মিয়ানমারকে ভাগ করে শাসন করার নীতি চীনের

চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি মিয়ানমার সফর করেনছবি: এএফপি

জাতি, ধর্ম ও মতাদর্শে বিভক্ত মিয়ানমার কখনোই একটা সম্প্রীতিপূর্ণ ও ঐক্যবদ্ধ জাতিরাষ্ট্রের মডেল নয়। আর ২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থান এবং তার পথ ধরে আসা গৃহযুদ্ধে মিয়ানমারের সমাজে পুরোনো ও নতুন বিভাজনগুলো দ্রুতগতিতে বেড়ে চলেছে।

মিয়ানমারে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তনে সমর্থন দেওয়া পশ্চিমা বিশ্ব এবং প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলো এখন আরও মৌলিক ও জরুরি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে। সেটা হলো মিয়ানমারের এই অরাজক অবস্থা ও ভেঙে পড়া দশাকে কীভাবে ঠেকানো যাবে।

মিয়ানমার যদি ভেঙে যায়, তাহলে একটা অস্থিরতার ঢেউ বঙ্গোপসাগর, বাংলাদেশ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়াজুড়ে আছড়ে পড়বে। দেশটির ৫ কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য শোচনীয় মানবিক অভিঘাত তৈরি হবে।

অন্যখানেও বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি এবং অরাষ্ট্রীয় খেলোয়াড়দের শক্তি বাড়াবে এবং আঞ্চলিক নেতৃত্ব হিসেবে চীনের অবস্থানকে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং যদি মিয়ানমারকে বাগে আনতে না পারেন, তাহলে পরাশক্তির ভান করে কী লাভ?

ভয়াবহ নৃশংসতা মাঝেমধ্যে মিয়ানমারকে আন্তর্জাতিক খবরের শিরোনাম বানায়। একটি ঘটনা ঘটেছে এ মাসেই। বৌদ্ধ সংখ্যাগরিষ্ঠ রাখাইন রাজ্যে সংঘাতের হাত থেকে জীবন বাঁচাতে বাংলাদেশে পলায়নরত ২০০ জন নিরস্ত্র রোহিঙ্গা বেসামরিক নাগরিককে ড্রোন হামলায় হত্যা করা হয়েছে।

সংখ্যালঘু রোহিঙ্গাদের মুসলমানদের বিরুদ্ধে যেসব গণহত্যা হয়েছে, তাতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী অংশ নিয়েছে। কিন্তু এবার আক্রমণ করেছে আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী আরাকান আর্মি।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সম্প্রতি সতর্ক করে দিয়েছে, ‘মিয়ানমার রাষ্ট্রটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। কারণ হলো জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো তাদের মাতৃভূমির ওপর নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করছে, দেশটির কেন্দ্রে একটা দুর্বল সরকার ক্ষমতা আঁকড়ে পড়ে রয়েছে এবং তারা যেসব ভূখণ্ড হারিয়েছে, সেসব জায়গায় প্রতিশোধমূলক হামলা চালাচ্ছে। মিয়ানমারে আরও বিভাজন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। ’

যদিও ব্যর্থ জেনারেল মিন অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতাচ্যুতি সময়ের ব্যাপার মাত্র, কিন্তু জান্তা সরকারের পতন এখনই হচ্ছে না। আইসিজির ব্যাখ্যা হচ্ছে, আঞ্চলিক ও জাতিগত সশস্ত্র গোষ্ঠীর মধ্যে একটা ঐক্যবদ্ধ জাতীয় দৃষ্টিভঙ্গির ঘাটতি রয়েছে। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে গণতন্ত্রপন্থীরা মিলে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট গড়ে তুলেছে। গণতন্ত্রপন্থীরা পিপলস ডিফেন্স ফোর্স গড়ে তুললেও তাদের হাতে তেমন কোনো অস্ত্রশস্ত্র নেই, যা ব্যবহার করে তারা বিজয়ী হতে পারে।

যদিও এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র মিয়ানমার শিগগিরই বিলুপ্ত হচ্ছে না। কিন্তু অবিরাম যুদ্ধ ও অস্থিতিশীলতার কারণে সেই সম্ভাবনা তৈরি হওয়ায় চীন ভীষণভাবে সতর্ক হয়ে পড়েছে। মিয়ানমারের সঙ্গে চীনের প্রায় ১ হাজার ২৫০ মাইল দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে। সেটা বিবেচনায় চীন নিরাপত্তা, বিশাল বাণিজ্য ও অবকাঠামো খাতে নেতিবাচক প্রভাব এবং আন্তসীমান্তীয় অপরাধের ব্যাপারে শঙ্কিত। এ মাসে নেপিডো সফরে গিয়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং ই গন্ডগোল ও সংঘাতের বিরোধিতা করেছেন এবং জান্তা সরকারের কাছে চীনের নাগরিকদের ও প্রকল্পের সুরক্ষা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। 

পরাজিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের মতো অত্যন্ত নিন্দিত কাজ করছে চীন। মিয়ানমারকে বিভক্ত করো এবং শাসন করো—এই নীতিতে চলছে চীন। যেসব গোষ্ঠী সীমান্ত এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের সঙ্গে গোপনে সম্পর্ক রেখে চলেছে চীন। এর কারণ হলো তারা তাদের বিনিয়োগ ও ভূকৌশলগত স্বার্থগুলো সুরক্ষিত রাখতে চায়। রেডিও ফ্রি এশিয়ার খবর হলো, এ মাসেই বিদ্রোহীদের ঘাঁটি রক্ষা করার জন্য চীন মিয়ানমারের ভেতরে জান্তা বাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণ করেছে। এ ধরনের ঘটনা এবারই প্রথম ঘটল।

এই খবরও আছে যে অক্টোবর মাসে উত্তরাঞ্চলের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর জোট থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের মধ্যে সমন্বয়ের কাজটি করেছেন চীনের গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন। একই সঙ্গে চীন ও তার মিত্র রাশিয়া জান্তাকে অব্যাহতভাবে অস্ত্রের জোগান দিয়ে যাচ্ছে। এর বিনিময়ে এই জোট মিয়ানমারভিত্তিক বিলিয়ন ডলারের অনলাইন জালিয়াত চক্র এবং চীনের লোকজনকে পাচার করে আনা চক্র গুঁড়িয়ে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

বিদ্রোহীরা দুই শতাধিক সেনাঘাঁটি ও সীমান্তচৌকি দখলে নেওয়ার পর জান্তা সরকার বেশ কয়েকটি শহরে চীনবিরোধী বিক্ষোভের অনুমোদন দেয়। মিয়ানমারের জান্তা সরকার মনে করে, বিদ্রোহীদের কুমন্ত্রণা দিয়েছিল চীন।

এ পরিস্থিতিতে চীন অলৌকিকভাবে একটা যুদ্ধবিরতি ঘটায় এবং শান্তি আলোচনায় মধ্যস্থতা করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু কেউ কাউকে বিশ্বাস করেনি। জুন মাসে আবার জোরেশোরে লড়াই শুরু হয়।

  • সিমোন টিসডাল পররাষ্ট্র বিষয়ে বিশ্লেষক

    দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত