জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের ‘হযবরল’ কাণ্ড

‘দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক মিটার, কিলোমিটার, মাইল, ক্রোশ হতে পারে। কিন্তু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একর হিসেবে নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেছে।’

গত ২৪ সেপ্টেম্বর বিশ্ব নদী দিবসে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা শীর্ষক একটি বই প্রকাশ করেছে। বইটিতে দেখা যায়, নদীর সংখ্যা, সংজ্ঞা, দৈর্ঘ্য, উৎস-পতনের মুখ, নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক—সবকিছু নিয়ে ‘হযবরল’ করেছে কমিশন। নদীর অভিভাবক প্রতিষ্ঠান ভুলে ভরা বই প্রকাশ করে নদী সম্পর্কে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে, যা দুঃখজনক। কমিশন ও নদীর স্বার্থে বইটির প্রচার, বিপণন—সবকিছু বন্ধ করা প্রয়োজন। এমনকি যেসব দপ্তরে এই বই পাঠানো হয়েছে, সেগুলো ফেরত নেওয়া জরুরি। ওয়েবসাইট থেকেও সরানো ভালো।

নদীর সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি

প্রকৌশলী ম ইনামুল হক বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক একটি বই লিখেছেন। সেই বইয়ে বেশ কিছু তথ্যসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ নদীর পরিচিতি আছে। বাংলাদেশের নদ-নদী: সংজ্ঞা ও সংখ্যা শীর্ষক বইটি প্রকাশের দিন প্রকাশনা অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নদী–গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী। তিনি অনুষ্ঠানে দাঁড়িয়ে কমিশনের কর্মকর্তাদের বলেছেন, দেড় হাজার নদী তিনি সরেজমিন দেখিয়ে আনতে পারবেন। সরেজমিন অভিজ্ঞতা থেকে আমি মনে করি, নদ-নদীর সংখ্যা দুই হাজারের কম নয়।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা বলছেন, প্রকাশিত বইয়ে উল্লেখিত নদীর তালিকার বাইরে যে নদী পাওয়া যাবে, সেগুলো তাঁরা পরবর্তী সময়ে নদী হিসেবে তালিকাভুক্ত করবেন। তাই বলে অর্ধেকের বেশি নদী বাদ রেখে বই প্রকাশ করা কিছুতেই কাম্য হতে পারে না।

কমিশন প্রকাশিত বইয়ে ১ হাজার ৮টি নদীর কথা বলা হলেও নদীর সংখ্যা ১ হাজার ৭টি। ৬৮০ নম্বর নদীর নামে লেখা হয়েছে বেতৈর। এর সুনামগঞ্জ জেলার দিরাই উপজেলার মরা সুরমা নদী থেকে উৎপন্ন হয়ে ১৭ কিলোমিটার দূরে একই উপজেলায় চামতি নদে মিলিত হয়েছে। ৬৮৫ নম্বর নদীর নাম বেতৈর। এর উৎস–পতনমুখ, উপজেলা, জেলা ও দৈর্ঘ্য অভিন্ন। কমিশনের দেওয়া সংখ্যাও ঠিক নেই।

কমিশনের বইয়ে উল্লেখ করা হয়েছে, ২৩২ নম্বর গাঙ্গিনা সবচেয়ে ছোট নদী। মাত্র ৩২ মিটারের প্রবাহকে নদী বলা হয়েছে। কমিশনের তালিকায় ৩২ মিটারের প্রবাহ নদী হলেও অনেক দীর্ঘ প্রবাহ নদী হিসেবে স্বীকৃতি পায়নি। কমিশন প্রদত্ত নদীর সংজ্ঞা নিয়েও চলছে বিতর্ক।

আরও পড়ুন

অসম্পূর্ণ তথ্যে বই প্রকাশ

অধিকাংশ নদীর ক্ষেত্রে সামান্য তথ্য দিতেও কমিশন ব্যর্থ হয়েছে। প্রায় ৫৭৮টি নদীর উৎস ও পতনমুখ উল্লেখ করা হয়নি। এই ৫৭৮টি নদীর মধ্যে ১৫টির দৈর্ঘ্য দেওয়া নেই। ৫৭৮টি নদী বাদ দিলে অবশিষ্ট যে ৪২৯টি নদী আছে, তার মধ্যে সাড়ে ৩০০টির বেশি নদীর তথ্য নেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকাশিত ৬ খণ্ডের বাংলাদেশের নদ-নদী শীর্ষক বই থেকে।

জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন প্রকাশিত বইয়ে মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি নদীর নতুন করে উপজেলা, জেলা, বিভাগ, উৎস-পতন ও দৈর্ঘ্যের তথ্য দিয়েছে। যদিও নদীকে প্রাথমিকভাবে জানার জন্য এটুকু তথ্য যথেষ্ট নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ড প্রকাশিত বইয়ের প্রায় ২০টি নদীর নাম এ বইয়ে নেই। নদীর তথ্য নেওয়া হয়েছে ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা পর্যায়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কার্যালয় থেকে। যে কর্মকর্তারা নদীর সুরক্ষা দিতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, তাঁদের ওপরই যদি ভরসা করতে হবে, তাহলে আর কমিশনের প্রয়োজন কী?

আরও পড়ুন

নদীর দৈর্ঘ্য মাপের একক একর!

দৈর্ঘ্য পরিমাপের একক মিটার, কিলোমিটার, মাইল, ক্রোশ হতে পারে। কিন্তু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন একর হিসেবে নদীর দৈর্ঘ্য পরিমাপ করেছে। নদীর দৈর্ঘ্যের পরিমাপ যে একরে হতে পারে, এটা জীবনে প্রথম দেখলাম। আবার অনেক নদীর দৈর্ঘ্য কিলোমিটারে বলার পর আরও কত একর নদী আছে, সেটি বলা হয়েছে। সরাসরি একরে উল্লেখ করা নদীর সংখ্যা প্রায় ২৬টি। যেমন ৬৭ নম্বর নদীর নাম উলশী। এর উৎস ও পতনমুখ উল্লেখ করা হয়নি। এ নদীর দৈর্ঘ্যের কলামে বলা হয়েছে, ৭৩৯ একর। এই ২৬টি নদী ছাড়া আরও ১৩টি নদীর দৈর্ঘ্য কিলোমিটারে উল্লেখ করার পর মন্তব্যের ঘরে একরে আরও কিছু জমি আছে মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। দৈর্ঘ্য একরে উল্লেখ করার মতো হাস্যকর আর কী হতে পারে!

 রংপুর বিভাগে বাদ পড়েছে শতাধিক নদী

কমিশন প্রদত্ত খসড়া তালিকায় রংপুর বিভাগে নদী ছিল ১২১টি। প্রকাশিত গ্রন্থে এ সংখ্যা প্রায় ১০টি বেড়েছে। খসড়া তালিকা প্রকাশের পর রিভারাইন পিপল থেকে রংপুর বিভাগের আরও ১০৫টি নদীর একটি তালিকা আমরা কমিশনের চেয়ারম্যানের হাতে দিয়ে এসেছিলাম। এ তালিকা যাচাই–বাছাই করে গ্রন্থবদ্ধ হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু এ তালিকাকে বাইরে রেখে গ্রন্থ প্রকাশ করা হলো। রংপুর বিভাগেই যদি শতাধিক নদী বাদ পড়ে, তাহলে অন্যান্য বিভাগেও আরও অসংখ্য নদী বাদ পড়েছে, এতে সন্দেহ নেই।

বাদ পড়েছে অনেক আন্তসীমান্ত নদী

আন্তসীমান্ত নদীর স্বীকৃতি আছে মাত্র ৫৭টির। এর বাইরে আরও শতাধিক নদী আছে। এই শতাধিক নদীর মধ্যে অনেক নদী আছে, যেগুলো কমিশন তালিকাভুক্তির বাইরে রেখেছে। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য কুড়িগ্রামের বারোমাসি, সংকোশ, কালো, ধরণী, গদাধর, তোর্শা নদী।

সম্প্রতি নদীবিষয়ক সংগঠন ‘নোঙর ট্রাস্ট’ আয়োজিত ‘জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন’–এর নদীর সংখ্যা কমানোর প্রতিবাদ সভাসূত্রে জানা যায়, প্রায় ৫০০ ভুল আছে বইটিতে। কমিশনের কর্তাব্যক্তিরা যদি নিজেরা উপলব্ধি করে বইটির প্রচার বন্ধ না করেন, তাহলে সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বইটি বাতিল করা।

  • তুহিন ওয়াদুদ রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের শিক্ষক এবং রিভারাইন পিপলের পরিচালক

  • [email protected]