পুতিনের যুদ্ধ বয়ান একের পর এক ভেঙে পড়ছে

মস্কোর বয়ান পুতিনকে তাঁর বলা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ বিপদের উদ্বেগ থেকেই এই হামলা ঘটেছে।ছবি : রয়টার্স

আমরা আমাদের নিজেদের সম্পর্কে ও অন্যদের বিষয়ে যখন গল্প বলি, সেই গল্পের মধ্য দিয়ে মানুষ বিশ্বকে বুঝতে পারে। আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের গন্তব্যই–বা কী। প্রকৃতপক্ষে আমরা যে রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকি, তার গভীরে এই সব গল্প আর বয়ান প্রোথিত থাকে।

ইউক্রেনে সাম্প্রতিক সংঘাতের ক্ষেত্রেও এ বিষয়টি সত্য। যুদ্ধ যতই সামনে গড়াচ্ছে, দুই পক্ষই মনে করছে তাদের নিজ নিজ বয়ান তাদের কর্মকাণ্ডকে জোর সমর্থন দিচ্ছে। রাশিয়া ও ইউক্রেন দুই পক্ষই তাদের পক্ষে ইতিহাস লিখতে চাইছে। ইতিহাসবিদ হিসেবে আমি জানি, বয়ানের মধ্যে সমস্যা আছে। প্রথমত, যদিও সেটা সত্য হতে পারে এবং বাস্তবতা ও প্রকৃত ঘটনাবলির সঙ্গে সেটার সম্পর্কও থাকতে পারে, তারপরও বয়ান হিসেবে যেটা গ্রহণ করা হয়, সেটা পুরোপুরি অতিরঞ্জিত বিষয় হতে পারে। দ্বিতীয়ত, যে গল্পই বলা হোক না কেন, বিরোধী পক্ষের গল্পের সাপেক্ষেই সেটা বৈধতা পায়। অন্যথায় তার কোনো মূল্য থাকে না।  

দৃষ্টান্ত হিসেবে রাশিয়া ও তাদের বিপজ্জনক ইউক্রেন যুদ্ধের দৃষ্টান্ত ধরা যাক। রাশিয়ার সংবাদমাধ্যম ও রাজনৈতিক নেতারা দাবি করছেন, ইউক্রেনে তারা নাৎসিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। ২০১৪ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ইউক্রেনে নাৎসিরা ক্ষমতায় এসেছে এবং তাদের দেশকে পশ্চিমামুখী করেছে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়ার ওপর সরাসরি হুমকি তৈরি করছে।

এই বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়ে রাশিয়ার সৈন্যরা তাদের রুশভাষী ইউক্রেনীয় ভাই ও ইউক্রেনে বসবাসকারী রাশিয়ানদের ফ্যাসিবাদের হাত থেকে রক্ষা করতে গিয়ে জীবনদানেও প্রস্তুত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তাদের পূর্বপুরুষেরা একই পথ অনুসরণ করছিলেন।

অন্যদিকে ইউক্রেনীয় ও বেশির ভাগ পশ্চিমারা মনে করেন, ক্রেমলিন প্রভাবিত এই বয়ান পুরোপুরি ভ্রান্ত। তাঁদের পাল্টা বয়ান হলো, ২০১৪ সালে ইউক্রেনের মানুষেরা একটা মর্যাদাপূর্ণ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভ্লাদিমির পুতিনের শ্বাসরোধী চাপ থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল। ইউক্রেনের গণতন্ত্র শক্তিশালী করতে এবং পূর্ণ সার্বভৌম ও স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠার জন্য তারা পশ্চিমামুখী হয়েছে।

এই সবকিছুর মধ্যেও মস্কোর বয়ান যে এখন ধসে পড়তে শুরু করেছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকেই স্পষ্ট। রাশিয়ার বড় শহরগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়েছে রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়ায়, অরুশভাষী অধ্যুষিত দাগেস্তানেও। রাশিয়ার তরুণেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এড়াতে ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, মধ্য এশিয়ায় পালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ যুদ্ধ করতে চাইছেন, জীবন দিতে চাইছেন, যেটা আদৌ কোনো অর্থ তৈরি করে না।

এই বয়ানে অনুপ্রাণিত হয়ে এবং প্রতাপশালী প্রতিবেশীর আগ্রাসন রুখে দিতে ইউক্রেনীয়রা রাশিয়ার আক্রমণের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করছে। তারা রুশ হামলাকে তারা কার্যকরভাবে প্রতিরোধ করছে এবং এমনকি যুদ্ধক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য জয়ও পাচ্ছে।

একটা সত্য হচ্ছে, ইউক্রেন রাশিয়ার জন্য কখনোই বড় ধরনের ও নিকট ভবিষ্যতের হুমকি নয়। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে ভূরাজনৈতিক প্রভাব হারানোর ভয়ে ভীত হয়ে পড়েছিলেন পুতিন ও তাঁর সমর্থক গোষ্ঠী। ইউক্রেনের ভারকেন্দ্র পশ্চিমের দিকে হেলে পড়ার বিষয়টা মস্কো নিজেদের অরক্ষিত ভবিষ্যৎ বলে মনে করেছে।

মস্কোর বয়ান পুতিনকে তাঁর বলা প্রতিরোধমূলক যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ভবিষ্যৎ বিপদের উদ্বেগ থেকেই এই হামলা ঘটেছে। একেবারে নির্মোহ বাস্তবতা নয় বরং অতি আবেগীয় বয়ানের ওপর ভর করে সেটা ঘটেছে। সেটা হলো রাশিয়ান, ইউক্রেনীয় ও বেলারুশীদের মধ্যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।

ইউক্রেনীয়রা এখনো এমন কোনো বয়ান তৈরি করেনি, যেটি বাস্তবতার কাছেপিঠে থাকবে। যুদ্ধকালে এ ধরনের অতিরঞ্জন অনিবার্য একটা ঘটনা।
ছবি : রয়টার্স

অন্যদিকে ইউক্রেনীয়রা এখনো এমন কোনো বয়ান তৈরি করেনি, যেটি বাস্তবতার কাছেপিঠে থাকবে। যুদ্ধকালে এ ধরনের অতিরঞ্জন অনিবার্য একটা ঘটনা। কিয়েভ সরকার ও পশ্চিমা নেতারা দাবি করেছেন, এই যুদ্ধ জাতি হিসেবে ইউক্রনীয়দের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। পুতিন ইউক্রেনের নাগরিকদের ইউক্রেনীয় অস্তিত্ব মুছে দিতে চান।

এই বয়ান যদি সত্য (অবশ্যই বিশ্বাস নয়) হয়, তাহলে রাশিয়ার সঙ্গে আপসের কোনো প্রশ্ন আসে না। পুতিনের বয়ানও একইভাবে অস্তিত্বের প্রশ্নের সঙ্গে সম্পৃক্ত। পশ্চিমের বিরুদ্ধে ‘নব্য উপনিবেশবাদ’ বিরোধী লড়াই হিসেবে তিনি এটাকে হাজির করেছেন। পুতিন বিশ্বাস করেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে ছিন্নভিন্ন  করে দেওয়ার পথ খুঁজেছে। এ সূত্র অনুযায়ী, পুতিনের যে বয়ান, তাতে করে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি চ্যালেঞ্জ।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল রাশিয়ান ফেডারেশনের সঙ্গে অঙ্গীভূত করার ঘোষণাকালে পুতিন তাঁর সাম্রাজ্যবাদী কর্মকাণ্ডকে ন্যায্যাত্য দিতে ইতিহাসের আশ্রয় নেন। অধিকৃত ভূমিকে নতুন রাশিয়া বা নব রাশিয়া বলে আখ্যায়িত করেছেন পুতিন। তিনি বলেছেন, পবিত্র এই ভূমি অষ্টাদশ শতকে রাশিয়ার বীরেরা জয় করেছিলেন। সম্রাজ্ঞী ক্যাথরিন সেখানে নগর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

এরপর পুতিন তাঁর বক্তৃতায় ১৯৯১ সালের বেদনাদায়ক স্মৃতি তুলে ধরেন। সে সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির তিনজন অভিজাত প্রতিনিধি সাধারণ মানুষের মতামতের তোয়াক্কা না করে সোভিয়েত ইউনিয়ন বিলুপ্ত করে দিয়েছিল। মানুষেরা হঠাৎ করেই নিজেদের ছিন্নভিন্ন মাতৃভূমি দেখতে পেয়েছিল।

পুতিন তাঁর অবৈধ কর্মকাণ্ডকে লেনিন ও বলশেভিকরা জাতীয়তার ভিত্তিতে সোভিয়েত রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার সময় যেটা করেছিলেন, তার সঙ্গে তুলনা করেছেন। পুতিনের বয়ানে ইউক্রেনে এই আগ্রাসন একটি শোধন প্রক্রিয়া।

পুতিন তাঁর বক্তৃতায় স্পষ্ট করেছেন, তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন পুনর্জাগরণ করতে চান না। তিনি বলেছেন, ‘এখন আর রাশিয়ার সেটা (সোভিয়েত ইউনিয়ন) প্রয়োজন নেই। আমাদের আকাঙ্ক্ষাও তা নয়।’ কিন্তু নিজেদের ঐতিহাসিক জন্মভূমি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অংশ জোড়া দেওয়া উচিত বলে বিশ্বাস করেন তিনি।

পুতিনের বয়ান অনুসারে, ইউক্রেনকে পশ্চিম ও পশ্চিমা সংস্কৃতি থেকে মুক্ত করা প্রয়োজন। এর পরিবর্তে সেখানে রুশ সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন। তিনি বলেছেন, রাশিয়ার মধ্যে বাবা-মায়ের পরিবর্তে এক নম্বর অভিভাবক, দুই নম্বর অভিভাবক ও তিন নম্বর অভিভাবকের প্রয়োজন নেই। পুতিন বলেন, এই সবকিছুই আমাদের কাছে অগ্রহণীয়। আমাদের নিজেদের একটা ভিন্ন ভবিষ্যৎ রয়েছে।

আরও পড়ুন

পুতিনের এই বয়ানের নানামুখী অভিঘাত রয়েছে। ইউক্রেনে তিনি যা করছেন, তার পক্ষে এই বয়ান যুক্তি তৈরি করে। বড় পরিসরে এ বয়ান রাশিয়ার ওপর পশ্চিমারা যে হুমকি সৃষ্টি করেছে, সেই কল্পনা করতে প্ররোচিত করে। পরাশক্তি হিসেবে রাশিয়ার মর্যাদা ও অস্তিত্ব যে হুমকিতে পড়ছে, সেই ধারণার পক্ষে যুক্তি তৈরি করে।

এই সবকিছুর মধ্যেও মস্কোর বয়ান যে এখন ধসে পড়তে শুরু করেছে, তা সাম্প্রতিক ঘটনাবলি থেকেই স্পষ্ট। রাশিয়ার বড় শহরগুলোতে বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধবিরোধী প্রতিবাদ ছড়িয়ে পড়েছে। বিক্ষোভ ছড়িয়েছে রাশিয়ার অধিকৃত ক্রিমিয়ায়, অরুশভাষী অধ্যুষিত দাগেস্তানেও। রাশিয়ার তরুণেরা সেনাবাহিনীতে যোগ দেওয়া এড়াতে ফিনল্যান্ড, জর্জিয়া, আর্মেনিয়া, মধ্য এশিয়ায় পালিয়ে যাচ্ছেন। তবে এর মধ্যেও কেউ কেউ যুদ্ধ করতে চাইছেন, জীবন দিতে চাইছেন, যেটা আদৌ কোনো অর্থ তৈরি করে না।

রোনাল্ড সানি মিশিগান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও রাজনৈতিক বিজ্ঞান বিষয়ের অধ্যাপক
এশিয়া টাইমস থেকে, ইংরেজি থেকে অনুবাদ মনোজ দে