস্থিতি একটু একটু করে বদলাতে শুরু করল। আমাদের সমাজে বিভক্তি ও বিভাজন বাড়তে থাকল। তার প্রভাব পড়তে শুরু করল পত্রিকার পাতায়। যেদিন গেছে, সেদিন কি একেবারেই গেছে!

২.

শিপন মাহমুদ (৩৫), বাড়ি কুড়িগ্রামের চর রাজীবপুর উপজেলায়। পেশায় হকার। তিনি বলেন, সরেজমিন প্রতিবেদনগুলোর জন্য প্রতিদিন আলাদা জায়গা রাখা দরকার। সপ্তাহে এক দিন বিরোধী–দলীয় ও সরকারদলীয় কলাম থাকা দরকার। আঞ্চলিক সংস্করণ আলাদা হওয়ায় সারা দেশের আঞ্চলিক খবরগুলো জানতে পারি না। এর চেয়ে বরং আগের বিশাল বাংলাই ভালো ছিল।

কুড়িগ্রাম জেলার ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আতিকুর রহমান বলেন, প্রথম আলো সঠিক সংবাদ  করে; কিন্তু সব সময় ক্ষমতাসীনদের একটু বেশি খোঁচা মারে ভয়ডরহীনভাবে। সাধারণ জনগণ এ ধরনের সংবাদ বেশি পছন্দ করে।

চিলমারীর নয়ারহাট চরের মাইদুল ইসলাম (৩২)। তৈরি পোশাককর্মী। তিনি জানান, গ্রামের লোকজনের কাছে প্রথম আলো প্রথম পছন্দের পত্রিকা। ইদানীং আজেবাজে কিছু বিষয় নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করে বলে বিরক্ত লাগে। পরীমনির ছেলের চুল কাটা বা এ রকম কোনো বিষয় নিয়ে নিউজ করলে মান থাকে না। বস্তুনিষ্ঠ ও নিরপেক্ষ সংবাদ চাই।

রেল-নৌ, যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটি, কুড়িগ্রাম জেলা শাখার সাংগঠনিক সম্পাদক খন্দকার আরিফ জানান, কুড়িগ্রামে আন্তনগর ট্রেনের আন্দোলনের একাধিক সংবাদ করেছে। গণকমিটি ও কুড়িগ্রামের দাবি আদায়ে প্রথম আলো স্বজনের মতো পাশে ছিল। চাকিরপশার নদ উদ্ধার আন্দোলনে দুটি বড় প্রতিবেদনসহ বেশ কয়েকবার সংবাদ এবং উপসম্পাদকীয় ছেপেছে।

ব্রহ্মপুত্রের ডান তীর সংরক্ষণ, রেল আন্দোলন, ২৬ বাংলাদেশিকে ভারতের জেল থেকে উদ্ধার, বিশ্ববিদ্যালয়, চিলমারী বন্দর চালু, রায়গঞ্জ হাসপাতাল চালু, চিলমারী-উলিপুরের পাউবো বাঁধ থেকে হঠাৎ উচ্ছেদ বন্ধ করা, সীমান্ত হাট আবার চালু, ছিটমহল বিনিময়, বুড়িতিস্তা খননসহ নদ-নদী উদ্ধার, চিলমারী-সুন্দরগঞ্জের তিস্তা সেতুর নকশায় রেল রাখা—প্রতিটি গণদাবিতে প্রথম আলো উপসম্পাদকীয় ছেপেছে।

সফি ভাইকে (সফি খান, প্রথম আলোর কুড়িগ্রামের জেলা প্রতিনিধি)  একদিন ফোন দিয়ে শুনি, তিনি দুর্গাপুরে লাইনের পাশে শুয়ে আছেন। ভাঙা ব্রিজের ছবি তুলবেন ট্রেনসহ। ট্রেনের অপেক্ষা করছেন ঘণ্টাখানেক ধরে।

চিলমারীর মুদাফৎ থানা গ্রামের সজীব মিয়া (২৬) বলেন, প্রথম আলোর সবকিছুই ভালো। তবে সাহিত্যের পরিসর আরেকটু বাড়ানো প্রয়োজন। ক্রীড়া ও বিনোদনে যতটা জায়গা, সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ততটা দেয় না। পড়াশোনা পাতা যেটি আছে, সেখানে শুধু পাস নয়, জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ তৈরিতেও গুরুত্ব দিতে হবে।

হামিদুল ইসলাম (৩৬) বলেন, মানুষের কাছে প্রথম আলো হলো বিচার বা প্রতিকার পাওয়ার সর্বশেষ অবলম্বন। তা কোনো ব্যক্তিগত অবিচার হোক বা দেশের। দেশের মানুষ যতটুকু ভালো আছেন, তা প্রথম আলোর জন্যই। কুড়িগ্রাম কেন দারিদ্র্যের শীর্ষে, তা নিয়ে বিশ্লেষণী লেখা পেয়েছি প্রথম আলোতেই। কুড়িগ্রাম বদলে গেছে প্রথম আলোর কারণেই।

৩.

মফস্‌সলের অনুসন্ধানী রিপোর্টগুলো যখন প্রথম পাতায় আসে, তখন চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। মন্ত্রী-এমপিদের টনক নড়ে। কয় দিন আগে লালমনিরহাটের জনৈক মন্ত্রীর বিদ্যুৎ বিল বাকি রাখা নিয়ে খবর প্রকাশ করেন স্থানীয় জেলা প্রতিনিধি আব্দুর রব সুজন। মন্ত্রী ও তাঁর আত্মীয়রা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে বাধ্য হন। তখন বোঝা যায়, বাংলাদেশে গ্রাম আছে।

তবে উপসম্পাদকীয় পাতায় গ্রাম নেই। অনলাইনে দুই কোটি ছাড়িয়েছে পাঠকসংখ্যা। মাঝেমধ্যে অনলাইন সংস্করণে গ্রাম থাকে, অথচ গ্রামের পাঠকেরা অনলাইনে কম অভ্যস্ত। এদিকে নীতিনির্ধারকেরাও ছাপা কাগজই পড়েন। তাই ছাপা পত্রিকায় মফস্‌সল না থাকলে বঞ্চিত গাঁয়ের সমস্যার সমাধান সুদূরপরাহত। নইলে কেমনে আলোর স্পর্শে কবে কেটে যাবে এই দুঃখের কাল? প্রথম আলো! গ্রামের প্রথম আলো!

আড়াই দশক ধরে প্রচারসংখ্যার শীর্ষে প্রথম আলো। যথার্থই চতুর্থ স্তম্ভ। জেলা প্রতিনিধিরাও একই মর্যাদার অধিকারী। বন্ধুসভার কাজকর্মের কারণে একই সঙ্গে জেলায় তাঁরা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বও বটে। তাই ক্ষমতাবান অংশগুলো জেলা প্রতিনিধিদের হাতে রাখতে চান। কখনো কখনো তাই খবর কি গুম হয়ে যায়?

লালমনিরহাট, রাজশাহী ও চট্টগ্রামের মতো ব্যতিক্রম ছাড়া সাধারণত ঢাকা থেকে মফস্‌সলে গিয়ে অনুসন্ধানী খবরগুলো করতে হয়। কেন মফস্‌সলের অনুসন্ধানী খবর স্থানীয় প্রতিনিধি পাঠান না? নইলে ঘণ্টা বাজিয়ে নতুন খবর আনার যে কাজ নিয়েছে প্রথম আলো, তার কী হবে?