দুটি ফেরির মৃত্যু ও কিছু মানুষের দীর্ঘশ্বাস

‘এই রূপসা ঘাটে একসময় ফেরি চলত। ২০০৫ সালে রূপসা নদীতে খানজাহান আলী সেতু চালু হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় এই ফেরি।’ছবি: লেখক

সন্ধ্যা নামতে তখনো কিছু বাকি। খুলনার রূপসা ঘাটে এসে দাঁড়িয়েছি। সাধারণত একটি বড় নদীর ঘাট যেমন হয়, রূপসা নদীর ঘাট দেখে তেমন মনে হলো না। তাই বলে ঘাটটি মরে গেছে, প্রাণহীন, নিস্তেজ হয়ে গেছে, ঠিক তা–ও নয়। দুই পাশে মৌসুমি ফলের দোকান, চায়ের ছোট কিছু টংদোকান, শ্রমিক সংগঠনের দপ্তর ছাড়াও সাধারণত একটা নৌঘাটে অন্য যেসব কাজকারবার থাকে, এর সবই রূপসা ঘাটে বিদ্যমান।
শ্রাবণ মাস। এই ঘাটে অনেক দিন পর বসে দেখলাম রূপসার সৌন্দর্য। নদীর পানিতে অস্ত যেতে থাকা সূর্যের আলো। ওপারে খুলনা মহানগরী।

যাত্রীরা খরস্রোতা রূপসা নদী পারাপার হচ্ছেন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে। সাধারণ বইঠা–বাওয়া নৌকাও আছে। বয়স্ক, নারী, শিশু, তরুণ, যুবা—সব ধরনের মানুষ নৌকায় করে পারাপার হচ্ছেন। ঘাটে আসার পর যাত্রীদের, বিশেষ করে যাঁরা একটু বয়স্ক, তাঁদের চোখ-মুখের দিকে তাকালে বোঝা যায়, কতটা উদ্বেগ নিয়ে নৌকায় উঠেছিলেন তাঁরা। আর এপারে এসে যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন। নৌকায় উঠতে গিয়ে কিংবা নৌকা থেকে পড়ে এই রূপসা ঘাটে প্রাণহানির খবর মাঝেমধ্যেই সংবাদপত্রে আসে।

রূপসা নদীর ঘাটে বেদিতে বসে দক্ষিণ দিকে তাকালে খানজাহান আলী সেতু চোখে পড়ে। এই ঘাট থেকে সেতুর দূরত্ব পাঁচ কিলোমিটারের কাছাকাছি। খুলনা থেকে বাগেরহাট কিংবা বরিশালের গণপরিবহনগুলো এই সেতু দিয়ে চলাচল করে। এই সেতু নিঃসন্দেহে দুপারের মানুষের যোগাযোগ সহজ করেছে। বিশেষ করে মোংলা সমুদ্রবন্দরের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ সহজ করেছে এই সেতু।

কিন্তু খুলনার রূপসা, বাগেরহাটের ফকিরহাট, মোল্লাহাট উপজেলা এবং খুলনা শহরের যাঁরা রূপসার ঘাটসংলগ্ন এলাকায় বসবাস করেন, যাঁদের নানা প্রয়োজনে এপার–ওপার করতে হয়, তাঁদের জন্য খানজাহান আলী সেতু তেমন উপকারে আসে না। রূপসা ঘাটের নৌকাই তাঁদের ভরসা।

এই রূপসা ঘাটে একসময় ফেরি চলত। ২০০৫ সালে রূপসা নদীতে খানজাহান আলী সেতু চালু হওয়ার পর বন্ধ করে দেওয়া হয় এই ফেরি।

আমার গ্রামের বাড়ি বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার মূলঘরে। ১৯৯৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে এসে গ্রাম ছেড়েছি বটে, কিন্তু গ্রাম আমাকে ছাড়েনি। সম্ভবত গ্রাম কাউকে ছাড়ে না। এলাকার মানুষ, তাঁদের নানা কথা, সমস্যা—এসব আমাকে এবং আমাদের ঘিরে রাখে। আর একেবারে ছোট্টবেলা থেকেই তো খুলনা শহরে যাচ্ছি এই ফেরিতে চড়ে।

‘যাত্রীরা খরস্রোতা রূপসা নদী পারাপার হচ্ছেন ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে।’
ছবি: লেখক

আজও মনে পড়ে, ফেরিতে ওঠার পর মানুষের সেকি কলরব! ফেরিতে কত ধরনের হকার, আর সুর করে তাঁদের পণ্য বিক্রির কৌশল ভুলতে পারি না। বাগেরহাট জেলার একটি বড় অংশের মানুষের প্রায় প্রতিদিনই খুলনা শহরে যেতে হয়। কেনাকাটা, বিয়েশাদির বাজারসদাই, আত্মীয়স্বজনের টান, সিনেমা দেখা, লেখাপড়ার প্রয়োজন তো রয়েছেই। একমাত্র কোর্টকাছারির কাজ ছাড়া বাগেরহাটে তাঁদের অনেকেরই যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এর বাইরে বাগেরহাটে যে পরিমাণ কৃষিপণ্য ও মাছ উৎপাদিত হয়, এর বড় অংশের বাজার খুলনা শহরেই। ফেরি বন্ধ হওয়ার পর এই মানুষগুলো খুবই সমস্যায় পড়েছেন।

কিন্তু কে বলবে, কে ভাববে এসব মানুষের কথা। গত ১৫ বছর এই এলাকার কোনো জনপ্রতিনিধি স্বাধীনভাবে কাজ করতে ও কথা বলতে পারেননি। তাঁদের মনে ছিল ভয়—‘অমুক ভাই মাইন্ড করবে, তমুক ভাই রাগ করবে’। তা না হলে জনগুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলো কেন জাতীয়ভাবে উচ্চারিত হলো না?

২.

সাম্প্রতিক সময়ে স্থানীয় মানুষেরা আবার সরব হয়েছেন। রূপসা ঘাটে ফেরি দরকার। আবার ফেরি চালু হোক—এ রকম আলোচনা ও কথাবার্তা জোরেশোরে শুনছিলাম। এসব আলোচনা কেবল এখন হচ্ছে, তা নয়; ফেরি বন্ধ হওয়ার পরপরই তা চালুর দাবিতে আলোচনা ও কথাবার্তা হয়েছে। আবার থেমেও গেছে।

১৫ জুলাই এক দিনের জন্য গিয়েছিলাম বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলায়। বিকেলে স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী সৈয়দ জালিস মাহমুদের মোটরসাইকেলে চেপে ফকিরহাট থেকে রওনা দিলাম রূপসা ঘাটে। ঘাটের চিত্র সরেজমিনে দেখাই ছিল উদ্দেশ্য।

খুলনামুখী মহাসড়কে না উঠে ভেতরের রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম। গাছের পাতায় বিকেলের রোদ এসে পড়ছিল। চারদিকটা ছিল এত সবুজ, হয়তো বর্ষাকাল বলেই। মানসা, বাহিরদিয়া, নৈহাটি, কাজদিয়া—কী চমৎকার সব জনপদের নাম। বিকেলের রোদ গায়ে মাখতে মাখতে ২০ মিনিটের ভেতর পৌঁছে গেলাম রূপসা ঘাটে। প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে দেখলাম সবকিছু, কথা হলো অনেকের সঙ্গে।

বয়স্ক ও শিশুদের অনেকেরই নৌকায় উঠতে বেগ পেতে হচ্ছিল। ফেরি থাকলে তাঁরা নিশ্চিন্তে পারাপার হতে পারতেন।

এখনো এই রূপসা ঘাট দিয়ে যে পরিমাণ মানুষ পারাপার হন, তাতে দুটি ফেরি এখানে চালু করা দরকার। ঘাটে এখন যে পন্টুন ও গ্যাংওয়ে রয়েছে, সেটি প্রায় নষ্ট হওয়ার জোগাড়। ফেরির সঙ্গে তাই পন্টুন ও গ্যাংওয়ে নতুন করে বসাতে হবে।

এখানে একটা মত আছে যে ফেরি চালু করলে সব পরিবহন ফেরিতে গিয়ে উঠবে। খানজাহান আলী সেতুতে উঠবে না। এতে সেতুর রাজস্ব আয়ে ভাটা পড়বে। এ যুক্তি তুলে ধরে ফেরি চালু করতে দিচ্ছে না একটি পক্ষ।

আসলে সমস্যার মধ্যেই সমাধান নিহিত থাকে। একটা কঠোর নিয়ম করা যেতে পারে—ফেরিতে কোনো প্রাইভেট কার, বাস উঠতে পারবে না। এই পরিবহনগুলো খানজাহান আলী সেতু দিয়েই পারাপার হবে, এখন যেমন হচ্ছে। ফেরি চালু করতে হবে, যাতে কেবল মানুষ পারাপার হতে পারেন। বড়জোর মোটরসাইকেল ফেরিতে উঠতে পারে।

এর আগে রূপসা টু বাগেরহাট ট্রেন উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, যে ট্রেন ছিল ইতিহাসের অংশ। ব্রিটিশ আমলে খুলনা ও বরিশালের যেসব মানুষ কলকাতায় চাকরি করতেন, সপ্তাহান্তে খুলনা পর্যন্ত আসার পর এই ট্রেনেই তাঁরা বাড়ি ফিরতেন। অনেক গল্প–কবিতায় এসেছে এই ট্রেনের নাম। কিন্তু সেই ট্রেন আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এভাবে আমরা রূপসা নদীর ফেরিও হারিয়ে ফেলেছি।

যে ব্যবস্থা মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ তৈরি করে, যোগাযোগ সহজ করে, এক কলমের খোঁচায় তা বন্ধ করার চিন্তা কীভাবে নেওয়া হয়, বুঝি না। রূপসা ঘাটে ফেরি চালু করা মানুষের প্রাণের দাবি। ওই জনপদের একজন মানুষ হিসেবে, একজন গণমাধ্যমকর্মী হিসেবে দাবিটি জানাতেই পারি। আশা করি, এ ব্যাপারে শিগগিরই পদক্ষেপ দেখতে পাব।

  • কাজী আলিম-উজ-জামান উপবার্তা সম্পাদক, প্রথম আলো।
    ই–মেইল: [email protected]