জর্জিয়া মেলোনি: ইতালিতে কি ফ্যাসিস্ট অতীত ফিরে এলো?

ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি
ছবি: এএফপি

১৯৬৮ সালে পরিস্থিতিবাদী দার্শনিক গাই ডেবোর্ড লিখেছিলেন, ‘ইতালি হচ্ছে গোটা বিশ্বের সামাজিক বৈপরীত্যগুলোর সারসংক্ষেপ।’ এ কারণে ইতালিকে একসময়, ‘আন্তর্জাতিক প্রতিবিপ্লবের পরীক্ষাগার বলা হতো’। বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এখন ইতালির নতুন প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনির বক্তব্য-বিবৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করে দেখছেন, তিনি কি একজন ফ্যাসিস্ট নাকি নব্য ফ্যাসিস্ট। তাঁদের প্রশ্ন হলো, কেন ইতালির জনগণ এখন স্বেচ্ছায় তাদের অন্ধকারতম ইতিহাসে প্রত্যাবর্তন করল?
এখন প্রশ্ন হলো, ইতালির মানুষেরা সত্যিই কি তাদের ফ্যাসিস্ট অতীতের পুনর্জীবন ঘটাল? আরও গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো, ইতালি কি সত্যিই এমন একটা গবেষণাগার যেখানকার অভিজ্ঞতা বাকি বিশ্ব অনুসরণ করবে? প্রথম প্রশ্নের উত্তর না, দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর হ্যাঁ।

যাঁরা ব্রাদার্স অব ইতালি দলটিকে ফ্যাসিস্ট দলের তকমা দিচ্ছেন, তাঁরা একটি বিষয় এড়িয়ে যাচ্ছেন। মেলোনির দলের জন্মের পেছনে বেনিতো মুসোলিনির ফ্যাসিস্ট আন্দোলনের যোগসূত্র নেই। মেলোনি একজন বিচক্ষণ রাজনৈতিক নেতা এবং রাজনৈতিক মাঠে দীর্ঘক্ষণ খেলার সক্ষমতা তার রয়েছে। ২০১২ সালে তুলনামূলকভাবে নিরাপদ সিলভিও বেরলুসকোনির শিবির ছেড়ে নিজের দল ব্রাদার্স অব ইতালির যাত্রা শুরু করেন তিনি। মেলোনি তাঁর সময়কে বাজি ধরেন এবং পরবর্তী বছরগুলোয় দলটি গড়ে তুলতে কঠোর পরিশ্রম করেন। ২০২১ সালে সুযোগ থাকার পরও মারিও দ্রাগির জাতীয় ঐক্য সরকারে যোগ দেননি মেলোনি।

মেলোনি এবার নিজেই ক্ষমতায় এলেন। একটা পিতৃতান্ত্রিক সমাজে প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন। শত বছর আগেকার ফ্যাসিস্ট অতীত পুনর্নির্মাণের মতো একটা বাজে কাজ করে তিনি তার এই অর্জন হেলায় হারাতে চাইবেন না। মেলোনির উদ্দেশ্য হলো, ইতালি ও ইউরোপের জন্য রাজনীতির নতুন একটি কেন্দ্র তৈরি করা।
মেলোনির এই আকাঙ্ক্ষা তাঁর নির্বাচনী প্রচারণাকালে স্পষ্ট হয়ে গেছে। যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সমর্থন নিশ্চিতের জন্য যা যা করণীয়, তার সবটাই তিনি করেছেন। ন্যাটোর প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করার পাশাপাশি রাশিয়াবিরোধী ও চীনবিরোধী অবস্থান জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। একইভাবে বাজার অর্থনীতি ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে আশ্বস্ত করেছে যে তার সরকার সরকারি ঋণ নিয়ন্ত্রণে আনবে। মেলোনির এ দুটি পদক্ষেপই তার জোটসঙ্গী বেরলুসকোনি ও সালভানিকে হতাশ করেছে। তাঁরা দুজনেই রাশিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল।

পররাষ্ট্র ও অর্থনৈতিক নীতির ক্ষেত্রে ওয়াশিংটন ও ব্রাসেলসকে আশ্বস্ত করেছেন মেলোনি। এই নীতি পুরোপুরি সঠিক। কেননা, এর মধ্য দিয়ে তুলনামূলক শান্তিতে তিনি তার ক্ষমতাকে সংহত করতে পারবেন এবং নিজের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে পারবেন। নিরাপত্তা, জ্বালানি ও জনজীবনের সংকটের এ সময়ে ইতালির সরকারকে নাজুক অবস্থায় ফেলার ঝুঁকি এড়ালেন তিনি।

মেলোনির এই অবস্থান ইউরোপে অতিডানপন্থীদের জন্য নতুন ধরনের একটি সরকার গঠনের সুযোগ এনে দিয়েছে। আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতি, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে রক্ষণশীলতা, অতীত-স্মৃতিকাতরতা, জাতীয়তাবাদ, নাগরিক স্বাধীনতার প্রতি বৈরিতা—এসব কারণে ডানপন্থী রাজনীতি সংকীর্ণ হৃদয়ের। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি যদি ডানপন্থীদের শ্রদ্ধা থাকে, আইনের শাসনকে যদি তারা অবজ্ঞা না করে, তাহলে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে।

এটা ঠিক যে মেলোনি ফ্যাসিস্ট ঐতিহ্য থেকে আসেননি এবং তার কর্মকাণ্ড সারা বিশ্বে না হলেও ইউরোপের জন্য একটা রূপরেখা হাজির করছে। অতিডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী কিংবা উগ্রপন্থীরা নির্বাচনে জিততে পারবে না—সম্ভবত এমন দিনের অবসান হয়েছে। এখন আমাদের স্বধর্মচ্যুত নতুন ধরনের ডানপন্থাকে গণতান্ত্রিক পরিসরে জায়গা করে দিতে হবে। জ্যাক শিরাক, মার্গারেট থ্যাচার বা আঙ্গেলা ম্যার্কেলের মতো নেতাদের বদলে এখন ট্রাম্প কিংবা মেলোনির মতো নেতারা সেখানে আসতে থাকবেন।

ইতালির জাতীয় স্বার্থ এখন চলমান ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কীভাবে তাদের নাগরিকদের রক্ষা করছে, তার ওপর খুব শক্তভাবে নির্ভর করছে। মেলোনি যদি সত্যি সত্যি ইতিহাস নির্মাণ করতে পারেন তাহলে তিনিই হবেন প্রথম ইউরোপপন্থী ও অতিডানপন্থী নেতা, যিনি একই সঙ্গে ইতালীয় ও ইউরোপীয় জাতীয়তাবাদ ধারণ করেন। মেলোনি এমন এক ইউরোপের কথা বলছেন যে ইউরোপ তার নাগরিকদের সুরক্ষা দিতে পারে। তিনি এমন এক ইউরোপের কথা বলছেন যে ইউরোপ অধিকার ও মূল্যবোধের পেছনে অযথা সময় অপচয় করবে না। এর বদলে সমরাস্ত্র, জ্বালানি ও পররাষ্ট্রনীতির মতো কার্যকর ক্ষমতার দিকে মনোযোগ দেবে।

অভিবাসীসহ আরও কিছু ক্ষেত্রে মেলোনি পুরোনো ও উগ্র জনতুষ্টিবাদী নীতি চালু রাখতে পারেন—এ সম্ভাবনা এখনো আছে। তিনি যদি সেটা করেন, তাহলে সেটা হবে আধুনিক ইতালির রাজনীতিতে আরেকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। ইতালির রাজনীতিতে চরমপন্থা ও টেকনোক্রেসি (বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত সরকার) অনন্তকাল ধরে একটার বিকল্প হিসেবে আরেকটি হাজির হচ্ছে। মেলোনি যদি তাঁর দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষায় অনমনীয় থাকতে পারেন, তাহলে তিনি ইউরোপের মূলধারার ডানপন্থীদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হবেন।

  • লরেঞ্জো মারসিলি ইতালির দার্শনিক ও আন্দোলনকর্মী
    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত অনুবাদ