বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের একটি সম্ভাব্য রূপরেখা
বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য ১৯৭১ শুধু বন্ধুত্ব বা সহযোগিতার ইতিহাস নয়, এটি তার চেয়ে অনেক বেশি কিছু। কিন্তু কোনো সম্পর্কই চিরদিন একই রকম থাকতে পারে না। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন হাসান ফেরদৌস। আজ প্রকাশিত হলো শেষ পর্ব
মুক্তিযুদ্ধের সাড়ে পাঁচ দশক পরে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্ক এখন সেই রকম এক সংকটসীমায় দাঁড়িয়ে, যাকে জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান একসময় ‘ফর্ক ইন দ্য রোড’ বলেছিলেন। এই কাঁটাচামচের একদিকে এগোলে মিলতে পারে বন্ধুত্ব ও সহযোগিতা। অন্য পথে গেলে দেখা দেবে অনিবার্য সংঘাত। কোন পথে তারা এগোবে, এই সিদ্ধান্ত শুধু ভারতকে নয়, বাংলাদেশকেও নিতে হবে।
সমসার্বভৌমত্বের প্রশ্ন
শুরুতে একটা বাস্তবতা স্বীকার করা যাক। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে যে অসম সম্পর্ক তার একটি বোধগম্য কারণ রয়েছে। ভারত দক্ষিণ এশিয়ার শুধু বৃহত্তম দেশই নয়, সে একটি আঞ্চলিক পরাশক্তি। তাদের দুজনের শক্তির ও ক্ষমতার তুলনা অযৌক্তিক। কিন্তু দুটি সার্বভৌম দেশের তুলনা তাদের শক্তি ও ক্ষমতার নিক্তিতে ওজন করা যাবে না। তারা উভয়েই সার্বভৌম, আন্তর্জাতিক আইনের চোখে উভয়েই সমান অধিকার ও মর্যাদার দাবিদার। ঠিক এই কারণে জাতিসংঘে ভারত ও বাংলাদেশের উভয়েরই রয়েছে একটি ভোট। অথচ বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব থেকে এমন ধারণা জন্মে যে নিজের ওজন ও গুরুত্ব অনুসারে তারা বাংলাদেশের কাছ থেকে অধিক সম্মান (ডেফেরেন্স) আশা করে।
খ্যাতনামা মার্কিন তাত্ত্বিক স্টেফান পি কোহেন উপমহাদেশ নিয়ে কাজ করেছেন দীর্ঘকাল। এই অঞ্চলে ভারতের অবস্থান বিচার করে তিনি লিখেছেন, এই বৃহৎ দক্ষিণ এশীয় দেশটি তার ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিশেষ সম্মান আশা করে। ২০০১ সালে প্রকাশিত ইন্ডিয়া: ইমারজিং পাওয়ার গ্রন্থে কোহেন মন্তব্য করেন, ভারত ক্রমান্বয়ে একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তিতে পরিণত হচ্ছে, এটা বাস্তবতা, কিন্তু এই বাস্তবতার ভিত্তিতে যদি ভারত তার সার্বভৌম ক্ষুদ্রতর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে ‘ডেফেরেন্স’ আশা করে, তাহলে আজ হোক অথবা কাল, তাদের মধ্যে উষ্মা ও প্রত্যাখ্যান জন্মাবেই। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ঠিক সেটাই ঘটেছে।
কাঠামোগত অসাম্য
শেখ হাসিনার ১৫ বছরের শাসনকালে ভারত ক্ষুদ্রতর ও কাঠামোগতভাবে অসম বাংলাদেশের কাছ থেকে বাণিজ্য, পরিবহন, সীমান্ত নিরাপত্তা ও বিদ্যুৎ বিপণনের মতো বিভিন্ন খাতে বাড়তি সুযোগ আদায় করে নিয়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। খোদ ভারতীয়রাই সে কথা স্বীকার করে। সবচেয়ে বড় উদাহরণ পানিবণ্টন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান। ফারাক্কা বাঁধ ও তিস্তা নদীর কথা সুপরিচিত। বারবার দেনদরবার সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত তিস্তার পানিবণ্টন প্রশ্নে কোনো চুক্তি হয়নি। বিষয়টি এতটাই বিসদৃশ্য যে সাবেক ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাওকে স্বীকার করতে হয় তিস্তা প্রসঙ্গটি ভারতের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।
