আমাদের দেশে পার্টির শেষ নেই। নানান পার্টি। একেকটির একেক চরিত্র—চান্দা পার্টি, মলম পার্টি, অজ্ঞান পার্টি, গ্যাঞ্জাম পার্টি, ফার্স্ট পার্টি, থার্ড পার্টি, ব্যান্ড পার্টি। আছে নানান নামের পলিটিক্যাল পার্টি। এদের মধ্যে আবার ওয়ানম্যান পার্টিও আছে। তবে যে হারে পার্টির সংখ্যা বাড়ছে, তাতে ভবিষ্যতে নতুন পার্টির নাম খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে।
এমনই এক পার্টির নেতার কল্পিত সাক্ষাৎকার। যেখানে সাংবাদিকের প্রথম প্রশ্ন ছিল, ‘এই যে নতুন পার্টি করেছেন, সারা দেশের মানুষ তো আপনাকে চিনবে না।’ নেতা সগর্বে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিলেন-
: আপনি কোন যুগে বাস করেন ভাই? আপনি খালি বলেন, আপনিও একটা পার্টির জন্ম দেবেন, দেখবেন কয়েক মিনিটের মধ্যে কয়েক শ ক্যামেরা হাজির হয়ে গেছে। ব্রেকিং নিউজ হবে, বিভিন্ন চ্যানেলের স্ক্রলে আপনার নাম যাবে, টক শোতে ঘন ঘন ডাক পড়বে। নানান শিরোনামে নতুন নতুন কনটেন্ট ছাড়বে। সারা দেশে পয়সা ছাড়া আপনার প্রচার হয়ে যাবে।
: কিন্তু রাজনীতিতে তো খরচাপাতি আছে?
: এইটাও কোনো সমস্যা না, মতলববাজ ব্যবসায়ীরা বসে আছে ইনভেস্ট করার জন্য। সুতরাং টাকার অভাব হবে না।
: তারা টাকা দেবে কেন, তাদের লাভ?
: তারা দান করবে, আপনি তাদের কুকীর্তির লাইসেন্স প্রদান করবেন।
: কিন্তু দল করে আপনার লাভ?
: আমি নেতা হলাম। কথা বললেই নানান রঙের কয়েক ডজন মাইক্রোফোন আমার সামনে সাজানো থাকবে। ম্যালা চ্যানেল তো, ওনাদেরও খবর দরকার। ভোট পাই না পাই আজকাল কিন্তু ‘ওয়ানম্যান পার্টি’রও কদর আছে। ওনারা জোটে যান, তবে ভোটে হারেন। তারপরও মন্ত্রী হওয়া যায়।
: কিন্তু রাজনীতি করতে গিয়ে যদি সমস্যায় পড়েন?
: সুর চেঞ্জ করে ফেলব। স্ট্রেইট পল্টি।
: নির্বাচন এলে কী করবেন?
: এই চামড়ার মুখে যত প্রতিশ্রুতি দেওয়া সম্ভব, সব দেব।
: কিন্তু প্রতিশ্রুতি যদি রক্ষা না করেন?
: জনগণ জানে, নির্বাচনের আগে অনেকেই অনেক কথা বলে, ওই সব মনের কথা না, মুখের কথা।
: জনগণ কী আপনার সঙ্গে আছে?
: আছে কি না জানি না, তবে সবাই সবকিছুই জনগণের ওপর দিয়ে চালিয়ে দেয়, আমিও দিলাম। রাজনীতির নীতি কয়জন মেনে চলে?
আসলেই রাজনীতি করলে একটি নীতির প্রশ্ন আসে। সেই নীতির প্রতি কতজনের প্রীতি আছে, কতজনের ভীতি আছে, আর কয়জন সেই নীতিকে ইতি করে দিয়েছেন, সেই ইতিহাস অনেকেরই জানা।
যাঁরা এই রাজনীতিতে নেতৃত্ব দেন, তাঁরা নেতা, তবে এই নেতা ও নীতিকে অনেকে সমার্থক করে ফেলেন। মনে রাখতে হবে, নেতার কথাই নীতি নয়, নীতির ধারক হচ্ছেন নেতা। তবে আমাদের এখানে অনেক নেতার প্রিয় নীতির নাম দুর্নীতি, যা মহামারির রূপ ধারণ করেছে। এই দুর্নীতির প্রধান কারণ হচ্ছে লোভ। অক্সফোর্ড গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ফ্রাঙ্ক বুকম্যান এ প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘পৃথিবীতে প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট সম্পদ রয়েছে বটে, কিন্তু সবার লোভ মেটানোর জন্য তা যথেষ্ট নয়।’ এই লোভের কারণে অনেকেই দুর্নীতিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ফলে দুর্নীতির গতি আর নীতির দুর্গতি অতিশয় ক্ষতির প্রভাব ফেলে সর্বত্র। অথচ মানুষ তাকেই ভালোবাসে, যার নীতি ও আদর্শ আছে। সে জন্য রাজনীতিতেও দেখা যায় কেউ গালি খায়, কেউ তালি পায়।
কানাডার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো প্রায় ১০ বছর শাসনক্ষমতায় ছিলেন। পদত্যাগের পর দেশে থেকেই তিনি নির্ভয়ে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়াচ্ছেন সাধারণ মানুষের মতো। বিভিন্ন শপে গিয়ে কেনাকাটা করছেন। সেই ছবিও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে।
আমাদের দেশের রাজনৈতিক ময়দানে খুব গুরুত্বপূর্ণ নেতা কিংবা ব্যক্তির ভাষণ দেওয়ার আগে নানান বিশেষণ দেওয়া হয়—সংগ্রামী জননেতা, বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর, জ্বালাময়ী বক্তা... ইত্যাদি ইত্যাদি। এসব শব্দ এখন আর তেমন গুরুত্ব বহন করে না। এখন যে কারও ভাষণকে ঐতিহাসিক ভাষণ, যত ফ্যাসফেসে কণ্ঠই হোক না কেন, বলা হয় বলিষ্ঠ কণ্ঠ। তবে জ্বালাময়ী শব্দটির সঙ্গে আমি একমত। কারণ, বেশির ভাগ রাজনৈতিক ভাষণই এখন জ্বালাময়ী, যা শুনলে আমাদের শরীরে জ্বালা ধরে যায়। যদিও রাজনৈতিক এসব জ্বালা–যন্ত্রণার মধ্যেই আমাদের বসবাস।
রাজনীতিতে মনোনয়ন বাণিজ্য ও ভোট বিক্রয় অত্যন্ত গর্হিত একটি দুর্নীতি, যা একধরনের রাজনীতির নীতিহীনতা। আসছে নির্বাচন—ভয়, না জানি কোন মাত্রায় এই লেনদেন হয়!
দুর্নীতিপ্রেমিক রাজনীতিবিদেরা নীতিহীনতার কারণে নানান কর্মকাণ্ডে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে এমন একপর্যায়ে নিয়ে যায়, যা নিয়মনীতির চূড়ান্ত লঙ্ঘন। ফলে প্রতিবাদে জেগে ওঠে জনতা। আর জনতা জাগলে এই ধরাকে সরা জ্ঞান করা অরাজকদের পরাজিত হতে হয়। এসব কারণেই হলো অভ্যুত্থান, গঠিত হলো নতুন সরকার। একের পর এক চ্যালেঞ্জ এসে হাজির হয় সরকারের সামনে। ক্ষোভ, বিক্ষোভ, অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন, কর্মবিরতিসহ নানান কর্মসূচিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে দেশ। পরিস্থিতি ঠেকাতে সিরিজ বৈঠক করেও সময়মতো সুরাহা হয় না। সাধারণ মানুষের ভোগান্তির দিকে যেন কারোরই নজর নেই। শাহবাগ থেকে যমুনা, আন্দোলনের নতুন ঠিকানা।
একসময় পুলিশের গাড়ি দেখলেই আন্দোলন-মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যেত। আর এখন পুলিশ যেন দর্শক। হাতে লাঠি থাকলেও অন্যায়ের পিঠে ওঠে না। দেখে মনে হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে তাদের কোনো কাজ নেই। চারদিকে মবের ভয়, না জানি কখন কী হয়। এই মব কারও কাছে ভায়োলেন্স, কারও কাছে জাস্টিস, কারও কাছে প্রেশার গ্রুপ। সুযোগসন্ধানীরা তৎপর। চান্দাই যেন এখন বড় ধান্দা। যে যেভাবে পারছে, এই সুযোগে কার্য উদ্ধার করছে।
বৈশাখ আর ঈদে নানা রকম কর্মসূচি হলো। কেউ আনন্দ পেল, কেউ কষ্ট পেল, কেউ কেউ সুযোগের সদ্ব্যবহার করল। চরিত্র পাল্টানোর প্রতিযোগিতায় অনেকেই এগিয়ে গেল। দিন যতই যাচ্ছে ‘দালাল’জাতীয় ব্যক্তিদের জায়গা শক্ত হচ্ছে। মিশে যাচ্ছে পরিবর্তনের স্রোতে। মুখোশ পাল্টে সাজছে ভালো মানুষ। এই কাতারে শিল্পী, সাংবাদিক, আমলা, ব্যবসায়ীসহ অনেকেই আছেন। সাধারণ মানুষ তাকিয়ে তাকিয়ে এসব সার্কাস দেখছে। কারণ, তারা জানে, কখন কার কী ভূমিকা ছিল। এই করতে করতে শুরু হলো নির্বাচনযুদ্ধ। গণতন্ত্রের জন্য সোচ্চার আওয়াজ।
কিসের গণতন্ত্র? কেমন গণতন্ত্র? সংসদেও দেখা যায় তথাকথিত গণতন্ত্রের প্রতিফলন। স্পিকারের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘হ্যাঁ’ জয়যুক্ত হয়েছে কিংবা ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে, ‘না’ জয়যুক্ত হয়েছে। ‘হ্যাঁ’কে ‘না’বলার কিংবা ‘না’কে ‘হ্যাঁ’ বলার সাহস কারও নেই। ফলে হাতের তালুতে আঘাত পেলেও সব শক্তি ঢেলে টেবিল চাপড়ে সম্মতি বা অসম্মতি জানায়।
ডিসেম্বর, ফেব্রুয়ারি নাকি এপ্রিলের পরে নির্বাচন—এই নিয়ে মিটিং-মিছিল, তর্ক-বিতর্ক, শোডাউন আর টক শোর কথার দাপটে বাজার গরম হয়ে ওঠে। কেউ বলেন বিচার সময়সাপেক্ষ আর সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সুতরাং এর ওপর নির্ভর করে নির্বাচনের তারিখ ঠিক করা যাবে না। কথার খই ফোটা শুরু হলো টক শোতে। শুধু টিভি চ্যানেলেই নয়; ব্যক্তিগত ইউটিউব চ্যানেলেও টক শো, নেতা শো, সাংবাদিক শো—শোর শেষ নাই। নানান নামে নানান শো চলতে থাকে। মাঝেমধ্যে চিন্তা হয়, মানুষ এত কথা বলে কী করে? কারণ, ব্যবসা। যত কথা তত ভিউ, যত ভিউ তত ব্যবসা।
দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা যত বাড়ে, অশান্তি যত বাড়ে, টক শোর টক ও টকারও তত বাড়ে। একই ব্যক্তি কত ধরনের সিদ্ধান্ত দিয়ে দিচ্ছেন—কী হলে কী হবে, কী না হলে কী ঘটবে। কী উচিত কী অনুচিত। একজন অভিনয়শিল্পীর চেয়ে ‘টক’শিল্পীদের পর্দায় উপস্থিতি বেশি, ফলে তারাও অভিনয় তারকার মতো ‘টক’তারকা। সময়ের পরিবর্তনে টকারও বদলেছে। কিছু পুরোনো মুখের প্রস্থান, নতুন মুখের আগমন ঘটেছে। এখন আবার তারিখ নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন সংশয়। শুরু হয়েছে কূটনৈতিক তৎপরতা। টক শোতেও নতুন সুর।
‘যত মত তত পথ’—এটি একসময় ছিল সুবচন। সেই বচনে পচন ধরলে মূল অর্থের চেয়ে ভুল অর্থের আশঙ্কাই বেশি।
‘কথা কম কাজ বেশি’—বাক্যটি অনেকেই মনে রাখতে পারেন না। তাই তর্কে কেউ কারও কাছে হারেন না। অনেকে এটাও ভুলে যান যে শ্রোতাদের মধ্যেও তাঁদের চেয়ে জ্ঞানী বা গুণী মানুষ থাকতে পারেন। এমন মানুষও থাকতে পারেন, যাঁদের কাছে এসব কথার কোনো মূল্য নেই, প্রয়োজনও নেই। কারণ, তাঁরা উদয়াস্ত জীবনসংগ্রামে ব্যস্ত।
তবে ভবিষ্যতে একটি ভেজালবিহীন নির্বাচনের সুযোগ তৈরি হয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য নির্বাচনের বিকল্প নেই। তাই ইতিবাচক মানসিকতা নিয়ে নীতিবান রাজনীতিবিদদের এগিয়ে আসতে হবে কথা নয়, কাজ দিয়ে। যাতে সুসময়েই একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।
হানিফ সংকেত গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব