জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যারা এনসিপি নাম দিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেছে; এখন তারা নির্বাচন করবে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা করে। তরুণেরা সবাই যে মেনে নিয়েছেন, তা নয়। অনেকেই বলছেন, এনসিপি এখন তাদের রাজনীতির বিশুদ্ধতা হারাল।
খোদ এনসিপির মধ্য থেকেই এ নিয়ে প্রতিবাদ উঠেছে। প্রতিবাদকারীরা এক চিঠিতে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকার প্রসঙ্গ এনে বিক্ষুব্ধভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। চিঠিতে তাঁরা বলেছেন, ‘জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক ইতিহাস, বিশেষ করে ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের স্বাধীনতাবিরোধী ভূমিকা, গণহত্যায় সহযোগিতা এবং সে সময় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধ প্রশ্নে তাদের অবস্থান, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক চেতনা ও আমাদের দলের মূল্যবোধের সঙ্গে মৌলিকভাবে সাংঘর্ষিক।’
জুলাই আন্দোলনের পরিচিত মুখ, এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা এনসিপির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছেন। এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক তাজনূভা জাবীন এনসিপি থেকে পদত্যাগ করে জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতা সম্বন্ধে বলেছেন, ‘এই জিনিস হজম করে মরতেও পারব না আমি।’ সাবেক তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলম, যাঁকে এনসিপির সমর্থক ধরা হতো, তিনিও এই সমঝোতার বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
এনসিপির জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতার জোট গঠনে অনেকেই হতাশ হয়েছেন; কিন্তু কেউ কি আশ্চর্য হয়েছেন? এনসিপি গঠিত হওয়ার পর যতগুলো ইস্যু নিয়ে দলটির নেতারা জোরগলায় কথা বলেছেন, জামায়াতও সেগুলোর প্রতিধ্বনি করেছে। একইভাবে বলা যায়, জামায়াত যেভাবে কথা বলেছে, এনসিপিও সেভাবে সুর মিলিয়েছে। জুলাই সনদের বিভিন্ন ইস্যুতে দুই দলের চাওয়া অনেকটা একই ছিল, যদিও পাওয়াটা বেশি পেয়েছে জামায়াত। কারণ, জুলাই ঘোষণাপত্রে ইতিহাস বদল করে যা লেখা হয়েছে, তাতে জামায়াতের একাত্তরের ভূমিকা সাফসুতরো করা হয়েছে।
আওয়ামী লীগকে সরকারি বিধি জারি করে বেআইনি করা নিয়ে দুই দলই প্রথম থেকে ঐকমত্য ছিল এবং দুই দলই বারবার ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের’ বিরুদ্ধে কথা বলেছে। ২০২৫ সালের নভেম্বরে জামায়াতের নেতৃত্বে যে আটদলীয় দক্ষিণপন্থী জোট গঠন করা হয়, সেখানে এনসিপির যোগ দেওয়ার কথা ছিল; কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা যোগ দেয়নি। তখন এনসিপির একাংশ চেষ্টা করছিল বিএনপির সঙ্গে জোট করতে। শেষ পর্যন্ত সেই জোট আর হয়নি। বাস্তবতা বিবেচনা করলে জামায়াতের সঙ্গে এনসিপির সমঝোতার জোট খুব অপ্রত্যাশিত নয়। তবে যে বিষয়টি নিয়ে সবার বেশ আগ্রহ থাকবে, তা হলো জোটের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির সঙ্গে এই তরুণেরা কতটুকু ভারসাম্য রেখে চলতে পারবেন।
এনসিপি যদি এককভাবে নির্বাচন করত, তারা আসন না পেলেও মধ্যপন্থী দল হিসেবে ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াত। এবারের নির্বাচনে এনসিপির নতুন পরিচিতি বিএনপিকে মধ্যপন্থী ভোটারদের সংহত করতে সহায়তা করবে। তা ছাড়া যদি বিএনপি ক্ষমতায় যায়, তাদের দুটির বদলে একটি বিরোধী পক্ষের মুখোমুখি হতে হবে। এটা যেকোনো সরকারি দলের জন্য একটি আলাদা সুবিধা।
এনসিপির পরিচয়সংকট কি ঘুচল
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান সফল হওয়ার পর, শিক্ষার্থী ও তরুণদের বড় অংশটি রাজনীতি থেকে দূরে সরে গেল। বাকি যাঁরা সরব রইলেন, তাঁদের অনেকে বিভিন্ন সময় নানাভাবে নিজেদের বিতর্কিত করেছেন। তাঁরা একের পর এক শাহবাগে কোনো একটি ইস্যু নিয়ে অবরোধ করেছেন, সাংবাদিকদের ছাঁটাই করার জন্য মালিকপক্ষকে চাপ সৃষ্টি করেছেন, সেনাবাহিনীকে নিয়ে লাগামহীন কথাবার্তা বলেছেন, সরকারের মধ্যে তাঁদের প্রতিনিধি রেখে বিভিন্ন চাপ সৃষ্টি করেছেন, এসব নিয়ে এনসিপি নানাভাবে বিতর্কিত হয়েছে, যা তাদের জন্য একটি পরিচয়সংকটও সৃষ্টি করে।
