রাশিয়ার ভিন্ন মতাবলম্বীদের জন্য আলেক্সি নাভালনির অকস্মাৎ মৃত্যু ছিল মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো। কিন্তু এই শোকাতুর পরিস্থিতিতেও একটা সম্ভাবনার আভাস দেখতে পাচ্ছেন কেউ কেউ। কেউ কেউ মনে করছেন, প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বিরুদ্ধে একজোট হওয়ার এমন সুযোগ আগে আর কখনো আসেনি।
অবশ্য একজোট হওয়ার চ্যালেঞ্জও আছে। রাশিয়ায় পুতিনবিরোধীদের দুটি পক্ষের একটিতে নাভালনি ও অন্যটিতে ভিন্নমতাবলম্বী ও আর সবাই। তাঁদের সবাই বিদেশে নির্বাসিত, কিন্তু কারোরই নাভালনির মতো ‘তীব্র আবেদন’ নেই।
এই ভিন্নমতাবলম্বীদের একজন মিখাইল খাদিওরকোভস্কি। সাবেক এই ধনকুবেরের সঙ্গে পুতিনের ঝগড়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁকে ১০ বছর কাটাতে হয়েছে কারাগারে। এখন তিনি লন্ডনে থাকেন এবং পুতিনের কঠোর সমালোচক। এরপর আছেন ইসরায়েলে বসবাসকারী ম্যাক্সিম কাৎজ। তিনি ইউটিউব ইনফ্লুয়েন্সার ও সাবেক পোকার চ্যাম্পিয়ন। আরও আছেন মুক্তচিন্তার রাজনীতিক ইলইয়া ইয়াশিন। ইউক্রেনে রাশিয়ার বর্বরতার খবর প্রকাশ করার অভিযোগে তাঁর আট বছরের সাজা হয়েছিল।
এসব ব্যক্তিত্বের বাইরে রাশিয়ায় আরও একঝাঁক যুদ্ধবিরোধী গোষ্ঠী আছে। তারা রাশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল, সামাজিক ইস্যু নিয়ে কাজ করেন বা ক্ষুদ্র জাতিসত্তার প্রতিনিধি। তাঁরা রাশিয়ার সাম্রাজ্যবাদী আচরণের কথা স্বীকার করেন এবং বিষয়টি নিয়ে তাঁরা নানা ধরনের দাবি তোলেন। তাঁদের সঙ্গে নাভালনির দাবির মিল নেই। কারণ, নাভালনি রাশিয়ার জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণার পক্ষে কথা বলতেন, উদ্দেশ্য ছিল জনসমর্থন টানা।
অনেকেই নিজস্ব ইউটিউব চ্যানেল চালান বা টেলিগ্রাম ও পডকাস্ট চালান। ক্রেমলিনের এই অবাধ তথ্যপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণের যুগেও তাঁরা এসব মাধ্যম ব্যবহার করে লাখো দর্শকের কাছে পৌঁছান।
গত শুক্রবার রাশিয়ার একটি কারাগারে নাভালনি মারা যান। রোববার পর্যন্ত নাভালনির পরিবার জানতে পারেনি তাঁর মৃতদেহ কোথায়।
এক দশকের বেশি রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে নাভালনি একটি অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছিলেন। দেশজুড়ে তাঁর সমর্থকদের সেল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয় চ্যানেল এবং বিদেশি বন্ধুরা আছেন। তাঁরাই তাঁকে পুতিনের প্রধান বিরোধী হিসেবে চিত্রিত করতে সহযোগিতা করেছেন। নাভালনি ২০২১ সালে জেলে যাওয়ার পর ভিলনিয়াস, লিথুয়ানিয়া থেকে তাঁর দক্ষ লেফটেন্যান্টদের একটি দল এই নেটওয়ার্ক সক্রিয় রেখেছেন।
কাৎজ (৩৯) বলেন, ‘আমরা যারা পুতিনবিরোধী, তাদের সবাই বিপর্যস্ত এবং এই মুহূর্তে কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। নাভালনিকে কেন্দ্র করেই আমাদের পুতিন–বিরোধিতা আবর্তিত ছিল। তাই আমরা এখন নিশ্চিত না যে ঠিক কী ঘটতে যাচ্ছে।’
নাভালনির লেফটেন্যান্টদের বেশির ভাগের বয়স তিরিশের নিচে। তাঁরা তাঁদের মতো করে রাজনীতি করছেন এবং তাঁদের নেতার দেখানো পথ অনুসরণ করবেন। লিওনিদ ভলকভ ও কিরা ইয়ারমিশের কথা বলা যায়। লিওনিদ একজন দক্ষ রাজনৈতিক সংগঠক, তিনি বিদেশে নাভালনির যে নেটওয়ার্ক, তার রক্ষণাবেক্ষণ করতেন। আর কিরা ছিলেন নাভালনির পুরোনো প্রেস অফিসার।
নাভালনির মৃত্যুতে অনেকেরই মনোযোগ কেড়েছেন তাঁর স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া (৪৭)। মিউনিখে পশ্চিমা নেতাদের সামনে তাঁর জোরালো বক্তব্য থেকে অনেকেই ধারণা করছেন, তিনি হয়তো রাজনীতিতে যুক্ত হবেন।
নাভালনির দল শনিবার স্বীকার করেছে যে নেতার মৃত্যুর ক্ষতি সামলে উঠে তাদের দল পুনর্গঠনে মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু রাজনীতিতে কোন পথে তারা এগোবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়।
রাশিয়ার একটি স্বাধীন সংবাদমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুখপাত্র ইয়ারমাইশ বলেন, ‘আমাদের কিছু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। সেটা আমরা জানি।’ সাক্ষাৎকারটি ইউটিউবে পাওয়া যায়।
অনেক আগেই নাভালনি ও পরবর্তী সময়ে তাঁর অনুসারীরা স্বতন্ত্রভাবে চলার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়েছিলেন। রাজনৈতিক সমঝোতা অটুট রাখতে যে সময় ও শক্তি প্রয়োজন, সেই সময় ও শক্তি পুতিনকে মোকাবিলায় বিনিয়োগ করা শ্রেয় বলে তাঁরা মনে করেছিলেন।
গত বছর কাৎজ নাভালনিকে নির্বাচনে বিরোধীদলীয় জোট গঠনের প্রস্তাব দেন। এর জবাবে নাভালনি তাঁর ওয়েবসাইটে লেখেন, ‘সরাসরি বলি, জোট নিয়ে জাহান্নামে যান আপনারা। এসব কাজ চূড়ান্ত ভুয়ামি।’
কাৎজের সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই নাভালনির লোকজনের ঝগড়াঝাঁটি লেগে থাকত। ভিন্নমতাবলম্বীদের অনেকেই মনে করতেন, এসব ফ্যাসাদের কারণে বিরোধীপক্ষগুলো একজোট হতে পারছে না এবং তাদের কোনো প্রভাবও দৃশ্যমান হচ্ছে না।
নাভালনির মৃত্যুতে নতুন একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তাঁর মিত্র এবং রাশিয়ার ভিন্নমতাবলম্বীদের যে বড় জোট পুতিনের বিরুদ্ধে, তাঁরা কীভাবে এগোন, সেটাই দেখার বিষয়।
ভিলনিয়াস থেকে নাভালনির সংগঠন অনলাইনে নিউজ চ্যানেল পরিচালনা করে। তাদের অনুসন্ধানী শাখা এবং কর্মী বাহিনী আছে। তারা এখন সিদ্ধান্ত নেবে নেতার অনুপস্থিতিতে কীভাবে পুতিনবিরোধী আন্দোলনে তারা যুক্ত থাকবে।
নাভালনির দল রাজনৈতিক প্রচারাভিযান ও সংবাদের মধ্যে একটা সীমারেখা রাখার চেষ্টা করেছে। রাশিয়ার রাজনীতিক, নাগরিক সমাজের নেতা ও স্বতন্ত্র মিডিয়া গ্রুপের প্রত্যেকেই এই রীতি অনুসরণ করে থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য, নির্বাসনে থেকেও আলোচনায় থাকা।
সংবাদ প্রচারে তাদের প্রধান মাধ্যম এখন ইউটিউব। এটিই রাশিয়ার ভেতরে চলা পশ্চিমাদের তৈরি একমাত্র অনুমোদিত মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম।
নাভালনির মূল ইউটিউব চ্যানেল তাঁর কর্মীরা পরিচালনা করেন। এই চ্যানেলের গ্রাহক ৬০ লাখ। তাঁদের নিউজ চ্যানেলটির নাম ‘পপুলার পলিটিকস’। ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়ার অভিযানের পর চ্যানেলটি চালু হয়। গত বছর পপুলার পলিটিকস সপ্তাহে ৩০ ঘণ্টা সচল রাখার সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য ছিল, সরকারি প্রোপাগান্ডার বিরুদ্ধে প্রচার চালানো।
নাভালনির দল রাজনৈতিক প্রচারাভিযান ও সংবাদের মধ্যে একটা সীমারেখা রাখার চেষ্টা করেছে। রাশিয়ার রাজনীতিক, নাগরিক সমাজের নেতা ও স্বতন্ত্র মিডিয়া গ্রুপের প্রত্যেকেই এই রীতি অনুসরণ করে থাকেন। তাঁদের প্রত্যেকেরই উদ্দেশ্য, নির্বাসনে থেকেও আলোচনায় থাকা।
কাৎজের ইউটিউব চ্যানেলের ইউনিক ভিজিটরের সংখ্যা গত তিন মাসে ছিল এক কোটি। এই ভিজিটরদের ৬০ শতাংশই রুশি।
খাদিওরকোভস্কির সম্পদ এখন পড়তির দিকে, তবু তিনি একটি সংবাদ চ্যানেল পরিচালনা করেন। রুশিদের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশাকে উদ্দেশ্য করে তিনি চ্যানেলটি পরিচালনা করেন।
বাক্স্বাধীনতা–বিষয়ক গবেষণা সংস্থা জেএক্স ফান্ডের এক প্রতিবেদন বলছে, রাশিয়ার স্বাধীন সংবাদমাধ্যমের গ্রাহক এখন প্রাপ্তবয়স্কদের ৬ থেকে ৯ শতাংশ। রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত প্রোপাগান্ডা ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে তোলায় এ সংখ্যা যথেষ্ট।
রাশিয়ার বিরোধী দলগুলো কিছুটা সতর্কতার সঙ্গে আশা করছে, নাভালনির দেখানো পথে তারা এবার জোটবদ্ধ হয়ে হয়তো কাজ করতে পারবে।
খাদিওরকোভস্কি বলেন, ‘আমি সব সময় জোটের পক্ষে। কারণ, আমি জানি একা লড়াই কতটা ঝুঁকিপূর্ণ। যেকোনো পরিস্থিতিতে জোট পদ্ধতি হিসেবে উত্তম। কারণ, যদি একজন মানুষ চলে যান, তাহলে তাঁর জায়গায় আরেকজন দাঁড়িয়ে যান।’
সাবেক সংসদ সদস্য ম্যাক্সিম রেজনিক তাঁর বক্তব্যকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন, ‘আমি বরাবর এই একলা চলো নীতির বিপক্ষে, আমি এই অবস্থানকে সঠিক মনে করি না। আলেক্সির কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু আমাদের অবশ্যই জোটবদ্ধ হওয়ার উপায় খুঁজতে হবে।’
বিরোধী পক্ষগুলোর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল অন্তত এই মুহূর্তে একজোট হওয়া। রেজনিকের পরামর্শ ছিল, ১৭ মার্চে ভোটেকেন্দ্রে হাজির হওয়া, যদিও তাঁরা জানেন এই নির্বাচনে পুতিনই জিতবেন।’
রেজনিক বলছেন, ভোটকেন্দ্রে হাজির হওয়াটা অনেকটা ফ্ল্যাশ মবের মতো হবে। প্রকাশ্যে বিরোধিতা করার এটিই সবচেয়ে নিরাপদ উপায়। কারণ, রাশিয়ায় আন্দোলনের ক্ষেত্রে পান থেকে চুন খসলে জেলে যেতে হয়।
রেজনিক বলেন, ‘আমরা দেখাতে চাই যে রাজার গায়ে পোশাক নেই।’
নাভালনির মৃত্যুর পর প্রায় সব বিরোধীপক্ষই দুপুর বেলায় ভোটের পক্ষে সমর্থন জানিয়েছেন। রেজনিক বলেন, ‘এই ড্রাগন, এই পশু আমাদের সবাইকে ধ্বংস করে দিয়েছে, সে আমাদের বীর পুরুষকে হত্যা করেছে। এখন আমাদের ঘর থেকে বেরিয়ে আসার সময়। প্রমাণ করার সময় যে আমরা এই শাসকের দাস নই। অনেকেই হয়তো এই চেষ্টাটা করবেন না। এটা আমার শঙ্কা।’
আনাতলি কুরমানায়েভ ও আলিনা লবজিনা দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের সাংবাদিক।
নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত এ নিবন্ধটি ইংরেজি থেকে সংক্ষেপে অনুবাদ করেছেন শেখ সাবিহা আলম।