রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা থেকে মুক্তির উপায় কী

এমন একটি বছর যাচ্ছে, যখন কিনা বিশ্বের বড় বড় গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হচ্ছে এবং সে দেশগুলোতে জনসাধারণ যারপরনাই রাজনৈতিক বিভাজনে ভুগছে। সেখানকার জনসাধারণ পরস্পর শত্রুভাবাপন্ন হয়ে উঠছে।

২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রে ‘রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা’ শীর্ষক একটি গবেষণায় হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছিল, ‘বিভাজন, বিদ্বেষ ও মগজধোলাইয়ের বিষাক্ত পঁাচন’ সমষ্টিগত চেতনা ও পারস্পরিক সহাবস্থানের নাগরিক মানসিকতাকে শেষ করে দিচ্ছে এবং এটি সরকারের কর্মক্ষমতা নিষ্ক্রিয় হওয়ার পেছনে কাজ করেছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান এডেলম্যান ট্রাস্ট ব্যারোমিটারের ২০২৩ সালের নথিতে আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, স্পেন, সুইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে এ ধরনের প্রবণতা দেখা গেছে। ওই প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষায় দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্রে একসময় ভোটারদের পছন্দের দলের সদস্যদের প্রতি সাধারণ পক্ষপাত ছিল। বিরোধী শিবিরের প্রতি তাদের নিরপেক্ষতার বোধ ছিল। কিন্তু এখন তারা তাদের প্রতিপক্ষকে ভয় এবং ঘৃণা করে।

পতনশীল অর্থনীতি মেরুকরণের ধারাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। কারণ, অর্থনৈতিক পতনে মানুষ অধিকতর ঝুঁকিবিমুখ হয়ে ওঠে; মন্দা দেখলে তারা তাদের ‘নিজেদের গোষ্ঠী’র দিকে বেশি মনোযোগী হয় এবং ‘বাইরের গোষ্ঠীর’ সঙ্গে কাজ করতে কম ইচ্ছুক হয়।

শুধু তা–ই নয়, আমেরিকানরা এখন ভিন্ন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিশ্বাসী লোকের সঙ্গে প্রেম, বিয়ে, এমনকি পাশাপাশি বসবাসেরও বিরোধী হয়ে উঠছে। কর্মক্ষেত্রে রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে বৈষম্য করার আশঙ্কাও বেড়ে গেছে। একইভাবে তুরস্কে প্রতি দশজনের মধ্যে প্রায় আটজনই চান না তঁাদের মেয়ে এমন কাউকে বিয়ে করুক, যে তাদের সবচেয়ে অপছন্দের দলকে ভোট দিয়ে থাকে।

আশ্চর্যজনকভাবে, মার্কিন সমীক্ষায় দেখা যাচ্ছে, রাজনৈতিক অভিযোজন এখন এতটাই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে যে লোকেরা তাঁদের দলের সঙ্গে একাত্ম হতে নিজের ধর্ম, শ্রেণি এমনকি যৌন আচরণ পর্যন্ত পরিবর্তন করতে চাইছেন।

এডেলম্যান জরিপের ফল বিশেষভাবে উদ্বেগজনক। তারা বলেছে, ২৮টি দেশের ৩২ হাজার উত্তরদাতার মাত্র ২০ শতাংশ উত্তরদাতা তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সহমত পোষণ করেন না, এমন লোকের সঙ্গে কাজ করতে কিংবা প্রতিবেশী হিসেবে বসবাস করতে রাজি আছেন। ৩২ হাজার উত্তরদাতার মাত্র ৩০ শতাংশ লোক বিরুদ্ধ মতের লোকের বিপদে সাহায্য করতে রাজি আছেন।

আরও পড়ুন

যথার্থ গণতন্ত্রে ভিন্ন ভিন্ন মত-পথের মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা ও ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে আন্তরিক যোগাযোগ থাকা অনস্বীকার্য। সেই নিরিখে বলা যায়, রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা এবং বিরোধী শিবিরের সমর্থকদের চরিত্রহনন গণতন্ত্রের সঙ্গে বেমানান।

ভিন্ন মত-পথের মানুষের পারস্পরিক সহযোগিতা এবং ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে যোগাযোগ নষ্ট হয়ে গেলে মানুষ তার প্রতিপক্ষের সঙ্গে নিজের মিল খুঁজে পাবে না। এই প্রবণতা থেকে সরে আসার একটি সূচনাবিন্দু তৈরি করতে ভোটারকে আরও অর্থপূর্ণ উপায়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া যেতে পারে।

উদাহরণ হিসেবে ‘র‍্যাংকড চয়েস’ ভোটিং পদ্ধতি অনুসরণ করা যেতে পারে। (এই পদ্ধতিতে ভোটাররা প্রার্থীদের সরাসরি ভোট দিয়ে অনুমোদন কিংবা ভোট না দিয়ে প্রত্যাখ্যান করেন না। তাঁরা ১, ২, ৩—এ ধরনের র‍্যাঙ্কিং ঘরে টিক দিয়ে প্রার্থীর যোগ্যতা কোন শ্রেণির সে বিষয়ে রায় দেন।) এতে রাজনীতিকেরা ভোটারদের সম্পর্কে ‘হয় আমার দলের নয় অন্যের দলের’ গোছের সিদ্ধান্ত নেন না এবং আত্মোন্নয়নে সচেষ্ট হন।

যাঁদের অবস্থা নাজুক, তাঁদের সামাজিক নিরাপত্তা, কর ও স্বাস্থ্যনীতি ইত্যাদির মাধ্যমে আর্থিক সুবিধা বাড়ানোও জরুরি। পরবর্তী পাঁচ বছর নিজের পরিবার নিয়ে স্বচ্ছন্দে চলা যাবে—এমনটা মনে করা লোকের সংখ্যা রেকর্ড পরিমাণে কমে গেছে।

পতনশীল অর্থনীতি মেরুকরণের ধারাকে আরও খারাপ করে তুলতে পারে। কারণ, অর্থনৈতিক পতনে মানুষ অধিকতর ঝুঁকিবিমুখ হয়ে ওঠে; মন্দা দেখলে তারা তাদের ‘নিজেদের গোষ্ঠী’র দিকে বেশি মনোযোগী হয় এবং ‘বাইরের গোষ্ঠীর’ সঙ্গে কাজ করতে কম ইচ্ছুক হয়।

গবেষণায় দেখা গেছে, মেরুকরণ কমাতে রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রাজনীতিবিদরা অনেক সময় তাঁদের প্রতিপক্ষকে (এবং প্রতিপক্ষের সমর্থকদেরও) জনগণের শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে মেরুকরণে ইন্ধন জোগান। ফলস্বরূপ, গণতান্ত্রিক বৈধতার ভিত্তি নষ্ট হয়। রাজনীতিবিদেরা বিরোধী দলের সদস্যদের সঙ্গে উষ্ণ আচরণ করলে তা দেখে লোকেরা কম বিভক্ত হন।

এনগায়ার উডস অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লাভাটনিক স্কুল অব গভর্নমেন্টের ডিন

স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্ত অনুবাদ