নারীর উপস্থিতি অদৃশ্যমান হয়ে যাচ্ছে কেন

কিছুদিন ধরেই ভাবছিলাম, জুলাই আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নারীর অদৃশ্যমান হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে লিখব। এই ভাবনা সুদৃঢ় হলো এবারের বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা দেখে।

পুরস্কারপ্রাপ্তদের তালিকায় কোনো নারীর নাম নাই। কোনো নারীর পুরস্কারের জন্য মনোনীত না হওয়ার বিষয়টিকে মোটেই অনিচ্ছাকৃত কিংবা কাকতালীয় বিষয় বলে মনে হয়নি আমার।

বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার প্রস্তাবক কমিটির প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার কমিটির সিদ্ধান্তে, একাডেমির নির্বাহী পরিষদ এই পুরস্কারপ্রাপ্তদের নাম অনুমোদন করে।

প্রশ্ন হলো, এই যে প্রস্তাবক কমিটি, পুরস্কার কমিটি এবং একাডেমির নির্বাহী পরিষদ, তাঁদের মধ্যে কেউই কি বিষয়টি লক্ষ করেননি; নাকি ১০ ক্যাটাগরির একটিতেও মনোনয়ন দেওয়ার মতো যোগ্য কোনো নারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি? নির্ধারিত ক্যাটাগরিগুলোর অন্তত কয়েকটিতে মনোনয়ন দেওয়ার মতো যোগ্য নারীর কি এতই অভাব এই দেশে?

অনেকেই হয়তো আমার সঙ্গে একমত হবেন যে আজকাল সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান কিংবা আয়োজনে ব্যাপকভাবে কমে গেছে নারীর উপস্থিতি। আমার এই পর্যবেক্ষণটি সাধারণ অংশগ্রহণকারী এবং সামনের সারি অর্থাৎ আমরা যাকে হেড টেবিল বলি, উভয় ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তো বটেই, টেলিভিশনের পর্দাতেও পরিবর্তনটি দিন দিন প্রকট হয়ে উঠছে। সন্ধ্যা কিংবা রাতের খবরে সারা দেশের যে চালচিত্র প্রতিফলিত হয়, সেখানে নারীর দৃশ্যমান উপস্থিতি কোথায়?

সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবি থেকে সৃষ্ট বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে দেখেছি আমরা। অথচ এই আন্দোলনের অন্যতম বড় শক্তি ও অনুপ্রেরণা ছিলেন নারীরা। কোনো এক জাদুমন্ত্রে যেন আন্দোলন–পরবর্তী সময়ে হারিয়ে গেলেন তাঁরা। আসিফ মাহমুদ, নাহিদ ইসলাম অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেলেন। সারজিস আলম, হাসনাত আবদুল্লাহসহ অনেকেই রাতারাতি মহাতারকা হয়ে উঠলেন।

কিন্তু হারিয়ে গেলেন কিংবা সুকৌশলে আড়াল করা হলো নুসরাত তাবাসসুম, অর্থি, নাজিফাদের। তাঁদের কেউ কেউ আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, তাঁরা ভাইরাল হলেন আন্দোলনে তাঁদের অবদানের জন্য নয়; বরং নারীর উপস্থিতিকে পুঁজি করে ভিউ বাড়ানোর বাণিজ্যের কৌশল হিসেবে।

নারীর জোরালো বক্তব্য কিংবা আত্মবিশ্বাসী প্রতিনিধিত্ব গৌণ হয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুখ্য হয়ে উঠল নারীর শরীর আর সৌন্দর্যের খণ্ডিত ও বিকৃত উপস্থাপন। আন্দোলনে অংশ নেওয়া নারীদের হেয়প্রতিপন্ন করার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়া হলো নোংরা ভিডিও।

শুনেছি, আন্দোলনে অংশ নেওয়া প্রথম সারির নারীদের অনেকেই এসব নিয়ে এতটাই বিব্রত ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত আছেন যে তাঁরা অনেকেই নিজেদের বৃত্তের মধ্যে গুটিয়ে ফেলেছেন।

অথচ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নারীদের অবদান ও অংশগ্রহণের এ ধরনের বিকৃত উপস্থাপন নিয়ে সরকারের দায়িত্বশীল কাউকে কথা বলতে বা প্রতিবাদ করতে দেখা যায়নি। কিন্তু তাঁরা অন্য অনেক বিষয় নিয়ে প্রতিবাদ জানাতে কিংবা নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করতে কালবিলম্ব করছেন না।

অন্যদিকে তড়িঘড়ি করে জুলাইয়ের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ওপর রচিত যে পাঠ্যবস্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, সেখানে কোনো নারী শহীদের নাম উল্লেখ করা হয়নি। বিষয়টি নিয়ে কথা উঠলে এনসিটিবির কর্মকর্তারা জানান, বিক্ষোভ চলাকালে নিহত নাফিসা হোসেনের নামটি নাকি ভুলক্রমে পরিবর্তিত হয়ে নাহিয়ান হয়ে গেছে। এই যুক্তি যে কতটা হাস্যকর, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

বারবার এ ধরনের ভুলগুলো সত্যি ভুল, নাকি আরোপিত কিংবা ইচ্ছাকৃত ভুল, সেটি ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। ভুলগুলো যদি একই সুতায় গাঁথা হয়ে থাকে, তবে এগুলোকে নিছক ভুল ভাবার কোনো অবকাশ নেই।

নারীর অস্তিত্বকে এড়িয়ে যাওয়া কিংবা নারীর নেতিবাচক উপস্থাপনের মাধ্যমে তাঁকে অযোগ্য ও অক্ষম প্রমাণ করে তাঁকে দৃশ্যের বাইরে রাখার রাজনীতিটি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অনেক পুরোনো একটি চর্চা।

এটি এমন একটি কৌশল, যার মাধ্যমে পুরুষ তাঁর একচ্ছত্র আধিপত্য ও ক্ষমতা আঁকড়ে থাকেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। জুলাই–পরবর্তী বাংলাদেশেও এই একই চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছি আমরা।

জুলাই আন্দোলনের অন্যতম বড় স্বপ্ন ছিল বৈষম্যহীন বাংলাদেশ গঠন করা। কিন্তু আন্দোলন–পরবর্তী সময়ের বাস্তবতা বলছে, এই সরকার বিগত ছয় মাসে নারীর প্রতিনিধিত্ব, নারীর সক্ষমতা ও সমান অংশগ্রহণকে মেনে নিতে ও সম্মান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে।

বিষয়টি এখনই বিবেচনায় নেওয়া না হলে নারীর অগ্রযাত্রার যে পথে দেশ কিছুটা হলেও এগিয়েছিল, তা আবার পিছিয়ে পড়বে। নারীর প্রতিনিধিত্ব ও অংশগ্রহণকে মেনে না নেওয়ার অর্থ হলো দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।

নারীর অবস্থান নিয়ে নতুন করে এ আশঙ্কা ভালো কিছুর ইঙ্গিত দেয় না। এই অস্বস্তি নিয়ে নারীরা ভালো নেই। বিষয়টি ব্যাপকতা অনুধাবন করে খুব দ্রুত সরকারকে তার অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। নারীর অংশগ্রহণের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সরকারের পরিকল্পনা জানা এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া খুব জরুরি।

তা না হলে আন্দোলনে নারীর সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ ও তাঁদের ত্যাগ শুধু অলংকার কিংবা পরোক্ষ ‘অংশগ্রহণকারী’ হিসেবেই পরিগণিত হবে। আর কতকাল নারীর অবদান শুধু আলংকারিক কিংবা বাড়তি হিসেবে উপস্থাপিত হবে?

  • নিশাত সুলতানা লেখক ও উন্নয়নকর্মী

[email protected]