আবু সায়েম, আমাদের ক্ষমা করুন!

নিহত আবু সায়েম মতিঝিলে একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন
ছবি: সংগৃহীত

ভেতো বাঙালির ইতিহাসবিস্মৃতির প্রবণতাও নাকি আছে। তাই বলে গোল্ডফিশের স্মৃতিশক্তিকেও কি আমরা হার মানাতে চলেছি? হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে কেউই হয়তো ভালোবাসে না, কিন্তু জীবনই যদি দুঃখের পঞ্জিকা হয়, তখন? দিনক্ষণ দেখে শোক পালন কি তখন স্রেফ আনুষ্ঠানিকতা হয়ে ওঠে না?

এমন দারুণ দহনকালে গতকালের ‘পুরোনো’ শোক-দুঃখ-তাপ আজকের ‘নতুন’ আঘাত-বেদনার তলেই তো চাপা পড়ে যাওয়ার কথা। আর তাই বুঝি সড়কে প্রতিদিনের এত এত মৃত্যু রাত না পোহাতেই বাসি, লেখা হয়ে যায় ‘অতীত’ নামের খাতায়।

আরও পড়ুন

আবু সায়েমের মৃত্যুর ঘটনাও তাই জনপরিসর থেকে হারিয়ে যাবে, চাপা পড়ে থাকবে রাষ্ট্রের মহাফেজখানার ধুলোর আস্তরণে। যদিও বছর পঁয়ত্রিশের টগবগে এই তরুণকে যেভাবে প্রাণ দিতে হলো, তা সড়কে ‘প্রাত্যহিক মৃত্যু’ নয়; তার ‘উচ্চতর সংস্করণ’!
একইভাবে আগেও আবু সায়েমের মতো সাধারণ বাসযাত্রীর প্রাণ কেড়ে নেওয়া হয়েছে।

এই তো মাত্র ১০ মাস আগে, গত জানুয়ারিতে রাজধানীর ওয়ারীতে ইরফান আহমেদ নামের এক যাত্রীকে বাস থেকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া হয়। বেঘোরে প্রাণ হারান তিনি। ইরফানের ‘অপরাধ’ ছিল বাড়তি ভাড়া নিয়ে প্রতিবাদ করা। একই অপরাধে প্রাণ দিতে হলো আবু সায়েমকেও।

২০২০ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে বাড়তি ভাড়া (এক টাকা) ফেরত চাওয়ায় জসিম উদ্দিন নামের এক যাত্রীকে লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দেন চালক ও সহকারী মিলে। যা হওয়ার তা–ই হয়, প্রাণ হারান জসিম। বাড়তি ভাড়া আদায় নিয়ে কথা–কাটাকাটির জেরে ২০১৯ সালের ৯ জুন সালাউদ্দিন আহমদ নামের এক যাত্রীকে বাসের ‘চাকায় পিষে মারেন’ এশিয়া পরিবহনের একটি বাসের চালক। সায়েম, ইরফান বা জসিমের প্রাণনাশের সময় তাঁদের কোনো স্বজন ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন না।

সালাউদ্দিনকে হত্যার সময় তাঁর স্ত্রী পারুল আক্তার বাসেই ছিলেন। স্ত্রীর চোখের সামনে স্বামীকে চাকায় পিষ্ট করা হচ্ছে—এমন ভয়াবহতম দৃশ্য কি বিকারগ্রস্তের কল্পনায়ও আসতে পারে! ওই সময় ‘দর্শকসারিতে’ উপস্থিত অন্য বাসযাত্রীদের কেউ প্রতিবাদ করেছিলেন কি না, কোনো সংবাদমাধ্যমের বরাতে তা জানা যায়নি।

আরও পড়ুন

নৃশংসতম ওই ঘটনার আকস্মিকতা কাটিয়ে ওঠার পর চালক-সহকারীকে তো অন্তত পাকড়াও করা সম্ভব ছিল, তেমনটাও হয়নি। পাঁচ কিলোমিটার দূরে একটু গতি কমিয়ে বাস থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল পারুলকেও। তিনি বেঁচে যান।

দুনিয়ায় থাকতেই ‘নরকবাস’-এর ওই কথা পারুল কি কোনো দিন ভুলতে পারবেন, আমৃত্যু? তাঁর সেদিনের বুকচৌচির কান্না, স্বামীকে বাঁচানোর আকূল আহাজারি যাঁদের এতটুকু ছুঁতে পারেনি, তাঁরা হয়তো এত দিনে পুরো ঘটনাই বিস্মৃত হয়ে থাকবেন। যেভাবে ভুলে গেছি আমরাও।

ওই না–মানুষি ঘটনার প্রতিক্রিয়াহীন সাক্ষীদের মতো আমরাও কি সমান নির্বিকার নই? তাই বাস থেকে ফেলে যাত্রী হত্যার একের পর এক ঘটনা পুরোনো পত্রিকার পাতা ঢুঁড়ে সামনে জড়ো করা যায়, কিন্তু তা পরিসংখ্যানের বেশি মর্যাদা পায় না। যেমন ২০১৮ সালের ২৭ আগস্ট চট্টগ্রাম মহানগরের প্রবেশমুখ সিটি গেটের পাশে রেজাউল করিম নামের এক যাত্রীকে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়।

আবু সায়েমের ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, আশপাশের মানুষ চোখ ফিরিয়ে রাখেননি, তাঁরা এগিয়ে গেছেন। বাসের চালক ও সহকারীকে ধরে তাঁরা পুলিশে দিয়েছেন। আপাতত ‘প্রাপ্তি’ এটুকুই।

ওই ঘটনার তিন মাস আগে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়ায় সাইদুল রহমান নামের এক যুবককে বাস থেকে নদীতে ফেলে হত্যা করেন পরিবহনকর্মীরা। সাইদুল নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএর শিক্ষার্থী ছিলেন। যাত্রীকল্যাণ সমিতির হিসাবে, গত তিন বছরে ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে বাস থেকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে ১৪ যাত্রীকে।

না বললেও চলে যে এসব ঘটনার কোনোটিরই বিচার হয়নি। আসামিরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে আবার বেরিয়ে গেছেন। আবু সায়েমের হত্যার ঘটনায় অভিযুক্ত বাসচালক ও সহকারী ধরা পড়েছেন। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় এ মামলার ‘ভবিষ্যৎ’ও যে কেউ বলে দিতে পারেন। আর সে কারণেই বুঝি ওদের ঔদ্ধত্য কমে না, ধরাকে সরা জ্ঞান করার দাম্ভিকতা যায় না। হাত তো কাঁপেই না, মুহূর্তের জন্য হৃৎকম্পনও হয় না ওদের! কেননা, ওরা জানে, ওদের কিছু হবে না। ওরা চাইলে গোটা দেশ ‘অচল’ করে দিতে পারে।

আবু সায়েমের ঘটনার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম, আশপাশের মানুষ চোখ ফিরিয়ে রাখেননি, তাঁরা এগিয়ে গেছেন। বাসের চালক ও সহকারীকে ধরে তাঁরা পুলিশে দিয়েছেন। আপাতত ‘প্রাপ্তি’ এটুকুই।

আসছে ২২ অক্টোবর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস। প্রতিবারের মতো এবারও দিনটিতে মৃত্যুর পরিসংখ্যান, সড়কে অব্যবস্থাপনার খতিয়ান, চাঁদাবাজির চিত্র, পাস হওয়ার পরও আইন কার্যকর না হওয়ার আক্ষেপ ধ্বনিত হবে। কীভাবে কত কমিটি হয়, নানা সুপারিশ ও গুচ্ছের সিদ্ধান্ত হয়, কিন্তু এসবের কিছুই বাস্তবায়িত হয় না—সেই ফিরিস্তি আরেক দফায় দেশবাসীর সামনে উপস্থাপিত হবে।

কিন্তু দিনটি কেমন যাবে আবু সায়েমদের পরিবারগুলোর, কীভাবে কাটে তাঁদের প্রতিটা দিন, রাত, মুহূর্ত? শুধুই কি স্বজন হারানোর বেদনা, শোক? বিচার না পাওয়ার হতাশা, দোষীদের আস্ফালন প্রত্যক্ষ করার মর্মযাতনা কি তাঁদের কুরে কুরে খায় না? এ কেমন বেঁচে থাকা—জীবনের প্রতি পাতায় দুঃখ লেখা...

  • হাসান ইমাম প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
    [email protected]