নারায়ণগঞ্জে জিয়া হল ও ৬ দফা ভবন বিতর্ক

নারায়ণগঞ্জের জিয়া হলছবি: সংগৃহীত

রাজনৈতিক মিথ্যাচার সাময়িক বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারলেও আখেরে তা টেকে না। এ লেখার অবতারণা ৪ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে সংসদ সদস্য শামীম ওসমান নারায়ণগঞ্জের ‘জিয়া হল’কে ‘৬ দফা ভবন’ করার দাবি জানাতে গিয়ে যেসব ভুল তথ্য হাজির করেছেন, সে প্রসঙ্গে। আলোচনার প্রয়োজনও সে ভুলের কারণে। অন্যথায় নতুন প্রজন্মের কাছে ভুল বার্তাটি সত্য হয়ে পৌঁছাবে। মিলনায়তনের নাম জিয়া হল বা ৬ দফা ভবন নিয়ে আমার কোনো আগ্রহ নেই।

শামীম ওসমান দাবি করেন, নারায়ণগঞ্জের ‘বালুর মাঠ’টি ছয় দফার জন্য বিখ্যাত হয়ে আছে, পরে জিয়াউর রহমান বা খালেদা জিয়া সে ইতিহাস মুছে দেওয়ার জন্য সেখানে ‘জিয়া হল’ নির্মাণ করেছেন। এ দাবি সর্বৈব অসত্য।

আলোচিত স্থানটিতে মিলনায়তন করার দাবিটি উত্থাপিত হয় ১৯৫৬ সালে আর এই স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা দাবির পক্ষে ভাষণ দেন ১৯৬৬ সালের ৮ মে। তবে ছয় দফার দাবিটি এখান থেকেই প্রথম তোলা হয়নি।

১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে অনুষ্ঠিত বিরোধী রাজনৈতিক সমাবেশে প্রথম ছয় দফা দাবি তুলে ধরেন। পরে ১১ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে তিনি ছয় দফা ব্যাখ্যা করেন। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ দিকে চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে বঙ্গবন্ধু প্রথম প্রকাশ্য জনসভায় ছয় দফা তুলে ধরেন।

১৮ মার্চ ঢাকার ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে ১৬ পৃষ্ঠার পুস্তিকা আকারে তা বিলি করা হয়। নারায়ণগঞ্জের বালুর মাঠে বঙ্গবন্ধুর সমাবেশটি হয় ৮ মে। সেখানে তিনি ৬ দফার পক্ষে বক্তৃতা করেন। ঢাকায় ফিরার পর ওই রাতেই তিনি গ্রেপ্তার হন।

নারায়ণগঞ্জে নাট্যকর্মীরা নাটক মঞ্চায়ন ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য নারায়ণগঞ্জে স্থায়ী একটি মিলনায়তন নির্মাণের দাবি তুলেছিলেন ১৯৫৬ সালে। তৎকালীন স্থানীয় মহকুমা প্রশাসক আবদুস সাত্তার এ দাবির সঙ্গে একাত্ম হয়ে নারায়ণগঞ্জে একটি টাউন হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেন। চাষাঢ়ার এই বালুর মাঠে টাউন হল নির্মাণের জন্য একটি কমিটি গঠন করা হয়।

অর্থায়নের জন্য বর্তমান ডায়মন্ড সিনেমা হলে সপ্তাহব্যাপী নাটক প্রদর্শিত হয়। সাত দিনে তিনটি বাংলা ও একটি উর্দু নাটক প্রদর্শিত হয়। নাটকগুলো পরিচালনা করেন কাজী খালেক, আলী মনসুর, জলিল আফগানী ও আলী কাওসার। এতে অভিনয় করেন কাজী খালেক, ইনাম আহমেদ, মফিজুল ইসলাম, আবদুর রউফ, বিলকিস বারী, আনোয়ারা, পূর্ণিমা, মিনতি, নিনা হামিদ, নূর জাহানসহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েক শিল্পী।

এ প্রদর্শনী থেকে ৯৬ হাজার টাকা সংগৃহীত হয়। এ আয়োজনের উদ্যোক্তা ছিলেন আবদুর রউফ, স্মৃতিময় বন্দ্যোপাধ্যায়, বশির আহমেদ প্রমুখ নাট্যকর্মী।

কিন্তু টাউন হল নির্মাণের কাজ শুরু করা যায়নি। পরে ষাটের দশকের শুরুতে আবার টাউন হল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হলেও তা কার্যকর হয়নি। তখন শুধু জায়গা ক্রয়ের জন্য ডিআইটিতে ৫০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।

স্বাধীনতার পর আবার নতুন করে টাউন হল নির্মাণের তৎপরতা শুরু হয়। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন মহকুমা প্রশাসক আবদুল হাই সরকার পাঁচ লাখ টাকার তহবিল সংগ্রহ করে টাউন হলের কাজ শুরু করেন। ১৯৭৭ সালের ৮ এপ্রিল রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান নারায়ণগঞ্জ পৌর মিলনায়তনে এলে নারায়ণগঞ্জের মানুষ চাষাঢ়া বালুর মাঠে ‘টাউন হল’ নির্মাণ এবং একটি হাসপাতাল তৈরির দাবি জানান।

সে সভাতেই জিয়াউর রহমান এ প্রতিষ্ঠান দুটি করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং তখনই নারায়ণগঞ্জ শহর উন্নয়ন কমিটিকে টাউন হল নির্মাণের নির্দেশ দেন। জিয়াউর রহমান সে বছরই টাউন হলের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২৫ লাখ ২০ হাজার ৯২০ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এ ছাড়া আনুষঙ্গিক অন্যান্য ব্যয়ের জন্য আরও ১০ লাখ ৩৫ হাজার ৬৫৯ টাকা ছাড় করা হয়।

১৯৮১ সালের ১৯ জুলাই তৎকালীন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবদুস সাত্তার মিলনায়তনটি উদ্বোধন করেন। কিন্তু সে বছর ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে সরকার মিলনায়তনটির নামকরণ করে ‘শহীদ জিয়া হল’। হল নির্মাণ বা পরে এর নামকরণ নিয়ে কখনো কোনো প্রতিবাদ, অপ্রীতিকর ঘটনা তখন বা পরে কখনো ঘটেনি, কেউ কখনো এ ব্যাপারে জেলেও যায়নি।

জিয়া হলটি শুরু থেকে স্থানীয় মহকুমা ও পরে জেলা প্রশাসক দ্বারা পরিচালিত হয়ে এসেছে। এক যুগ ধরে এ হল সম্পূর্ণ ব্যবহারের অনুপযোগী। কিন্তু কখনোই হলটি সাধারণের ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত ছিল না।

উদ্বোধন হওয়ার পর থেকে এরশাদের শাসনামলে দীর্ঘদিনই বলা চলে এটি সামরিক কর্মকর্তাদের জন্য বরাদ্দ থেকেছে। পরে এরশাদ শাসনের অবসান হলেও এটি স্থানীয় সংস্কৃতিচর্চার জন্য উন্মুক্ত হয়নি। বিভিন্ন সময় সরকারি অনুষ্ঠান ব্যতীত শুরু থেকেই এ হল ছিল সাধারণের অধিকারের বাইরে।

নামের কারণে আওয়ামী লীগের ২০ বছরের শাসনামলে এটি উপেক্ষিত থেকেছে। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে হলটিকে ‘মুক্তিযোদ্ধা মিলনায়তন’ নামে সরকারের প্রয়োজনে ব্যবহার করলেও এটি স্থানীয় সংস্কৃতিচর্চার জন্য উন্মুক্ত ছিল না।

শুরু থেকে হলটি রাজনৈতিক বৃত্তের নিয়ন্ত্রণে যেভাবে আবদ্ধ হয়েছে, তা নারায়ণগঞ্জে মানুষের জন্য মঙ্গলজনক নয়। শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানগুলোকে রাজনীতির দুষ্টচক্র থেকে মুক্ত করা এখন সময়ের দাবি।

  • রফিউর রাব্বি সাংস্কৃতিক সংগঠক