বিশ্ববিদ্যালয়ে ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠায় ‘সম্মতিসূচক সম্পর্কের’ ফাঁদ চিনতে হবে

‘বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণায় আমাদের প্রধান যে ঘাটতি, তা হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ভাবতে ব্যর্থ হয়েছি।’ছবি: দীপু মালাকার

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ফাইরুজ সাদাফ অবন্তিকা ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে আত্মহত্যার পর অপর শিক্ষার্থী কাজী ফারজানা মিমের দেশ টিভিতে দেওয়া সাক্ষাৎকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অবন্তিকার করুণ পরিণতি আর মিমের দুই বছর ধরে জীবন্মৃত হওয়ার ঘটনায় আমরা যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বছর নিপীড়নের বিরুদ্ধে সজাগ থেকে কাজ করি, তাদের হৃদয় বেদনায় জর্জরিত হয়ে আছে।

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের অপর আরেক মেধাবী শিক্ষার্থী অঙ্কন বিশ্বাসের মৃত্যুর কারণ উদ্‌ঘাটনের দাবি জানাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। বলা বাহুল্য, এসব ঘটনা এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রসঙ্গে হলেও এই একই বাস্তবতা সব বিশ্ববিদ্যালয়েরই। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়কে বিচ্ছিন্ন ভাবার অবকাশ নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ধারণায় আমাদের প্রধান যে ঘাটতি, তা হলো আমরা বিশ্ববিদ্যালয়কে রাষ্ট্রের মধ্যে স্বাধীন প্রতিষ্ঠান ভাবতে ব্যর্থ হয়েছি। তবে এ-ও সত্য, মূল রাষ্ট্র ব্যবস্থাপনা ও গণতন্ত্রচর্চার ঘাটতির সঙ্গে, রাষ্ট্রের সব নাগরিকের সমান অধিকার নিশ্চিত করার প্রয়াসের ঘাটতির সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়কে স্বাধীন ভাবার ও তা বাস্তবায়ন করার যে ঘাটতি, তার ওতপ্রোত সম্পর্ক রয়েছে।

আরও পড়ুন

এই ঘাটতি মোকাবিলা ছাড়া সব রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাধীন ও নতুন জ্ঞান উৎপাদনের জন্য যে ধরনের স্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ার প্রয়োজন, সেটা অসম্ভব। মাস্তানতন্ত্র, মাদক ব্যবসা, টেন্ডারবাজি, হলগুলোয় প্রাক্তনদের দখলদারি ইত্যাদি রেখে নারীর ও অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর জন্য নিরাপদ বিশ্ববিদ্যালয় আশা করা যায় না।

ঘাটতির তালিকায় আরও যা রয়েছে, তা হলো যৌনতা প্রসঙ্গে স্পষ্ট বুঝের ঘাটতি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের জায়গা। নারী-পুরুষ ও অন্যান্য লিঙ্গীয় পরিচয়ের মানুষেরা সেখানে থাকবেন, তারা আসবে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত, বিবিধ জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মীয় পরিচয় থেকে, এমনকি আন্তর্জাতিক পরিসর থেকেও (যদিও আমরা এখন আর আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীর জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে ভাবিই না), আর সেখানে যৌনতাকে প্রসঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হবে না, সেটা কীভাবে হয়?

আড়াই দশক ধরে আমরা অনেকে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করার চেষ্টা করে যাচ্ছি। ন্যায্যতাভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠানগুলোয় যৌন সম্পর্ক ও যৌনতার বুঝকে শুধু ধর্ম ও পরিবারের এখতিয়ারভুক্ত বিষয় মনে করার সুযোগ নেই।

এখানে প্রেমের সম্পর্ককে ‘এই রকম কোনো সম্পর্ক’ শব্দমালা দিয়ে স্পষ্ট করা যায় না; বরং প্রেমের সম্পর্ককে আইনি ভাষায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে এই সম্পর্ক তৈরি করে যেভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বা গোপন বিয়ের সম্পর্কে সম্মতি উৎপাদন করা হয় এবং তা প্রতারণা ও নিপীড়নের যে ফাঁদ তৈরি করে, সেসব আমাদের বোধগম্যই হচ্ছে না। বরং সম্পর্কে সম্মতি ছিল—এটাকে যথেষ্ট ধরে নিয়ে অনেকেই আর খতিয়ে দেখতে আগ্রহী হচ্ছেন না ‘কীভাবে সম্মতি তৈরি করা’ হয়েছে।

সম্মতি ছাড়া কোনো যৌন সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টার বৈধতা যেমন বিভিন্ন ধর্মীয় নৈতিকতায় নেই, নেই অন্য কোনো নৈতিকতার ধারণাতেও। তেমনি প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক চর্চায় কোন কোন আচরণ যৌনতা থেকে আসে—নারী, পুরুষ ও তার বাইরে অন্যান্য পরিচয়ের মানুষের সাবলীল সম্পর্ককে ব্যাহত করে—সেসব চেনা প্রয়োজন।

২০০৯ সালে দেশের প্রথিতযশা আইনজীবীদের প্রচেষ্টায় উচ্চতর আদালত দেশের সব শিক্ষা ও কর্মপ্রতিষ্ঠানের জন্য যৌন হয়রানিবিরোধী দিকনির্দেশনা দিয়েছেন, সেখানে যৌন হয়রানিমূলক আচরণগুলোকে চিহ্নিত করা হয়েছে, যাতে যৌন হয়রানিবিরোধী আইন প্রণয়নেরও তাগিদ আছে, আছে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানিবিরোধী সেল প্রতিষ্ঠা করার বাধ্যবাধকতা, আজও রাষ্ট্রে সেই আইন প্রণীত হয়নি সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বা কর্মপরিসরে যৌন হয়রানিবিরোধী সেলও প্রতিষ্ঠা হয়নি।

তবে আদালতের নির্দেশনার কারণে ভুক্তভোগীরা আজ জানেন যে এমন পরিস্থিতিতে প্রতিকার চাওয়া যায়, অভিযোগ করা যায়। মুশকিল হলো, এ প্রসঙ্গে প্রকাশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ে আলাপ ও বোঝাবুঝির ঘাটতি থাকায় এই অভিযোগকারীরা পাল্টা নাজেহাল হচ্ছেন।

আরও পড়ুন

এ ছাড়া যৌন হয়রানির মধ্যে মাত্রাগত তফাত হয়, সব কর্মকাণ্ডই একই মাত্রার অপরাধ নয়, ফলে সব ক্ষেত্রেই শাস্তির মাত্রা এক নয় বা কখনো কখনো সত্যিকার শাস্তিরও প্রয়োজন হয় না, কিন্তু এসব ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তির আচরণটি যথাযথ কি না, তার স্বীকৃতির দরকার হয়, দরকার হয় মীমাংসার ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে সমাধানের। সেসবই প্রতিষ্ঠানের যৌন হয়রানিবিরোধী সেলের দায়িত্বভুক্ত করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় পরিসরে এত কিছু সেলের একার পক্ষে করতে পারার কথা নয়, বরং অন্যান্য অফিস, যেমন শিক্ষার্থী উপদেষ্টা, তাঁদের সমন্বয়ক হিসেবে কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী উপদেষ্টা অফিসকে মনোবিদদের সঙ্গে ও সেলের সঙ্গে সমন্বয় করে কিছু দায়িত্ব দেওয়া প্রয়োজন।

সর্বোপরি এই সবকিছুর জন্য প্রয়োজন সার্বিক সদিচ্ছা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ। সেই জন্য পৃথিবীর অনুকরণীয় উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় থাকে শিক্ষার্থীদের গভর্নমেন্টের ধারণা ও তাঁদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ব্যবস্থা।

এ ছাড়া আইনগত পরিমার্জনারও প্রয়োজনও রয়েছে। যেমন প্রচলিত পরীক্ষা ও শিক্ষকতার আইনে রয়েছে শিক্ষকের নিজ সন্তান, ভাই-বোন, বৈবাহিক বা এই রকম কোনো সম্পর্ক (কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষক নিয়োগে এভাবে লেখা থাকে, কোথাও হয়তো তা-ও নেই) থাকলে শিক্ষাদান ও পরীক্ষণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক যুক্ত থাকতে পারবেন না।

এখানে প্রেমের সম্পর্ককে ‘এই রকম কোনো সম্পর্ক’ শব্দমালা দিয়ে স্পষ্ট করা যায় না; বরং প্রেমের সম্পর্ককে আইনি ভাষায় আনা প্রয়োজন। তা না হলে এই সম্পর্ক তৈরি করে যেভাবে যৌন সম্পর্ক স্থাপনে বা গোপন বিয়ের সম্পর্কে সম্মতি উৎপাদন করা হয় এবং তা প্রতারণা ও নিপীড়নের যে ফাঁদ তৈরি করে, সেসব আমাদের বোধগম্যই হচ্ছে না।

বরং সম্পর্কে সম্মতি ছিল—এটাকে যথেষ্ট ধরে নিয়ে অনেকেই আর খতিয়ে দেখতে আগ্রহী হচ্ছেন না ‘কীভাবে সম্মতি তৈরি করা’ হয়েছে। শিক্ষক বা উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা ক্ষমতা ব্যবহার করেন, ভয়ভীতি বা প্রলোভন দেখিয়ে সম্মতি আদায় করে নিচ্ছেন বা সেই পরিবেশ জারি রাখছেন অথচ সেসব আদতে বিবেচনা করা হচ্ছে না।

মনে রাখা প্রয়োজন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা আসেন, তাঁরা প্রাপ্তবয়স্ক হলেও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা নবীন এবং জীবন সম্পর্কে থাকেন অনভিজ্ঞ। তাঁদের বয়সকে পৃথিবীর নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ে নাজুক ধরে নিয়ে বিশেষ সংবেদনশীলতার সঙ্গে দেখার কথা বলা হয়।

সমতা ও ন্যায্যতাভিত্তিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়তে ও নিপীড়ন রুখতে সম্পর্ক বোঝা ও সম্পর্কের সম্মতি বোঝা আমাদের আশু কর্তব্য।

  • মির্জা তাসলিমা সুলতানা অধ্যাপক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ফুলব্রাইট ভিজিটিং স্কলার, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, বার্কলে, যুক্তরাষ্ট্র।