ট্রফি ভাঙা ও হাত ভাঙা ইউএনওরা কী বার্তা দিচ্ছেন

চেয়ার সায়েবি জিনিস। চেয়ার গরম জিনিস। এই জিনিসে বসার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মোসাহেবও ‘সাহেব’ হয়ে যান। অনেকের মাথা গরম হয়। তখন জনসাধারণ-ফাধারণ তাঁর চোখে বাধে না। গরম মাথার ‘চেয়ার-ম্যান’ তখন চোখের পলকে ‘সাধারণ’ থেকে ‘অ-সাধারণ’ হয়ে ওঠেন।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) মধ্যে কেউ কেউ চেয়ারঘটিত গরমে আক্রান্ত হয়েছেন বলে মনে হচ্ছে। সেই গরমে প্রজাতন্ত্রের এই কতিপয় কর্মচারীর মাথা এতটাই গরম হয়েছে যে তাঁরা রাষ্ট্রের জনগণ তথা মালিকের সঙ্গে প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী তথা চাকরের সম্পর্ক কী, তার প্রাথমিক পাঠ ভুলে গেছেন। যে জনগণ সাধারণ মানুষের ফুট ফরমাশ খাটার জন্য তাঁদের মাসকাবারি মায়না দিয়ে কর্মচারী রেখেছে, সেই কাজ ঠিকমতো না করে চেয়ারলব্ধ ক্ষমতার আস্ফালন দেখানোতেই তঁাদের আগ্রহ বেশি দেখা যাচ্ছে। তাঁরা অতি স্থূলভাবে তাঁদের মালিকদের অপদস্থ করছেন। কাউকে গালিগালাজ করছেন। কারও হাত-পা ভেঙে দিচ্ছেন। মেরি শেলির উপন্যাসের বিজ্ঞানী ড. ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের নিজের হাতে বানানো দৈত্য যেমন তাঁর ওপরই চড়াও হয়েছিল, ঠিক সেই কায়দায় এই কর্মচারীরা তাঁদের মালিকদের ওপর হামলে পড়ছেন।

সর্বশেষ ঘটনায় আমরা দেখলাম, গত শুক্রবার বিকেলে বান্দরবানের আলীকদম উপজেলার ইউএনও মেহরুবা ইসলাম ফুটবল খেলার পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে সবার সামনে চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের ট্রফি আছাড় মেরে ভেঙে ফেললেন। খবরে দেখা যাচ্ছে, উপজেলার চৈক্ষ্যং আদর্শ উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠে ফাইনাল খেলা ছিল সেদিন। সেখানে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইউএনও। খেলার ফল নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল। তবে তাঁরা নিজেদের মধ্যে মীমাংসাও করে নিয়েছিলেন। কিন্তু ওই অনুষ্ঠানে তঁাদের উত্তেজিত হয়ে কথা বলাটাকে ‘অসহনশীল’ আচরণ হিসেবে ধরে নেন ইউএনও। তিনি তাঁর বক্তব্যে উপস্থিত সবাইকে বলেন, ‘আপনারা যত দিন পর্যন্ত সহনশীল না হতে পারবেন, তত দিন ট্রফিগুলো আমানত হিসেবে থাকবে। আরেকটি ম্যাচ হলে তারপর দেব।’ ইউএনওর বক্তব্যের জবাবে উপস্থিত সবাই ‘না না’ বলতে থাকেন। এরপর তিনি বলেন, ‘যদি ট্রফি না থাকত, আমরা খেলতাম না?...আমি ট্রফিটা ভেঙে এখন খেলা শুরু করব’ বলেই তিনি ট্রফি দুটি আছাড় মেরে ভেঙে উপস্থিত জনতাকে ‘সহনশীলতার’ প্রথম পাঠ শিখিয়ে দেন।

এর আগেও বেশ কয়েকজন ইউএনওর বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছিল। ইউএনওদের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিল, ইউএনওরা উপজেলা পর্যায়ে শাসকের ভূমিকা নিয়েছেন। যেসব ইউএনওর বিরুদ্ধে এর আগে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের পর এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যাকে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বলে অভিহিত করা যায়।

টুর্নামেন্টের আয়োজক সাদ্দাম হোসেন প্রথম আলোকে বলেছেন, ফল নিয়ে কিছুটা সমস্যা হলেও সবাই মিলে বিষয়টির মীমাংসা করেছিলেন। কোনো সমস্যা ছিল না। কিন্তু ট্রফি বিতরণের সময় প্রধান অতিথি এভাবে ট্রফি সবার সামনে আছাড় মেরে ভেঙে ফেলবেন, সেটি তাঁরা কল্পনাও করেননি। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, এ বিষয়ে তাঁরা তদন্ত করে দেখছেন। ইউএনওর আচরণ বিধিবহির্ভূত হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু কথা হলো, ঘটনা তদন্ত করার আগেই ইউএনওর সেই আছাড় মেরে ট্রফি ভাঙার ভিডিওচিত্র ফেসবুকে ওড়াউড়ি করে প্রশাসনব্যবস্থা সম্পর্কে যে নেতিবাচক ভাষ্য তৈরি করছে, তার উপশম হবে কীভাবে।

এর আগে ২২ সেপ্টেম্বর বগুড়া সদরের ইউএনও সমর কুমার পালের বিরুদ্ধে এলজিইডির চতুর্থ শ্রেণির এক কর্মচারীকে পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। আলমগীর হোসেন শেখ নামের ওই কর্মচারীকে উপজেলা পরিষদ কমপ্লেক্সে মারধর করা হয়। সংজ্ঞাহীন অবস্থায় উদ্ধার করে তাঁকে শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আলমগীরের অচেতন হয়ে পড়ে থাকা ছবি এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরছে।

চিকিৎসাধীন আলমগীর প্রথম আলোকে বলেন, ‘পারিবারিক বিষয় নিয়ে স্ত্রীর সঙ্গে আমার ঝগড়া হয়। এর জের ধরে ইউএনও স্যারের কাছে আমার স্ত্রী মৌখিক অভিযোগ করে। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় রাত্রিকালীন ডিউটি পালন করতে গেলে ইউএনও স্যার আনসার সদস্যদের ডেকে বলেন, “এই ব্যাটা আনসার, ওকে ধরে নিয়ে আয়।” আমাকে ধরে নিয়ে গেল। এরপর মোটা মোটা লাঠি নিয়ে গেল। দোতলায় ইউএনও কার্যালয়ের অন্ধকার কক্ষে নিয়ে দরজা বন্ধ করে দেন। আমি বললাম, “স্যার, আমি কিছু করিনি, আমি আপনার স্টাফ, আমার মেয়ে-জামাই আসুক, চেয়ারম্যান আসুক।” ইউএনও স্যার গালি দিয়ে বললেন, “তুই আমাকে চিনিস, তোর বউ এসে কমপ্লেন দেয়।” এরপর স্যারের বডিগার্ড ও আনসার সদস্য আমার হাত ধরে থাকেন। ইউএনও স্যার লাঠি দিয়ে পেটাতে শুরু করেন। কাকুতি-মিনতি করলাম, স্যার, আপনার পায়ে ধরি।’ কোনো কিছু শুনলেন না। কিছুতেই মন গলল না। মেঝেতে ফেলে গরুর মতো পেটালেন। হাত-পা ভেঙে দেওয়ার পর আমার অফিসের ইঞ্জিনিয়ার স্যার এসে চাবি কেড়ে নিলেন। এরপর দুজন অটোচালককে ডেকে আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে উপজেলা পরিষদের বাইরে ফেলে দিতে বললেন। মসজিদের সামনে গিয়ে জ্ঞান হারাই।’

আরও পড়ুন

আলমগীরের মেয়ে লোপা খাতুন বলেছেন, তাঁর বাবা বাঁ হাত ও ডান পা নাড়াতে পারছেন না। চিকিৎসকেরা এক্স-রে রিপোর্ট দেখে বলেছেন, হাত ও পা ভেঙে গেছে। তিনি বলেন, ‘আমার বাবার সমস্যা পারিবারিক। দোষ করলে আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে। কিন্তু ইউএনও স্যার এভাবে লাঠি দিয়ে গরুর মতো কেন পেটাবেন? সরকারি একজন কর্মচারীকে পেটানোর লাইসেন্স তাঁকে কে দিয়েছে?’

এ ঘটনাও তদন্ত করছে জেলা প্রশাসন। জেলা প্রশাসন বলছে, ‘তদন্তে কর্মচারীকে নির্যাতনের সত্যতা পাওয়া গেলে ইউএনওর বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ গুরুতর সমস্যা হলো, আমাদের সমাজে ‘তদন্ত কমিটি’, ‘সত্যতা পাওয়া গেলে’, ‘বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা’ ইত্যাকার ‘ডিপ্লোম্যাটিক’ ও ‘অফিশিয়াল’ শব্দবন্ধগুলোর প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে এসে ঠেকেছে। কারণ, এ ধরনের ঘটনায় শেষ পর্যন্ত যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকে তাকে ঠিক কী ‘ব্যবস্থা’ বলা যায়, সেটা বলাই কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আরও পড়ুন

এর আগেও বেশ কয়েকজন ইউএনওর বিরুদ্ধে গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগ উঠেছিল। ইউএনওদের বিরুদ্ধে স্থানীয় সরকার জনপ্রতিনিধিদের সংগঠন বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশন সংবাদ সম্মেলন করে অভিযোগ করেছিল, ইউএনওরা উপজেলা পর্যায়ে শাসকের ভূমিকা নিয়েছেন। যেসব ইউএনওর বিরুদ্ধে এর আগে অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্তের পর এমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, যাকে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বলে অভিহিত করা যায়। ফলে যা হওয়ার তাই হচ্ছে। খেলারাম খেলে যাচ্ছে।

সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

[email protected]