একপর্যায়ে মনে হয়েছে, তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধকে সাতচল্লিশ ও জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তুলনায় অবনমিত করে ফেলেছে। এ প্রবণতা তাদের পরিচয়সংকটকে আরও তীব্র করে তুলেছিল। নেতাদের কথাবার্তাতেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। এনসিপির নেতারা কখনো কথা বলেছেন চাপ ও হুংকার দিয়ে, আবার কখনো ধর্মীয় রাজনীতি দিয়ে এবং আবার কখনো সুশীলদের আসরে এসে কথা বলেছেন সুশীলদের মতো। তাঁদের রাজনীতি জনগণের কাছে কিছুটা ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিল। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে সমঝোতার জোট করে এনসিপি নিজেদের জন্য একটি জামায়াতপন্থী পরিচিতি সৃষ্টি করল। এনসিপির নেতারা অবশ্য বলেছেন, আদর্শিক ঐক্য হয়নি। এটি একটি নির্বাচনী সমঝোতা।
বাস্তবতা হলো, দেশে এখন দুটি রাজনৈতিক জোট; দক্ষিণপন্থীতে আছে জামায়াত, খেলাফত, এনসিপি ইত্যাদি। আরেকটি জোটে বিএনপির নেতৃত্বে জড়ো হয়েছে কিছু মধ্যপন্থী, যাদের ঠিক দল বলা যাবে না, বলা যায় ব্যক্তিত্ব।
তারেক রহমান দেশে এসে বিএনপির প্রভাব ও সমর্থন আরও দৃশ্যমান করে তুলেছেন, যা নির্বাচনে বিরাট প্রভাব ফেলবে।
জামায়াত এত দিন পরিকল্পিতভাবে যে একটি ক্লিন ইমেজ তৈরি করেছিল, আস্তে আস্তে তাতে ভাঙন শুরু হয়েছে। যে তরুণদের সুশীলতাকে পুঁজি করে জামায়াত ডাকসু-জাকসু-রাকসু নির্বাচনে এককভাবে জয়লাভ করেছে, এখন সেই সুশীলতার আসল রূপ ধরা পড়ে গেছে। দুই মাসের মধ্যেই শিবিরের কয়েকজন নেতার ‘স্লিপ অব টাং’, শিক্ষক হেনস্তা জনমনে শঙ্কা তৈরি করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরেও হাত-পা কাটার ঘটনা ঘটেছে। মনে করা হচ্ছে, এগুলো জামায়াতের নির্বাচনী ভাগ্যে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
জুলাই আন্দোলনের তরুণদের দল এনসিপিকে জোটে এনে জামায়াত তাদের জন্য নতুন ‘বয়ান’ তৈরি করতে পারবে।
এনসিপি ক্রমে কয়জন শীর্ষ নেতার ঢাকাকেন্দ্রিক কার্যক্রমে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। তাদের সংগঠন পরিচিত হয়েছে মূলত জুলাই আন্দোলনের কয়জন ছাত্রনেতার পরিচিতিকে ভর করে। কিন্তু তাঁরা সাংগঠনিক পরিধি বাড়াতে পারেননি। ফলে নির্বাচন নিয়ে আলাপ-আলোচনা মোটামুটি বড় দুই দলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় দলীয় ব্যানারে নির্বাচন করে এনসিপির পরিচিত নেতারাও কোনো আসনে নিশ্চিতভাবে জয়লাভ করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে দলের উচ্চ মহলে সন্দেহ দেখা দিয়েছে। জামায়াতের সঙ্গে জোট বেঁধে নির্বাচন করলে তাঁরা আরও ভালো ফল করবেন, এমনটাই আশা করেন।
জাতীয় নির্বাচন হলে জাতীয় রাজনীতি আর রাজপথে নয়; বরং সংসদেই বেশি গুরুত্ব পাবে। এই অবস্থায় এনসিপি যদি জামায়াত জোটে গিয়ে সংসদে অল্প কয়টা আসনেও জয়ী হতে পারে, তবে তারা জাতীয় রাজনীতিতে নিজেদের অবস্থান রাখতে পারবে।
এনসিপির জন্য সবচেয়ে বড় ভয়, দলের অস্তিত্ব ধরে রাখা যাবে কি না। জামায়াতের সঙ্গে নির্বাচনী সমঝোতার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দলে তুমুল প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। কেউ কেউ দল ছেড়েছেন। যাঁরা ছাড়েননি, তাঁদের অনেকেই খুব অস্বস্তি বোধ করছেন।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে জামায়াতকে নিয়ে যত নেতিবাচক ধারণা আছে, এখন এনসিপিকেও কিছুটা বয়ে বেড়াতে হবে। অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করছেন, এটা এনসিপির জন্য একটি ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত।
অনেকেই বলছেন, বিএনপির মাথাব্যথা বাড়বে। কারণ, যেকোনো জোটে নতুন দল যোগ দিলে জোটের ভোট অবশ্যই বাড়বে। তবে ভিন্নমতও আছে, এনসিপি যোগ দিলে জামায়াতের ভোটের সংখ্যায় তেমন হেরফের হবে না। এনসিপি যদি এককভাবে নির্বাচন করত, তারা আসন না পেলেও মধ্যপন্থী দল হিসেবে ভবিষ্যতে প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে দাঁড়াত। এবারের নির্বাচনে এনসিপির নতুন পরিচিতি বিএনপিকে মধ্যপন্থী ভোটারদের সংহত করতে সহায়তা করবে। তা ছাড়া যদি বিএনপি ক্ষমতায় যায়, তাদের দুটির বদলে একটি বিরোধী পক্ষের মুখোমুখি হতে হবে। এটা যেকোনো সরকারি দলের জন্য একটি আলাদা সুবিধা।
রাজনৈতিক জোট ভাঙা-গড়ার মধ্যে একটি বড় আশাবাদ আছে। নির্বাচন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে দলগুলোর উৎসাহ বাড়ছে। আশা করা যায়, নির্বাচনের পর সংসদই রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু হয়ে দাঁড়াবে।
সালেহ উদ্দিন আহমদ শিক্ষক, লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
মতামত লেখকের নিজস্ব
