ক্রীড়ামোদী মোদি কেন ক্রিকেটে ‘অপারেশন সিঁদুর’ ঢেলে দিলেন

ফাইনাল জয়ের পর ট্রফি ছাড়াই উদ্‌যাপন করে ভারতের ক্রিকেট দলছবি: এএফপি

ক্রিকেটকে বলা হয় ভদ্রলোকের খেলা। যখন এ কথাটার শুরু, তখন অবশ্য মেয়েরা ক্রিকেট খেলতেন না। তাই এখন বলব, ক্রিকেট ভদ্রদের খেলা। মাঠে খেলোয়াড়েরা মাথা ঠান্ডা রেখে খেলেন। একটু মাথা গরম করলেই হয়তো ‘এলবিডব্লিউ’ কিংবা ‘নো বল’। দর্শকেরাও দীর্ঘ সময় ধৈর্য ধরে খেলা দেখেন। নিজের দল উইকেট পেলে বা ছক্কা হাঁকালে আনন্দে–উল্লাসে ভেসে যান সমর্থকেরা।

সেই তুলনায় ফুটবলের বদনাম অনেক। মাঠে খেলোয়াড়েরা অনেক সময় মাথা গরম করে খুব খারাপ ফাউল করেন। আমি তরুণ বয়সে ঢাকার স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতাম। আবাহনী ও মোহামেডানের খেলা দেখার সময় কত ইটপাটকেলের ঝড় যে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যেত, তবু খেলা দেখতে মাঠে যেতাম।

রহমতগঞ্জ ক্লাবের খেলা হলে লোকে গোল নিয়ে কথা না বলে কয়জন খেলোয়াড়ের পা ভাঙল, তা নিয়ে বলাবলি করতেন। আর ফুটবলের দর্শকেরা তো সব সময়ই উত্তেজিত—নিজের দল গোল খেলে অফসাইড, গোল দিলে উল্লাস। দুটোরই পরিণতি অনেক সময় গড়ায় হাঙ্গামায়।

ইংল্যান্ড ‘সকার’ দর্শকেরা তো নিজের দেশের খেলা থাকলে গাঁটের পয়সা খরচ করে অন্য দেশে গিয়েও মারামারি করেন।

আরও পড়ুন

ক্রিকেটে ওই সব নেই; বলছিলাম ক্রিকেট ভদ্রদের খেলা। ভারতীয়রা গত দুই দশকে ক্রিকেটের মর্যাদা ও উৎকর্ষ অনেক ধাপ এগিয়ে নিয়েছে। তাদের ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) এখন পৃথিবীর অনেক দেশের খেলোয়াড় ও দর্শকদের আকৃষ্ট করে। বাংলাদেশের কিছু খেলোয়াড়ও আইপিএলের কোটি টাকার স্বাদ গ্রহণ করেছেন। ভারতীয় ক্রিকেট ও ক্রিকেটারদের ভক্ত দুনিয়াজুড়ে। ভারতীয় ক্রিকেটের সুপারস্টার বিরাট কোহলির ভক্তের হার বোধ হয় পাকিস্তানে ভারতের চেয়েও খুব কম নয়।

ভারত ও পাকিস্তানের কাশ্মীর সমস্যা ওদের দুই দেশেরই বয়সের সমবয়সী। এ নিয়ে যুদ্ধবিগ্রহ হয়েছে অনেকবার। কিন্তু দুই দেশের ক্রিকেট–সৌহার্দ্য আগে কখনো এমন ভেঙে পড়েনি; যদিও সময়ে সময়ে ফাটল ধরেছিল। দুই দেশ যখন খেলেছে, ভদ্রভাবেই খেলেছে। ক্রিকেটের আইনকানুন মেনে হাত মিলিয়েছে। জয়–পরাজয় মেনে নিয়েছে এবং পুরস্কার ছোট-বড় যা–ই হোক, খুশিমনে গ্রহণ করে হাসিমুখে বাড়ি ফিরেছে।

এই তো ২০২৩ সালের ঘটনা, পাকিস্তানি ক্রিকেট তারকা শাহিন আফ্রিদি শ্রীলঙ্কায় এশিয়া কাপ চলাকালে ভারতীয় ক্রিকেটার যশপ্রীত বুমরাকে তাঁর প্রথম সন্তানের জন্ম উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানান এবং উপহার দেন।

মোদির যুগে আস্তে আস্তে ভারতের সবই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এখন পুরা মাত্রায় অনিরপেক্ষ। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভারতের দীর্ঘদিনের সমর্থন এখন ইসরায়েলের বন্ধুত্বের কাছে বন্ধক। প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈদেশিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত, খেলাধুলার আচার–আচরণ—সবই এখন পরিচালিত হয় রাজনীতি দিয়ে। ক্রিকেটইবা এখন বাদ যাবে কেন?

ক্রিকেট খেলা চলাকালে ভারতীয় ব্যাটসম্যান কোহলি ও পাকিস্তানি বোলার আমির খেলার মাঠে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বী—সব সময় সচেষ্ট, কে কাকে ফাঁকি দিয়ে আউট করবেন বা ছক্কা হাঁকাবেন! কিন্তু ২০১৬ সালে কলকাতায় খেলার পরে কোহলি মোহাম্মদ আমিরকে নিজের ব্যাটটা উপহার দিয়ে দিলেন। দুবাইতে আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপ ট্রফিতে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে বিরাট কোহলি ও বাবর আজমের একে অপরের কাঁধে হাত রাখা ছবিটা এখনো অনেক ক্রিকেটপ্রেমী মানুষের মনে আছে।

এ রকম অনেক ঘটনা আছে দুই দেশের ক্রিকেট–সম্প্রীতির। পাকিস্তানের সাবেক অধিনায়ক ইমরান খান ও ভারতীয় ক্রিকেট তারকা নভজ্যোত সিং সিধুর উষ্ণ বন্ধুত্বের কথা ক্রিকেট মহলে মোটামুটি সবাইর জানা। ঘটনাক্রমে দুজনই এখন রাজনীতিবিদ।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বলা হয় ক্রিকেটের বড় একজন ভক্ত। গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালে তিনি গুজরাট ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাঁর ক্রিকেট অনুরাগের জন্য ২০২১ সালে বিশ্বের বৃহত্তম ক্রিকেট স্টেডিয়াম আহমেদাবাদের সরদার প্যাটেল স্টেডিয়ামটি নরেন্দ্র মোদি স্টেডিয়াম নামে নামকরণ করা হয়েছে। তাঁর থেকে আশা করা হয়েছিল, অন্তত ক্রিকেটকে তিনি তাঁর রাজনীতির বাইরে রাখবেন। কিন্তু তা কী করে হবে?

আরও পড়ুন

মোদির যুগে আস্তে আস্তে ভারতের সবই পরিবর্তন হয়ে গেছে। ধর্মনিরপেক্ষতা এখন পুরা মাত্রায় অনিরপেক্ষ। ফিলিস্তিনিদের প্রতি ভারতের দীর্ঘদিনের সমর্থন এখন ইসরায়েলের বন্ধুত্বের কাছে বন্ধক। প্রধানমন্ত্রী মোদির বৈদেশিক সম্পর্ক, অভ্যন্তরীণ সিদ্ধান্ত, খেলাধুলার আচার–আচরণ—সবই এখন পরিচালিত হয় রাজনীতি দিয়ে। ক্রিকেটইবা এখন বাদ যাবে কেন?

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারতীয় পুরুষ ক্রিকেট দলের পাকিস্তানকে হারিয়ে ২০২৫ এশিয়া কাপের শিরোপা জয়ে স্বভাবতই আনন্দিত এবং উদ্‌যাপন করেছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে একটা পোস্ট দিয়ে। তাতে তিনি লিখেছেন, ‘খেলার মাঠে #অপারেশন সিঁদুর। ফলাফল একই—ভারত জিতেছে! আমাদের ক্রিকেটারদের অভিনন্দন।’

ক্রিকেট কিছু সৌজন্য ক্রিকেট আইনের মতোই অনুকরণীয়। তার একটি হলো দুই পক্ষের খেলোয়াড়েরা একে ওপরের সঙ্গে করমর্দন করবেন। দুই দলের অধিনায়ক খেলা শুরু হওয়ার আগে টসের সময় হাত মেলাবেন। খেলা শেষ হওয়ার পর ব্যাটিং টিম মাঠে নেমে বোলিং টিমের সঙ্গে হাত মেলাবে। বছরের পর বছর এই সৌজন্য ক্রিকেট আইনের মতোই বিশ্বের প্রতিটি ক্রিকেট দল পালন করে আসছে।

আরও পড়ুন

এবার এশিয়া কাপের পাকিস্তান–ভারত ম্যাচে এ প্রক্রিয়ার ব্যতিক্রম হলো। বিপক্ষ দলকে সম্মান ও সৌজন্য দেখানো যে নিজের দলকে আরও মহিমান্বিত ও সম্মানিত করে, ভারতীয় ক্রিকেট দল সেটা ভুলে গেল। তারা পাকিস্তান দলের সঙ্গে করমর্দন করেনি; খেলার আগে বা পরেও। সারা পৃথিবীর ক্রিকেটভক্তরা স্তম্ভিত হয়ে গেল, ‘এ–ই কি ক্রিকেট?’

আসলে মোদির ক্রিকেটে ‘অপারেশন সিঁদুর’ শুরু হয় এশিয়া কাপ খেলার শুরু থেকে। পাকিস্তানের সঙ্গে ক্রিকেট খেলবে কি না, এ নিয়ে টালবাহানা শুরু হয় দুই দেশের সাম্প্রতিক সামরিক সংঘর্ষের সূত্র ধরে। যখন খেলতে নামল, তখন ভারত সরকার ও ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নির্ধারণ করে দিল, কীভাবে পাকিস্তানের সঙ্গে আচরণ করতে হবে। ভারতীয় ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন সূর্যকুমার যাদব সাংবাদিকদের অকপটে বলেছেন, ভারতীয় ক্রিকেট দল নাকি ক্রিকেট বোর্ড ও সরকারের পরামর্শেই এসব সিদ্ধান্ত নিয়েছে।

আরও পড়ুন

ফাইনাল খেলা শেষে পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে, নিয়ম অনুযায়ী এশিয়ান ক্রিকেট কাউন্সিলের (এসিসি) চেয়ারম্যান এবং পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভির হাত থেকেই ট্রফি নেওয়ার কথা ছিল ভারতের। কিন্তু সূর্যকুমার যাদবের দল তাঁর কাছ থেকে ট্রফি নিতে অস্বীকার করে এবং ট্রফি না নিয়েই নাটকীয়ভাবে মঞ্চ থেকে চলে যায়। নাকভিও সোজা জানিয়ে দেন, সভাপতি হিসেবে তিনিই ট্রফি দেবেন, না হলে ট্রফি দেওয়া হবে না। সূর্যকুমার পরে বললেন, ‘ওরা ট্রফি নিয়ে পালিয়ে গেছে।’ পুরো ব্যাপারই অক্রিকেটীয়।

মেয়েদের এশিয়া কাপ খেলায়ও একই অবস্থা। সেখানে ভারতীয় মহিলা ক্রিকেট দল পাকিস্তানি দলের সঙ্গে হাত মেলায়নি। ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড অবশ্য আগেই জানিয়ে দিয়েছিল, মেয়েদের খেলায়ও ‘অপারেশন সিঁদুর’ জারি থাকবে।

দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) কিংবদন্তি এবি ডি ভিলিয়ার্স রেখেঢেকে কথা বলার লোক নন। এশিয়া কাপে ভারতীয় দলের আচরণ নিয়ে তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তাঁর ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিওতে ডি ভিলিয়ার্স খেলাধুলায় ‘রাজনীতি ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য’ ভারতীয় দলের সমালোচনা করেন। আইপিএল খেলা সেরা খেলোয়াড়দের একজন ডি ভিলিয়ার্সের মতে, ‘ক্রিকেট ও রাজনীতিকে সব সময় একে অপরের থেকে আলাদা রাখা উচিত।’

কথাগুলো শুধু এবি ডি ভিলিয়ার্সের নয়, বিশ্বব্যাপী যারা ক্রিকেট খেলা দেখতে ভালোবাসে, এ কথাটা তাদের অনেকেরই—ক্রিকেট ও রাজনীতিকে সব সময় একে অপরের থেকে আলাদা রাখা উচিত।

এশিয়া কাপে ভারতীয় দল চ্যাম্পিয়ন হয়েছে সত্য, কিন্তু তারা যে আচরণ করে তাদের এই চ্যাম্পিয়নশিপকে যথেষ্ট খাটো করেছে এবং ভারতীয় ক্রিকেটের ঐতিহ্যকে কলঙ্কিত করেছে। এর সবই হয়েছে ক্রীড়ামোদী নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে।

  • সালেহ উদ্দিন আহমদ লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

ই-মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব