বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়া পরিবারের আবির্ভাব বিভিন্ন নাটকীয় ঘটনার মধ্য দিয়ে। এর শুরু হয় ’৭৫-পরবর্তী সংকট মোকাবিলায় জিয়াউর রহমানের ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের আবির্ভাবের মাধ্যমে। বিশেষ করে দেশ পুনর্গঠন এবং দেশের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে একটি বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সব জনগোষ্ঠীকে একটি জাতীয় আকাঙ্ক্ষার পতাকাতলে নিয়ে এসে একটি সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন তিনি দেশের মানুষকে দেখাতে পেরেছিলেন।
জিয়াউর রহমানের নেতৃত্বে সাহসিকতা এবং জেমস বার্নসের রূপান্তরমূলক নেতৃত্বের ধারণার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল, যা জিয়াউর রহমানকে একজন ক্যারিশম্যাটিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে। দেশকে এগিয়ে নেওয়ার সুযোগ পেলেও তাঁকে হত্যার মধ্য দিয়ে সেই নেতৃত্ব থেকে বঞ্চিত হয় আমাদের দেশ। বাংলাদেশ আবারও একটি রাজনৈতিক নেতৃত্বের সংকটের মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে সেই সময়ের নেতৃত্বের সংকট মোকাবিলায় বেগম খালেদা জিয়াকে গৃহবধূর তকমা কাটিয়ে একরকম বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে আসতে হয়। যখন মনে করা হচ্ছিল বিএনপির রাজনীতি শুরু না হতেই শেষ হয়ে যাচ্ছে, ঠিক তেমন একটি ক্রান্তিলগ্নে খালেদা জিয়া এই দলটির হাল ধরেন।
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশের নারীশিক্ষায় যে গণজাগরণ, তার স্বীকৃতি বেগম খালেদা জিয়াকে দিতেই হবে। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে স্কলারশিপ বা বৃত্তি চালু করেন বিশেষ করে গ্রামীণ মেয়েদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেন, যা আমাদের নারীশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পরবর্তী সময়ে।
তবে খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আবির্ভাব হওয়াটা খুব সুখকর বিষয় ছিল না এবং একজন দক্ষ নেতা হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে তাঁকে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। একটি সংকটের সময়ে তিনি বিএনপির হাল ধরেন এবং ধীরে ধীরে তিনি নিজেকে শুধু বিএনপির নয়, বরং বাংলাদেশের তৎকালীন রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি প্রভাবশালী এবং গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন এবং একজন ক্যাশিম্যাটিক নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
১৯৮৩ সালে খালেদা জিয়া বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারপারসন নির্বাচিত হন এবং এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি সক্রিয় নেতৃত্বে আসেন। রাজপথের আন্দোলন, বিবৃতি, গ্রেপ্তার—সব মিলিয়ে তিনি জাতীয় রাজনীতির দৃশ্যমান মুখে পরিণত হন।
এরশাদবিরোধী বা স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে খালেদা জিয়ার যে আপসহীন ভূমিকা, সেই ভূমিকায় তাঁকে বাংলাদেশের একজন অন্যতম রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, যখন আশির দশকে বিশেষ করে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন তুঙ্গে, ঠিক সেই সময় ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দৃঢ় নেতৃত্বের কারণে সেই নির্বাচন বর্জন সেই সময়ের পটভূমিতে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হিসেবে দেখা হয়। যা পরবর্তীকালে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে আরও বেগবান করে কেননা সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত ছিল সেই স্বৈরাচারী ব্যবস্থার বৈধতাকে সরাসরি প্রশ্ন করা এবং তাঁকে খারিজ করে দেওয়া। সেই সাহসী ভূমিকাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাঁকে পরিণত করে একজন আপসহীন নেতা হিসেবে, যার আপসহীনতার আরও উদাহরণ আমরা পরে দেখেছি।
একজন গৃহবধূ থেকে কী করে তিনি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছেন, তা হয়তো একটা সময় বাংলাদেশের রাজনীতির আলোচনায় জোরালোভাবে রয়ে যাবে বা রাজনীতিবিজ্ঞানের গবেষণার বিষয় হবে। তাই হয়তো বেগম খালেদা জিয়ার রাজনীতিতে আসার বিষয়টা অনেকটা রূপকথার গল্পের মতোই মনে হয়।
বাংলাদেশের ইতিহাসে যতবার আমরা একটি ক্রান্তিকাল পার করছিলাম, বিশেষ করে স্বৈরাচারী শাসনের কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য, ঠিক সেই সময়গুলোতেই বিএনপি সামনে আসে তাঁর নেতৃত্ব নিয়ে আর সেখানে খালেদা জিয়ার অবদান ছিল সর্বাগ্রে।
’৯০–এর গণ–অভ্যুত্থানের সময় ও পরে আমরা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দেশ পুনর্গঠনের প্রচেষ্টা দেখতে পাই এবং দেশের জনগণ তাঁর প্রতি আস্থা রাখে। বাংলাদেশের স্বল্প সময়ের গণতান্ত্রিক যাত্রার পর আমাদের দেখতে হয় ১/১১-এর ঘটনাবলি, যা দেশের গণতান্ত্রিক ধারায় একটি বড় বিচ্যুতি ও মোড়বদলের মুহূর্ত হিসেবে বিবেচিত। সেই সরকারের সময় তাঁর দুই সন্তান তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানের ওপর অমানুষিক নির্যাতন হওয়ার পরও তিনি এই দেশের মাটি ছেড়ে যাননি। পরে তাঁর ছোট সন্তান আরাফাত রহমানের মৃত্যুও তাঁকে দেশ ছেড়ে যেতে টলাতে পারেনি।
এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে খালেদা জিয়ার দৃঢ় অবস্থান এবং ২০০৭ সাল থেকে পরবর্তী প্রায় দেড় দশকজুড়ে খালেদা জিয়ার যে আপসহীন অবস্থান, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান হিসেবে একসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে দেখা হবে।
আমরা যদি বাংলাদেশের রাজনীতিতে বেগম খালেদা জিয়ার অবদানকে মূল্যায়ন করতে চাই তাহলে যে বিষয়গুলো সামনে আসে, তা হলো সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা অর্থাৎ এরশাদবিরোধী আন্দোলনের পর ১৯৯১ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন এবং সংবিধানের ১২তম সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসন থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন ঘটানো।
দ্বিতীয় বিষয় হলো, বহুদলীয় রাজনীতির পুনরুজ্জীবন, অর্থাৎ সামরিক শাসন-পরবর্তী সময়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক পুনর্গঠন, সংসদীয় বিতর্ক ও বিরোধী রাজনীতির জায়গা তৈরি করতে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। বলা যায়, বাংলাদেশ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বেই মূলত একটি সত্যিকার গণতান্ত্রিক একটি ধারা প্রচলনে মৌলিক ভূমিকা পালন করেন।
তাঁর অন্যান্য অনেক অবদানের মধ্যে তৃতীয় যে বিষয়টি এখানে নিয়ে আসা জরুরি, সেটি হলো বাংলাদেশের নারীশিক্ষায় তাঁর অসামান্য অবদান।
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে বাংলাদেশের নারীশিক্ষায় যে গণজাগরণ, তার স্বীকৃতি বেগম খালেদা জিয়াকে দিতেই হবে। তিনি মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষায় মেয়েদের অংশগ্রহণ বাড়াতে স্কলারশিপ বা বৃত্তি চালু করেন বিশেষ করে গ্রামীণ মেয়েদের জন্য অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেন, যা আমাদের নারীশিক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন পরবর্তী সময়ে।
চতুর্থত, খালেদা জিয়াকে দেখা হয় বাংলাদেশের নারী নেতৃত্বের একটি প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের সম্ভাবনাকে দৃশ্যমান করেন—যা দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও তাৎপর্যপূর্ণ।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে আমাদের যখন জাতি হিসেবে একতাবদ্ধ থাকার কথা ছিল, সেই সময় আমরা নানাভাবে বিভাজিত একটি সময় পার করছি। যখন আমরা ধারণা করছিলাম খালেদা জিয়া তাঁর সর্বজনগ্রাহ্য নেতৃত্ব দিয়ে আমাদের একটি ঐক্যে নিয়ে আসবে সেই সময়টাতে তিনি চলে গেলেন অসীমের ডাকে।
যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য খালেদা জিয়া তাঁর জীবনের একটি বড় অংশ আন্দোলন এবং সংগ্রাম করে পার করেছেন, জুলাই গণ–অভ্যুত্থানের পরবর্তী সময়ে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার পুনরুদ্ধারে তাঁর সেই সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ পরবর্তী প্রজন্মকে আলোর পথ দেখাবে বলে আমরা প্রত্যাশা করতে পারি।
এমন একজন বরেণ্য রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের প্রস্থান আমাদের দেশের জন্য একটি অপূরণীয় ক্ষতি যে দিনটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি বেদনাময় দিন হিসেবে রয়ে যাবে। বেগম খালেদা জিয়ার চলে যাওয়া শুধু একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিদায় নয়—এর মধ্য দিয়ে একটি সংগ্রাম ও একটি রাজনৈতিক প্রজন্মের অবসান।
সামরিক শাসনের অন্ধকার অধ্যায় থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রের পথে দেশকে ফিরিয়ে আনার লড়াই, বিগত প্রায় দেড় দশকের বিরামহীন রাজনৈতিক চাপ, কারাবরণ, অসুস্থতা—সবকিছুর মধ্যেও তিনি ছিলেন অনমনীয়, দৃঢ়, আত্মমর্যাদাশীল ও আপসহীন।
বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের একটি অসামান্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন—যা বাংলাদেশ তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতেও তাৎপর্যপূর্ণ। বিগত দশকজুড়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে তাঁর যে আত্মত্যাগ, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
বাংলাদেশের ইতিহাস তাঁকে মনে রাখবে এক সাহসী ও আপসহীন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে। এই শোক শুধু একটি দলের নয়, এই শোক রাষ্ট্রের, এই শোক আমাদের এক দীর্ঘ রাজনৈতিক অধ্যায়ের।
বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব
