বিজেপির উত্থানের ব্যাখ্যাটা আসলে কী

এবারের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি বড় ব্যবধানে জিতবে বলে আশা করা হচ্ছেছবি: রয়টার্স

বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশ হিসেবে পরিচিত ভারত তার ৯৬ কোটি ৮০ লাখ ভোটার নিয়ে এখন নির্বাচন তথা গণতান্ত্রিক অধিকারের চর্চা করছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টি (বিজেপি) বড় ব্যবধানে এই নির্বাচনে জিতবে বলে আশা করা হচ্ছে।

ভারতের নির্বাচনী পটভূমিতে বিজেপির আধিপত্য বিস্তারের পেছনে নানা কারণ কাজ করেছে। যেমন বিজেপি তার সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে নিরলসভাবে কাজ করে গেছে; দলের পদ-পদবি বণ্টনে মেধাতন্ত্রকে অধিক গুরুত্ব দিয়েছে; দলটি তার ‘ভোটার-ঘাঁটি’কে বিস্তৃত করেছে এবং দক্ষতার সঙ্গে দরিদ্র শ্রেণির নাগালে অপেক্ষাকৃত বেশি সুবিধা ও পরিষেবা পৌঁছে দিয়েছে।

সামাজিকভাবে রক্ষণশীল কিন্তু অর্থনৈতিকভাবে মধ্যপন্থী ঘরানার দল বিজেপি আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠা পায় ১৯৮০ সালে; যদিও পঞ্চাশের দশকে উদ্ভূত হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনসংঘের আদর্শে দলটির শিকড় গভীরভাবে প্রোথিত ছিল।

ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে গত ৭৭ বছরে বিজেপি (১৯৮০ সালের আগে জনতা সংঘ কিংবা জনতা পার্টি নামে) সব মিলিয়ে প্রায় ১৯ বছর ক্ষমতার স্বাদ নিয়েছে।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালের নির্বাচনে প্রধান বিরোধী দল ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস যেখানে ৫৪৩টি আসনের মধ্যে মাত্র ৫১টি আসন পেয়েছিল, সেখানে বিজেপি পেয়েছিল ২৯২টি। এই উচ্চ মাত্রার জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরও বিজেপি তার প্রতিদ্বন্দ্বিতার মেজাজ ধরে রেখেছে।

১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে পার্লামেন্ট আসন বাড়ানো শুরু করার পর ক্রমে ক্রমে বিজেপি (যদিও তখন দলটির নাম বিজেপি ছিল না) অপ্রতিরোধ্য হতে থাকে। এরপর ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে নাগরিক স্বাধীনতা স্থগিত করার পর ১৯৭০–এর দশকের শেষের দিকে বিজেপি প্রথম কংগ্রেসবিহীন সরকার গঠন করে। ১৯৮০-এর দশকের শেষের দিকে ব্যাপকভাবে সমাজতাত্ত্বিক পটপরিবর্তনের ধারায় আঞ্চলিক পর্যায়ের বর্ণভিত্তিক দলগুলো মাথাচাড়া দিতে শুরু করে।

কংগ্রেস বারবার ভুল রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে তার অবস্থানকে বিপন্ন করে তোলায় সেটিকে বিজেপি সুযোগ হিসেবে কাজে লাগানো শুরু করে। বিজেপির ধর্মীয় ভাষ্য ভারতে হিন্দু সমাজকে একত্র করতে সাহায্য করেছিল এবং এর ফলে বিজেপির নেতৃত্বাধীন প্রথম অ-কংগ্রেসি সরকার পূর্ণ মেয়াদে ক্ষমতায় রয়ে যায়।

আরও পড়ুন

গত দশকে ঠিক একই ধরনের অবস্থা দেখা গেছে। ২০১৪ সালে কংগ্রেসের নেতা-কর্মীদের আত্মতুষ্টি এবং আঞ্চলিক দলগুলোর মধ্যকার নেতৃত্বের উত্তরাধিকার-সম্পর্কিত জটিলতায় যে শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা বিজেপিকে ১৯৮৪ সালের পর প্রথমবারের মতো নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনকারী কোনো দল হতে সক্ষম করে। এরপর থেকে বিজেপি ধীরে ধীরে একটি আধিপত্যমূলক অবস্থান তৈরি করে।

নেতার সন্তান নেতা হবে—এই রাজবংশীয় চিন্তার দেশে বিজেপি মেধাতন্ত্রের প্রতি বরাবরই প্রতিশ্রুতিশীল। এবারের নির্বাচনে বিজেপি তাদের প্রায় এক–চতুর্থাংশ এমপিকে সরিয়ে দিয়ে তাদের স্থলে নতুন এমন প্রার্থীদের দাঁড় করিয়েছে, যাঁরা নির্বাচনী গতিশীলতা সম্পর্কে বিশদ জ্ঞান এবং কঠোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা রাখেন। নিয়মিতভাবে বিজেপি তাদের মাঝারি সারির নেতৃত্বে অদলবদল আনে, যাতে প্রত্যেক নেতা সব সময় পদ হারানোর ভয়ে সতর্ক থাকেন। এটি বিজেপিকে সতত চাঙা রেখেছে।

যদিও ৩০ বছর আগে বিজেপি প্রাথমিকভাবে উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শহুরে ও সমাজের অধিক সুবিধাভোগী হিন্দুদের সমর্থন পেয়েছিল। তবে ধীরে ধীরে তারা প্রান্তিক পর্যায়েও একটি বিস্তৃত রাজনৈতিক ভিত্তি তৈরি করে ফেলেছে।

আরও পড়ুন

২০১৯ সালে বিজেপি গ্রামীণ এলাকার ভোটের ৩৭.৬ শতাংশ, আধা গ্রামীণ ভোটের ৩২.৯ শতাংশ, নিম্ন আয়ের ভোটারদের ভোটের ৩৬ শতাংশ এবং বিভিন্ন নিম্নবর্ণের ভোটের ৩৩ থেকে ৪৮ শতাংশ ভোট জিতেছে।

বিজেপির আদর্শিক পিতা হিসেবে পরিচিত রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এই সুদীর্ঘ সময়ে তৃণমূল পর্যায়ে অর্থনৈতিক পুনর্বাসন ও সামাজিক তৎপরতায় যে শক্ত ভিত্তি গড়েছিল, এই ফলাফল ছিল তার প্রতিফলন। স্পষ্টতই হিন্দু জাতীয়তাবাদী অ্যাজেন্ডাকে এগিয়ে নেওয়া এবং মুসলিম সম্প্রদায়কে দমিয়ে দেওয়ার তৎপরতা নিয়ে এগোলেও বিজেপি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের মধ্যেও ভোটের অংশ বাড়িয়েছে।

২০০৯ সালে মাত্র ৪ শতাংশ মুসলমান বিজেপিকে ভোট দিয়েছিল। সেই সংখ্যা ২০১৪ সালে ৯ শতাংশে এবং ২০১৯ সালে ১৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছিল (যেখানে সে বছর কংগ্রেস পেয়েছিল ৩০ শতাংশ মুসলমানের ভোট)।

ভোটারদের কাছে বিজেপির ব্যাপক আবেদনের সবচেয়ে বড় বাস্তবভিত্তিক উৎস হলো ভারতের সরাসরি বেনিফিট কর্মসূচি। ২০২৩ সালে সরকার ৫৪টি মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট ৩১৫টি সরকারি প্রকল্পের মাধ্যমে ৪৯০ কোটি লেনদেনের মাধ্যমে ৯০ কোটির বেশি সুবিধাভোগীদের মধ্যে ছয় হাজার কোটি ডলারের সহায়তা বিতরণ করেছে।

 ২০১৪ সালে বিজেপি তার ‘সহযোগ নীতি’ চালু করেছিল। এই নীতি অনুযায়ী পালা করে দায়িত্বরত মন্ত্রীরা পার্টির সদর দপ্তরে হাজির হন, যাতে কর্মীরা সরাসরি তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। প্রায় দুই শ নেতা-কর্মী প্রতিদিন ওই মিটিংয়ে অংশ নেন। তাঁরা সরাসরি তাঁদের প্রতিক্রিয়া জানান এবং দলের শৃঙ্খলাবিরোধী নেতা-কর্মীকে এই মিটিংয়ের মাধ্যমে বাদ দেওয়া হয়ে থাকে।

বিজেপি একটি জোরালো উচ্চাকাঙ্ক্ষী ভাষ্যও সামনে এনেছে। মোদি সরকার পরিকাঠামো খাতে বিশাল বিনিয়োগ করার সঙ্গে সঙ্গে জনমনে তারা এই ধারণাও দিতে পেরেছে যে সরকার যা বলে, তা করতে পারে। গত দশকে এই সরকার ৭৫টি নতুন বিমানবন্দর নির্মাণ করেছে। গত বছরের জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনে ভারত ৫ ট্রিলিয়ন ডলারের জিডিপি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছিল। ভারত এখন বিশ্বমঞ্চে অনেক বেশি মনোযোগ আকর্ষণ করেছে। এটি জাতীয় মানসে প্রোথিত হয়েছে।

বিজেপিকে ক্ষমতার গতিপথ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে, পাছে এটি কংগ্রেসের মতো ক্ষয়িষ্ণু হতে শুরু করে। বিজেপিকে মনে রাখতে হবে, একসময়ের একটি মহান রাজনৈতিক দল কংগ্রেসের প্রাসঙ্গিকতা বর্তমানে অনেকের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। তাই বিজেপিকে সেই পুরোনো ভারতীয় প্রবাদ মনে রাখতে হবে, ‘কেল্লায় ক্ষয় ধরে ভেতর থেকেই।’

  • গৌরব ডালমিয়া ভারতের শীর্ষস্থানীয় বিনিয়োগ সংস্থা ডালমিয়া গ্রুপ হোল্ডিংসের চেয়ারম্যান

  • স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