অন্য বড় দৃষ্টিগ্রাহ্য বিষয় অসাম্য বাণিজ্যঘাটতি। বাংলাদেশে ভারতের বার্ষিক রপ্তানির পরিমাণ প্রায় ১৬ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে ভারতে বাংলাদেশের রপ্তানি মেরেকেটে দেড় বিলিয়ন ডলার। সন্দেহ নেই, বৃহৎ অর্থনীতি হওয়ায় ভারতের বাণিজ্যিক সুবিধাজনক অবস্থান রয়েছে। কিন্তু এ কথাও অস্বীকার করা যাবে না ভারত যেভাবে বাংলাদেশ থেকে আমদানির ব্যাপারে একের পর এক অশুল্ক বা নন-ট্যারিফ বাধা তৈরি করে রেখেছে (যেমন শুল্ক নির্ধারণে বিলম্ব, অনির্ধারিত মান নিয়ন্ত্রণ পরীক্ষা, বন্দর নিয়ন্ত্রণ), তাও এই অসমতার একটি কারণ।
প্রয়োজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন
অবস্থা পরিবর্তনের জন্য কম করে হলেও যা প্রয়োজন তা হলো প্রতিবেশীর প্রতি ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন। নিজের পছন্দের নেতাদের ওপর নির্ভরতা নয়, দেশের মানুষের প্রতি আস্থা রাখা হবে এই দৃষ্টিভঙ্গির সঠিক প্রকাশ। বস্তুত রাজনৈতিক নেতৃত্ব নির্ধারণে নাক না গলিয়ে ভারত যদি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি অধিক শ্রদ্ধাশীল হয়, তাতে ভারতেরও লাভ। সে ‘ক্লায়েন্টের’ বদলে একটি গণতান্ত্রিক অংশীদার লাভ করবে। এর জন্য ভারতের নীতিনির্ধারণে চাই একধরনের কৌশলগত বিনয়, যা এখনো তাদের আচরণে অনুপস্থিত।
২০২১ সালে এক ভাষণে ভারতীয় ভাষ্যকার বিনোদ খোসলা বলেছিলেন, ভারত প্রতিবেশীদের প্রতি অতি আত্মবিশ্বাসী, কখনো কখনো উদ্ধত। এর ফল সব সময় ভালো হয় না, তার এক প্রমাণ আজকের বাংলাদেশ। খোসলা মন্তব্য করেছেন, ‘লেকচার’ দেওয়ার বদলে ভারত যদি তার এই ক্ষুদ্র প্রতিবেশীর প্রতি সম্মান প্রদর্শনে সক্ষম হয়, তাহলে সেটা উভয়ের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।
বাংলাদেশে ভারতবিরোধিতা
বাংলাদেশে ভারতের প্রতি যে বিরূপ মনোভাব রয়েছে, এটা কোনো গোপন কথা নয়। এর পেছনে শুধু প্রতিবেশীর ‘হেজিমনিক’ আচরণ নয়, একাধিক পরস্পর সম্পর্কিত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কারণও রয়েছে। বস্তুত বাংলাদেশে ভারতবিরোধী মনোভাব সাময়িক নয়—এটি গাঠনিক। এই বাস্তবতা বদলাতে নতুন যে ‘ন্যারেটিভ’–এর প্রয়োজন, তাতে একাত্তরের জন্য কৃতজ্ঞতা দাবির বদলে বাংলাদেশকে একটি যথার্থ অংশীদার হিসেবে হাজির করতে হবে ভারতকে। সঙ্গে সঙ্গে যে জটিল ও বহুমাত্রিক সমস্যাগুলো রয়েছে, যেমন পানিবণ্টন, বাণিজ্য অসাম্য, কানেকটিভিটি, স্থল পরিবহন ও সীমান্ত বিরোধ—তা সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ। এ জন্য প্রথম পদক্ষেপটি ভারতকেই ফেলতে হবে।
‘রিসেট বাটন’
ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের বিশেষজ্ঞ তানভি মাদানি লিখেছেন, চলতি অবিশ্বাস দূর করতে ভারতকে এ কথা প্রমাণ করতে হবে যে বাংলাদেশ তার জন্য শুধু ‘একটি করিডর বা নিরাপত্তাবেষ্টনী (সিকিউরিটি বাফার) নয়, তার নিজস্ব অগ্রাধিকারভিত্তিক একটি অংশীদার’। ২০২৪-এর গণ–অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশ গঠনগতভাবে বদলে গেছে, এই কথাটাও ভারতকে মানতে হবে। ভারতীয় ভাষ্যকার সঞ্জয় কাপুর (হার্ডনিউজ–এর সম্পাদক) বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের চলতি ব্যর্থতা কোথায় তা উল্লেখ করে লিখেছেন, দিল্লি আসলে বুঝতেই পারেনি হাসিনাকে যেকোনো শর্তে টিকিয়ে রাখার চেষ্টার ফলে সে দেশে ‘এক বিস্ফোরণের জন্ম হয়েছে’। আরও স্পষ্টভাবে লিখেছেন ভারতের সাবেক নির্বাচন কমিশনার এস ওয়াই কুরাইশি। তাঁর মতে, হাসিনার সময় নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে, এ তো কোনো গোপন কথা নয়। সে কথা স্বীকার করার বদলে হাসিনাকে অনবরত আগলে রাখার নীতি অনুসরণ করে ভারত আসলে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা (ক্রেডিবিলিটি) হারিয়েছে।
ভারতে এমন অনেকে রয়েছেন, যাঁরা এখনো মনে করেন শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কলকাতায় ও দিল্লিতে বহিষ্কৃত আওয়ামী নেতাদের যে প্রকাশ্যে রাজনীতি করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তা বোধ করি এই ভাবনাপ্রসূত একটি প্রকল্পের অংশ। এই প্রকল্প পরিত্যাগ করলে সম্পর্ক পুনর্নির্মাণে সহায়ক হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। হাসিনাকে ফিরিয়ে দেওয়া একটি বড় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, চলতি বাস্তবতা তেমন প্রত্যর্পণে সহায়ক নয়। তবে ভারত নিদেনপক্ষে যা করতে পারে তা হলো ভারতের মাটিতে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক তৎপরতায় রাশ টেনে ধরা। আরও ভালো হয় অভিযুক্ত ও বিচারের মুখোমুখি দ্বিতীয় বা তৃতীয় সারির আওয়ামী নেতাদের ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়া। বস্তুত এটি হবে একটি প্রকৃত ‘রিসেট বাটন’।
সোজাকথায়, দুই দেশের সম্পর্কের বর্তমান গতিধারা বদলাতে হলে প্রথম ইটটি ভারতকেই গাঁথতে হবে। চলতি গাঠনিক অসাম্য বদলাতে তাকে একদিকে বাংলাদেশের সঙ্গে আস্থা পুনর্নির্মাণ করতে হবে এবং যথাযথ স্থানে অর্থপূর্ণ ছাড় দিতে হবে (যেমন পানিবণ্টন, বাণিজ্য সমতা, সীমান্ত নিরাপত্তা)। আগামী বছরের গোড়ার দিকে বাংলাদেশে একটি অর্থপূর্ণ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠিত হলে এই দুই প্রতিবেশীর মধ্যে চলতি দূরত্ব কমিয়ে আনা সহজ হবে, একাধিক ভারতীয় বিশেষজ্ঞ তেমন সম্ভাবনায় বিশ্বাসী।
তাঁদের একজন জিন্দাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অঙ্কিতা দত্ত। ঢাকার ডেইলি স্টার পত্রিকার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, নির্বাচন হয়ে গেলেই দেখবেন অবস্থা বদলে গেছে, দুই দেশের সম্পর্ক নতুন করে সাজানো সম্ভব হবে। অধ্যাপক দত্ত মনে করেন, এত দিন উভয় দেশই জোর দিয়েছে, এটা আমি চাই, এটা আমি চাই না। কিন্তু উভয়েই যদি পারস্পরিক চাহিদা মাথায় রেখে এগোতে চায়, অবস্থা বদলাতে বাধ্য। এটাই হবে প্রকৃত রিসেট—হাসিনানির্ভরতা নয়, প্রতিষ্ঠাননির্ভর সম্পর্ক।
মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা
এ ক্ষেত্রে একা ভারত নয়, বাংলাদেশকেও উদ্যোগী হতে হবে। ভারতবিরোধিতা যদি একটি লাভজনক রাজনৈতিক তাসে পরিণত হয়, যার নানা লক্ষণ বাংলাদেশে প্রকট হয়ে উঠছে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি অর্থে ধাক্কা খাবে। বাংলাদেশে সরকারের ভেতরে ও বাইরে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ভারতবিরোধিতাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে আগ্রহী।
অধ্যাপক ইউনূস নিজেও মাঝেমধ্যে এমন কথা বলেছেন, যা ভারতের চোখে, সম্পর্ক উন্নয়নে সহায়ক নয়। তথাকথিত ‘চিকেন নেক’ নিয়ে তাঁর মন্তব্য ও বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের একমাত্র ‘অভিভাবক’ দাবি ভারতীয় অস্বস্তি বাড়িয়ে দিয়েছে। একজন উপদেষ্টা ভারতীয় সীমানা অন্তর্ভুক্ত করে বাংলাদেশের একটি মানচিত্র তাঁর ফেসবুকে পোস্ট করেছিলেন (পরে তা তিনি সরিয়ে নেন)। সেটিও উত্তাপ প্রশমনে সহায়ক নয়। ঘন ঘন পাকিস্তানি সেনা কর্তাদের ঢাকা সফর ও তাঁদের উষ্ণ সংবর্ধনাও ভারতের চোখ এড়িয়ে যায়নি।
ভারতের কাছে এই মুহূর্তে অন্তত দুটি আশু উদ্বেগ রয়েছে—এক, বাংলাদেশের মৌলবাদী রাজনীতির পুনরুত্থান; এবং দুই, মাথাচাড়া দেওয়া সাম্প্রদায়িকতা। ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এখন বাংলাদেশে একটি দৈনন্দিন বাস্তবতা, তাকে অস্বীকার করা অসম্ভব। কেউ কেউ (যেমন কার্নেগি এন্ডাউমেন্টের মিলান বৈষ্ণব) বলেছেন, বাংলাদেশে মৌলবাদের উত্থানের সঙ্গে ভারতে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উত্থান সম্পর্কিত। তারা একে অপরের পুষ্টি জোগায়।
বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোকে মূলধারার বাইরে রাখার, তাকে ‘সাইডলাইন’ করার নানা চেষ্টা হয়েছে, এমনকি শাসনতান্ত্রিক ধারাও সংযুক্ত করা হয়েছে। এতে ধর্মীয় রাজনীতিকে বাইরে তো রাখা যায়ইনি, বরং তার কল্পিত শুদ্ধতার ধূর্ত প্রচারের ফলে সে রাজনীতি আরও জেঁকে বসেছে। এখন এটি একটা বাস্তবতা, তাকে মেনে নিয়েই বাংলাদেশের ‘নতুন বন্দোবস্তে’ ধর্মীয় রাজনৈতিক দলগুলোকে বৈধতা দেওয়া হয়েছে। এটি ভুল, ঢালাওভাবে সে কথা বলা যায়, কিন্তু বাস্তবে সেই কথার প্রমাণ মেলে না। এ কথা ভাবা যেতে পারে যে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির বৈধতার ফলে এসব রাজনৈতিক দলের কার্যাবলি যেমন অধিক নাগরিক নজরদারিতে পড়বে, তেমনি এই দলগুলোকে জবাবদিহির মুখোমুখি করা সম্ভব হবে।
ভারতবিরোধিতা যদি একটি লাভজনক রাজনৈতিক তাসে পরিণত হয়, যার নানা লক্ষণ বাংলাদেশে প্রকট হয়ে উঠছে, তাহলে দুই দেশের সম্পর্ক দীর্ঘমেয়াদি অর্থে ধাক্কা খাবে। বাংলাদেশে সরকারের ভেতরে ও বাইরে এমন অনেকে আছেন, যাঁরা ভারতবিরোধিতাকে রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাতে আগ্রহী।
সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারটি অধিক জটিল। তার অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনে বাংলাদেশে হিন্দু নির্যাতনকে ভারত উপেক্ষা করতে পারে না; আবার বাংলাদেশও ভারতের হাতে এই ইস্যুটিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে দিতে পারে না। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা বাংলাদেশের নাগরিক। ফলে ভারতীয় সমালোচনার জবাবে নয়, নিজের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকেই সংখ্যালঘুর অধিকার সংরক্ষণে বাংলাদেশকে উদ্যোগী হতে হবে। এ কথা অস্বীকার করা যায় না, সব দুর্বল জনগোষ্ঠীর মতো বাংলাদেশেও সংখ্যালঘুরা বৈষম্য ও নির্যাতনের শিকার। নিজের কার্যাবলি ও ঘোষিত নীতিমালার বাস্তবায়নের মাধ্যমে সরকারের পক্ষে সংখ্যালঘুদের মনে আস্থা নির্মাণ সম্ভব।
নিকট প্রতিবেশী, নিকট বন্ধু
কথায় বলে, আমরা নিজেদের বন্ধু বাছাই করতে পারি, কিন্তু প্রতিবেশী বাছাই করতে পারি না। এ কথা বুঝতে রকেট বিজ্ঞানী হতে হয় না যে বাংলাদেশ ও ভারত উভয়ের একে অপরের প্রয়োজন রয়েছে। চার হাজার কিলোমিটারের সীমান্ত তাদের মধ্যে ভেদচিহ্ন লিখে দিলেও তাদের রয়েছে হাজার বছরের অভিন্ন ইতিহাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। সবচেয়ে বড় কথা, উভয়ের রয়েছে একাত্তরের সম্মিলিত স্মৃতি ও অর্জন। চাইলেই এর কোনোটাই মোছা যাবে না।
এই দুই দেশের বিদ্যমান কাঠামোগত বৈষম্যকে সামলাতে আবেগ নয়, প্রয়োজন বাস্তবসম্মত উদ্যোগ। স্থিতিশীল সম্পর্ক গড়ে ওঠে পূর্বানুমানযোগ্য প্রতিষ্ঠানভিত্তিক ব্যবস্থার ওপর—ব্যক্তিগত রসায়ন বা ঐতিহাসিক স্মৃতির ওপর নয়। বাংলাদেশের প্রয়োজন এমন সব প্রক্রিয়া, যা তার সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণকে সুরক্ষিত রাখবে—স্বচ্ছ পানিবণ্টন চুক্তি, নিয়মভিত্তিক ট্রানজিট প্রটোকল এবং ন্যায্য বাণিজ্যিক প্রবেশাধিকার তার অন্তর্গত। ভারতেরও দরকার এমন ব্যবস্থা, যা তাকে নিরাপত্তা ও সংযোগে আশ্বস্ত করবে।
একাত্তর, জন্মমুহূর্তের সাক্ষী
বাংলাদেশ ও ভারতের জন্য ১৯৭১ শুধু ইতিহাস নয়—এটি তাদের রক্তের বন্ধন, জন্মমুহূর্তের সাক্ষী। কিন্তু কোনো সম্পর্কই তার জন্মকথায় বন্দী হয়ে থাকতে পারে না। আধা শতাব্দী পেরিয়ে গেছে; বাস্তবতা বদলেছে, প্রজন্ম বদলেছে, স্বার্থও বদলেছে। বাংলাদেশ চায় তার ভবিষ্যৎ নিজের সার্বভৌম সিদ্ধান্তে গড়ে তুলতে— চিরকৃতজ্ঞতার শিকলে নয়। ভারতও চায় স্থিতি, কিন্তু সেই স্থিতি আর নস্টালজিয়ায় ধরে রাখা যাবে না; লাগবে পারস্পরিক সম্মান ও ন্যায্যতা। ১৯৭১-কে সম্মান জানানো মানে তাকে রাজনৈতিক অস্ত্র বানানো নয়, বরং তার মূল শিক্ষা—সার্বভৌমত্ব, মর্যাদা ও ন্যায় রক্ষা করা।
দুই দেশ যদি সত্যিই সেই উত্তরাধিকারকে মূল্য দেয়, তবে তাদের অতীতের গৌরব নয়, ভবিষ্যতের প্রয়োজন সামনে রেখে সম্পর্ক পুনর্গঠন করতে হবে। অতীত আমাদের এক করেছে—কিন্তু ভবিষ্যৎ গড়তে হলে সমতার ভিত্তিতে নতুন আস্থা গড়া এখনই সবচেয়ে জরুরি।
হাসান ফেরদৌস সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব