মাথার আয়, পিছুর আয় ও মনকলার গল্প

প্রথমে কয়েকটা দৃশ্য দেখে আসি চলেন—

দৃশ্য ১.

ফরিদ মিয়া মিন্তির কাজ করেন। মানে বাজার করতে আসা ‘সাহেবদের’ সদাইপাতি ঝাঁকায় করে মাথায় বয়ে নিয়ে গাড়িতে বা রিকশায় তুলে দেন।

তো, সাহেবরা রোজ বাজারে আসেন; মাছ, মাংস, ঘি, মধু, মসলা, সবজি কেনেন। ফরিদ মিয়া সেসব সদাই মাথায় নিয়ে গাড়িতে তুলে দেন। সাহেবরা তাঁর হাতে কুড়ি-তিরিশেক টাকা ধরিয়ে দেন।

ফরিদ মিয়া সারা দিন অন্যের মাছ, মাংস, ঘি, মধু, মসলা, সবজি বয়ে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা পান। তাই দিয়ে তিনি কেজি দুয়েক মোটা চাল আর দুই-তিন পদের সবজি কিনে ঘরে যান।

আরও পড়ুন

দৃশ্য ২.

কারওয়ান বাজারে রেললাইনে বসে মাছ কাটেন বেশ কয়েকজন নারী। তাঁদের মধ্যে একজনের নাম ধরা যাক জমিলা খাতুন।

সাহেবরা মাছ বাজার থেকে কই, মাগুর, নদীর বড় বোয়াল, নদীর পাঙাশ, আইড়, রিটা—এই রকম নানা পদের মাছ কিনে জমিলা খাতুনের সামনে ফেলেন। জমিলা খাতুন সেই মাছ কেটেকুটে প্রায় ‘রেডি টু কুক’ করে তাঁদের ব্যাগে ভরে দেন।

এসব মাছের মধ্যে এমনও মাছ আছে, যার একটার দাম জমিলা খাতুনের এক সপ্তাহের রোজগারের চেয়ে বেশি।

ফলে প্রতিদিন নদীর বড় বোয়াল, নদীর বড় পাঙাশ, বাঘাড়, রিটা মাছ নিজের হাতে কুটলেও সেসবের স্বাদ নেওয়া জমিলার হয়ে ওঠে না। তাঁকে ছেলেমেয়ের জন্য চ্যালা-পুঁটি মাছ কিনে ঘরে ফিরতে হয়।

আরও পড়ুন

দৃশ্য ৩.

বনানী এলাকায় ডেলিভারি বয় হিসেবে কাজ করেন ২২ বছরের তরুণ লিটু মিয়া। নামীদামি ফুড আউটলেটে লোকে পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ—আরও কী কী খাবারের অর্ডার দেওয়ার পর ওই আউটলেট থেকে বিশাল একটা ব্যাগে খাবারগুলো ভরে লিটু মিয়ার পিঠে ঝুলিয়ে দেওয়া হয়।

লিটু মিয়া ঠা ঠা রোদের মধ্যে সাইকেল চালিয়ে সেই খাবার ভদ্রলোকদের ঠান্ডা ঘরে পৌঁছে দিয়ে আসেন।

পিৎজা, বার্গার, স্যান্ডউইচ ডেলিভারি দেওয়ার পর সেসব খাবারের গন্ধ তাঁর নাকে এসে লাগে। তাঁর খিদে লাগে। তিনি টং দোকানে চলে যান। একটা পাউরুটি চায়ে চুবিয়ে খেয়ে ‘লাঞ্চ’ সেরে ফেলেন।

আরও পড়ুন

দৃশ্য ৪.

দবিরুদ্দিন একটা ব্যাংকের ক্যাশিয়ার। সারা দিন তাঁর টাকার কাজকারবার। সারা দিন টাকা গুনতে হয়, হাজার টাকার নোট ছেনতে হয়। হেড অফিস থেকে বড় বড় বস্তায় করে বান্ডিল বান্ডিল টাকা আসে।

সিকিউরিটি গার্ডরা টাকার বস্তা গাড়ি থেকে নামিয়ে মাথায় করে ব্যাংকের শাখায় আনেন। দবিরুদ্দিন সেই টাকা গুনে নিয়ে, বুঝে নিয়ে বান্ডিলগুলো ভল্টে থরে থরে সাজিয়ে রাখেন।

মাসের শেষ দিকে কোনো এক সন্ধ্যায় বাসায় ফেরার সময় মনে পড়ে ছোট ছেলেটা রাজশাহীর বড় লিচু খেতে চেয়েছিল।

দবিরুদ্দিন মানিব্যাগ হাতিয়ে দেখেন, যা আছে তা দিয়ে বড়জোর একটা বাঙ্গি কেনা যায়। লিচু কেনা যায় না। তিনি খেয়াল করেন, সারা দিন নোট ছ্যানাছেনির কারণে তাঁর হাতে তখনো টাকার গন্ধ লেগে আছে।

আর সিকিউরিটি কোম্পানির হয়ে টাকার বস্তা কাঁধে বয়ে নিয়ে ব্যাংকে আসা সেই নিরাপত্তাকর্মীকে অবশ্য রাজশাহীর বড় লিচু কেনার জন্য বিচলিত হতে হয় না।

কারণ, তাঁর ছেলেমেয়ের হয়তো বাবার পকেটের দশা ভালোই জানা আছে; তাই হয়তো বাবাকে রাজশাহীর লিচু কিনতে বলার সাহসই তাদের হয়ে ওঠে না।

আরও পড়ুন

এই রকম অগুনতি ফরিদ মিয়া, জমিলা খাতুন, লিটু মিয়া, দবিরুদ্দিনের নিত্য চলমান জীবন-ছবির মধ্যে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) আমাদের জানিয়েছে, দেশে মাথাপিছু আয় এখন ২ হাজার ৭৮৪ ডলার। ডলারের দাম ১০৯ টাকা ৯৭ পয়সা ধরে এই হিসাব করা হয়েছে।

তার মানে, টাকার অঙ্কে আমাদের মাথাপিছু গড় আয় ৩ লাখ ৬ হাজার ১৪৪ টাকা। তাত্ত্বিকভাবে ‘মাথা’ এবং ‘পিছু’ তথা আমরা প্রত্যেকে মাসে কামাই করি ২৫ হাজার ৫০৯ টাকা।

অর্থাৎ তত্ত্বগতভাবে বাজার থেকে মোটা বাজার করা মোটা মাইনে পাওয়া সাহেব, সেই সাহেবের বাজার ঝাঁকায় করে প্রাইভেট কারে তুলে দেওয়া ফরিদ মিয়া, ৬ হাজার টাকা দিয়ে বাঘাড় মাছ কেনা ভদ্রলোক, সেই বাঘাড় কাটা রোজগার দিয়ে পুঁটি মাছ কিনে ঘরে ফেরা জমিলা খাতুন—এদের প্রত্যেকের মাসিক কামাই ২৫ হাজার ৫০৯ টাকা।

ফরিদ মিয়ার স্ত্রী আর চার ছেলেমেয়ে নিয়ে সংসারে মোট ছয়জন। ফরিদ ছাড়া আর কেউ রোজগার না করলেও বিবিএসের তত্ত্বগত মাথাপিছুর হিসাবমতে, এই পরিবারের মাসিক মোট আয় (ছয়জনের) ১ লাখ ৫৩ হাজার ৫৪ টাকা।

অন্যদিকে ফরিদ মিয়া যাঁদের বাজার বয়ে বেড়ান, তাঁদের মধ্যকার জনৈক বাশার সাহেবের সংসার ছোট। বনানীতে কেনা ফ্ল্যাটে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা স্ত্রী ও এক সন্তান নিয়ে তিনি থাকেন।

তত্ত্বগত হিসাব অনুযায়ী, এই পরিবারের মাসিক আয় (তিনজনের) ৭৬ হাজার ৫২৭ টাকা; মানে ফরিদ মিন্তির পরিবারের আয়ের অর্ধেক।

অর্থাৎ মোটা বাজার করা বাশার সাহেবের চেয়ে তাঁর বাজার গাড়িতে তুলে দেওয়া ফরিদ মিন্তি তত্ত্বগতভাবে বড়লোক।

সমস্যা হলো, থিউরিটিক্যালি বড়লোক ফরিদ মিয়ার পরিবারকে প্র্যাকটিক্যালি খেয়ে না খেয়ে দিন পার করতে হয়।

অন্যদিকে ফরিদ মিয়ার পরিবারের চেয়ে থিউরিটিক্যালি গরিব বাশার সাহেবের পরিবারের সদস্যের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে প্র্যাকটিক্যালি কত টাকা আছে, তা জানাজানি হলে হয়তো দুদকেরও গায়ের লোম খাড়া হয়ে যাবে।

আরও পড়ুন

মাথাপিছু আয়ের এই হিসাব অনেকটা ‘ধরি’ বা ‘মনে করি’ মার্কা বীজিগণিতের মতো।

আর্থিক তত্ত্বমতে, এই আয় কোনো ব্যক্তির একক আয় না। দেশের অভ্যন্তরের আয়ের সঙ্গে বিদেশ থেকে প্রবাসীদের পাঠানো ডলার যোগ করলে যত আয় হয়, তা হলো একটি দেশের মোট জাতীয় আয়। সেই জাতীয় আয়কে মাথাপিছু ভাগ করে দিয়ে এই আয়ের হিসাব করা হয়।

অক্সফাম ইন্টারন্যাশনালের গত বছরের ‘সারভাইভাল অব দ্য রিচেস্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০২০ সালের পর এই ‘সভ্য’ ও ‘শিক্ষিত’ বিশ্বে যত সম্পদ তৈরি হয়েছে, তার দুই-তৃতীয়াংশ বিশ্বের শীর্ষ ১ শতাংশ ধনীর ঘরে গেছে।

বাকি সম্পদ গেছে বাকি ৯৯ শতাংশ মানুষের ঘরে। এই বৈষম্যের ভয়ংকর ছবি সম্ভবত আমাদের দেশে দেখা যাচ্ছে।

অল্প কয়েক দিন আগে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির প্রতিবেদনে দেখা গেছে, শুধু ২০২২ সালেই দুবাইয়ের আবাসনবাজারে ৫৩২ বাংলাদেশি প্রায় সাড়ে ৪ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ করেছেন।

ফোর্বস ম্যাগাজিনের ধনকুবেরদের নামের মধ্যে বাংলাদেশিদের নাম উঠে আসছে।

খবরের কাগজে ব্যাংক এমডিদের একটি ডিনারে ৬৭ লাখ টাকা খরচের খবর আসছে। এসব খবর লোকের গা-সওয়া হয়ে গেছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলতে পারেন, এটা ‘গল্প’ না, এটাই ‘ফ্যাক্ট’। এবং রাজনীতিকদের সাফল্যগাথা হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাঠে এই তত্ত্বীয় ‘ফ্যাক্ট’-এর ডিমান্ডও ভালো। কিন্তু তার চেয়েও যেটি বড় ‘ফ্যাক্ট’, তা হলো এ এক ভয়াবহ বৈষম্যের ছবি। যতক্ষণ ফরিদ মিয়ারা মিন্তিগিরি করে অন্তত মাসে একবার মাংস কিনতে না পারছেন; যতক্ষণ জমিলা খাতুনরা স্বচ্ছন্দে অন্তত একটা ইলিশ মাছ কিনে ঘরে ফিরতে পারছেন, ততক্ষণ এই মাথাপিছু আয় বাড়ার ‘ফ্যাক্ট’ প্রচারে গৌরব নেই, বরং গ্লানি আছে।

সুতরাং আয়বৈষম্য নিয়ে আরও হাবিজাবি পরিসংখ্যান হাজির করে এই লেখাকে ক্লিশে করার মানে হয় না।

আর মাথাপিছু আয় বাড়ার গল্পে ফরিদ মিয়া কিংবা জমিলা খাতুনদের আগ্রহও নেই। কিন্তু নীতি নির্ধারকদের কাছে মাথাপিছু আয় বাড়ার এই গল্প মূল্যহীন না। এই গল্পের ‘সেল ভ্যালু’ আছে।

অর্থনীতিবিদেরা বলতে পারেন, এটা ‘গল্প’ না, এটাই ‘ফ্যাক্ট’। এবং রাজনীতিকদের সাফল্যগাথা হিসেবে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির মাঠে এই তত্ত্বীয় ‘ফ্যাক্ট’-এর ডিমান্ডও ভালো।

কিন্তু তার চেয়েও যেটি বড় ‘ফ্যাক্ট’, তা হলো এ এক ভয়াবহ বৈষম্যের ছবি। যতক্ষণ ফরিদ মিয়ারা মিন্তিগিরি করে অন্তত মাসে একবার মাংস কিনতে না পারছেন; যতক্ষণ জমিলা খাতুনরা স্বচ্ছন্দে অন্তত একটা ইলিশ মাছ কিনে ঘরে ফিরতে পারছেন, ততক্ষণ এই মাথাপিছু আয় বাড়ার ‘ফ্যাক্ট’ প্রচারে গৌরব নেই, বরং গ্লানি আছে।

বাজারকে নিজের মতো থাকতে দিলে সব শ্রেণির মানুষের কাছে স্বাভাবিকভাবেই উন্নয়নের সুফল পৌঁছায়। আর প্রতিযোগিতার পরিবেশ তৈরি না করে চাচাতো, মামাতো, ফুপাতো, খালাতো মার্কা স্বজনতোষী স্যাঙাততন্ত্রকে প্রশ্রয় দিলে এই বৈষম্য তৈরি হয়।

‘বলতে পারো বড় মানুষ মোটর কেন চড়বে?/ গরিব কেন সেই মোটরের তলায় চাপা পড়বে?’—কমিউনিস্ট কবি সুকান্তের এ কবিতায় গরিব দেশে বড়লোকের মোটরগাড়ি চড়ার ব্যাপারে হয়তো সূক্ষ্ম আপত্তি নিহিত আছে।

কিন্তু ফরিদ মিয়া, জমিলা খাতুনদের কাছে বড়লোকের গাড়ি চালানোয় সমস্যা নেই। সেই গাড়ির তলায় চাপা পড়াতেই তাদের সমস্যা। এ সমস্যা যেহেতু ‘গাড়িওয়ালাদের’ সৃষ্টি, তা সমাধানের দায় তাদেরই।

  • সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক

    [email protected]