খেলাপি ঋণ আদায়ের পথ কী

বাংলাদেশে খেলাপি ঋণ আদায় নিয়ে কথা বলার আগে বলতে হয়, আমাদের দেশে ব্যাংকঋণ মন্দ হয় কেন বা কীভাবে? দীর্ঘদিন দেশে-বিদেশে একজন ঋণ পরিদর্শক বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপকের কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, ঋণ প্রধানত মন্দ হয় ঋণের ঝুঁকি পর্যালোচনার দুর্বলতায়, সঠিক কাঠামো মেনে ঋণ প্রদানের অক্ষমতায়, ঋণের বিপরীতে সঠিক ও কার্যকর জামানতের অভাব থাকলে বা ব্যবসায়ের অভ্যন্তরীণ নগদ সঞ্চালন (ইন্টারনাল ক্যাশ ফ্লো) ঋণ ফেরতের জন্য পর্যাপ্ত না হলে।

আমাদের দেশে অবশ্য রাজনৈতিক আনুকূল্যে প্রদত্ত ঋণ বা ওপর থেকে আদিষ্ট হয়ে অনেকটা চোখ বন্ধ রেখে ঋণ প্রদানের পরিমাণটাও অনেক বেশি। বিশেষ করে রাষ্ট্রায়ত্ত কিংবা সরকার-ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় এ ঘটনা বেশি ঘটে।

সম্প্রতি খেলাপি ঋণ আদায়ে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে আবারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন আমাদের অর্থমন্ত্রী মহোদয়। স্থানীয় একটি পত্রিকার সঙ্গে আলাপচারিতায় অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি যতই প্রভাবশালী হোক না কেন, তিনি বা তাঁর গ্রুপভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে ঋণের সুবিধা পাবে না। পাশাপাশি জালিয়াতির মাধ্যমে নেওয়া কোনো ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণও হবে না। অবশ্য নতুন নীতিমালার আলোকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর মহোদয়ও ইতিপূর্বে একই কথা বলেছেন।

মূল্যস্ফীতি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অর্থমন্ত্রী ডিসেম্বরের মধ্যে তা ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। বিশ্বের অর্থনৈতিক মন্দা এবং বাংলাদেশে এর প্রভাব, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলার-সংকট, খেলাপি ঋণের অস্বাভাবিক উল্লম্ফনসহ অর্থনীতির নানা বিষয় এবং সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ সম্পর্কেও তিনি কথা বলেন। তিনি দাবি করেন, গৃহীত নীতি ধারাবাহিকভাবে অনুসরণ করেই সরকার করোনা-পরবর্তী অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে কাজ করছে।

মন্দ ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক তথা বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রচলিত নীতিমালাগুলো অনুসরণ করেই খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অহেতুক হস্তক্ষেপ বন্ধেরও নিশ্চয়তা প্রয়োজন। বিষয়টি অনেক অনেক কঠিন হয়ে যায়, যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এমনকি ব্যাংক পরিচালকেরাও রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করেন কিংবা স্থূল গোষ্ঠীস্বার্থের বাইরে যেতে পারেন না।

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য, সারসহ অনেক পণ্যের দাম বেড়ে গেলে এর প্রভাব দেশের অর্থনীতিতেও পড়ে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সহজাত সক্ষমতা এবং তাদের সহনশীলতা অর্থনীতির মূল শক্তি হিসেবে যেভাবে কাজ করছে, তাতে মূল্যস্ফীতি দ্রুতই সহনীয় পর্যায়ে চলে আসবে বলে মন্ত্রী মহোদয়ের বিশ্বাস। তবে আমরা এটাও জানি যে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাইরের বা বিশ্ববাজার থেকে ধার করে আনা কারণ ছাড়াও অনেকটাই অভ্যন্তরীণ বাজার ব্যবস্থাপনার ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িত।

এটা সত্যি, একদিকে বিশ্ববাজারে ডলারের দাম বেড়েছে, তার ওপর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ায় অনেকেই এখন ব্যাংক থেকে সঞ্চয়ের টাকা তুলে দৈনন্দিন খরচ মেটাচ্ছেন। এ ছাড়া নানা অনিশ্চয়তায় অনেকে ব্যাংক থেকে নগদ টাকা তুলেও নিজের কাছে রাখছেন। এর পাশাপাশি রয়েছে ক্রমবর্ধমান খেলাপি ঋণ, যার ফলে ব্যাংকের তারল্যের ওপর চাপ বাড়ছে। 

মন্ত্রী নিজেও বলেছেন, প্রভাবশালী চক্র জালিয়াতির মাধ্যমে ঋণ নিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিরাট হুমকিতে ফেলছে। তিনি বলেন, ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি চিহ্নিতকরণ কার্যক্রম আরও সুচারুরূপে সম্পাদন করতে এবং তাদের বিষয়ে অধিকতর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য দরকার হলে বাংলাদেশ ব্যাংক আরও নির্দেশনা জারি করবে।

এখন ব্যাংকগুলোর আয়, প্রভিশন সংরক্ষণ, মূলধন সংরক্ষণ অবস্থার উন্নতির জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে ব্যাংকগুলোর সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মাধ্যমে প্রতিটি ব্যাংককে শ্রেণিকৃত ঋণ আরও কমিয়ে আনার জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।

কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যেসব ঋণ শ্রেণিকৃত হয়েছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুসরণ করে ব্যাংক-গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে পুনঃ তফসিল করা যাবে। খেলাপি ঋণ আদায়ে আইনি কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে হাইকোর্ট বিভাগে আটটি পৃথক বেঞ্চ গঠন করা হয়েছে।

ঋণখেলাপিদের চিহ্নিত করে বর্তমান আইনানুযায়ী অর্থ আদায়ের বিকল্প নেই এটি যেমন সত্য, তেমনটি শর্ষের মধ্যেই ভূত রয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন। ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনের মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত খেলাপিদের ঋণ পুনঃ তফসিলীকরণের পথ বন্ধের যে উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, তা প্রশংসাযোগ্য হলেও তা কার্যকর করতে এখনো অনেক দ্বিধা রয়েছে। অন্যদিকে দেশে মূল্যস্ফীতির হার কমানো এবং ব্যাংক ও আর্থিক খাতকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সরকারের যে সদিচ্ছা রয়েছে বলে বলা হচ্ছে, সে ক্ষেত্রেও জোর কদমে কাজ হচ্ছে না।

পাচার করা অর্থ ফিরিয়ে আনা গেলে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট অনেকটাই কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে বলেও অনেকেই বলেছেন ও বলছেন। তবে এই সুকঠিন কাজটি কীভাবে শুরু করব আর কীভাবে শেষ করব, তার তরিকা এখনো কারও কাছে স্পষ্ট নয়। সেই সঙ্গে দুর্বল নীতি পরিবেশ এবং রাজনৈতিকভাবে আনুকূল্যপ্রাপ্ত বড় ও ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান না নিয়ে এটাকে কীভাবে কার্যকর করা হবে, সেটা নিয়েও কোনো পরিষ্কার ধারণা নেই।

শুধু আইনি লড়াইয়ে গিয়ে কোনো দেশেই মন্দ ঋণ পুরো আদায়ের নজির নেই। প্রয়োজন আর্থিক খাতের সংস্কার, ব্যবসায় খাতে অভ্যন্তরীণ সুশাসন নিশ্চিতকরণ আর নীতি প্রশাসনের রাজনীতি থেকে দূরে থেকে কাজের দক্ষতা ও সক্ষমতা।

মন্দ ঋণ আদায় ও ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংক তথা বাণিজ্যিক ব্যাংকের প্রচলিত নীতিমালাগুলো অনুসরণ করেই খেলাপি ঋণ আদায়ে অনেকটা এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। তবে সে ক্ষেত্রে অহেতুক হস্তক্ষেপ বন্ধেরও নিশ্চয়তা প্রয়োজন। বিষয়টি অনেক অনেক কঠিন হয়ে যায়, যখন নিয়ন্ত্রক সংস্থা সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য দ্বারা অনেক বেশি প্রভাবিত হয়ে পড়ে। এমনকি ব্যাংক পরিচালকেরাও রাজনীতিবিদের মতো আচরণ করেন কিংবা স্থূল গোষ্ঠীস্বার্থের বাইরে যেতে পারেন না।


মামুন রশীদ অর্থনীতি বিশ্লেষক