উদ্বেগটা নিজেদের মধ্যকার বিভাজন নিয়ে

আট মাস আগে ঘটে যাওয়া গণ-অভ্যুত্থানের জোশ এখন অনেকটা কমে গেছে। এ রকমই হয়। যখন ঘটনাগুলো ঘটে, তখন সবকিছু তাজা টকটকে ধবধবে থাকে, দগদগে থাকে। এই তো সেদিনের ঘটনা। স্মৃতির মধ্যে এখনো জীবন্ত হেঁটে বেড়ায়। যত দিন যায়, আরও ঘটনা ঘটে। আগের স্মৃতিগুলো সামনে চলে যায়। পরে যেগুলো আসে, সেগুলোই তখন জীবন্ত হেঁটে বেড়ায় চোখের সামনে। আগের গুলো ঝাপসা হয়ে যায় অথবা হারিয়ে যায়।

আগস্ট অভ্যুত্থানের বেলায় এ রকমই হয়েছে, তা আমি বলব না। অনেক বেশি রক্তঝরা ছিল এ অভ্যুত্থান। তাই স্মৃতি থেকে খুব সহজে হারিয়ে যাবে না। আর এই অভ্যুত্থানে যাঁরা রাজপথে লড়াই করেছিলেন, তাঁরা এখনো তরুণ। জুলাই-আগস্টের জানবাজি লড়াইয়ের স্মৃতিগুলো এখনো তাঁদের মস্তিষ্কে। এ–ও সত্য যে এই তরুণ মন ও মস্তিষ্কে আবেগ যত বেশি কাজ করে, বয়স হলে তা আর করে না।

ওই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়া এই তরুণ ও শিক্ষার্থীরা অভ্যুত্থানের বিজয়ের পর তার নতিজা দেখে এখন বিক্ষুব্ধ। তাঁরা সময়-সময় বিভিন্ন রকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন, যাতে মনে হচ্ছে তাঁরা সরকারের অনেক কার্যক্রমেই সন্তুষ্ট নন। রাগ করে কখনো কখনো এ রকম কথাও বলছেন, কথা অনুযায়ী কাজ না হলে তাঁরা নির্বাচন বর্জন করবেন। পাঠক আমার কথার সঙ্গে হয়তো একমত হবেন, মানুষ এখন সন্দিগ্ধ চোখে প্রশ্ন করে, ভাই কী হচ্ছে দেশে? ভোট ঠিকমতো হবে তো?

অথচ সরকার একটি যথাযথ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য কাজ করে যাচ্ছে। ১৫টি সংস্কার কমিশন গঠন করেছে, তারা ১৬৬টি প্রশ্ন দিয়েছে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উদ্দেশে। তাদের দেওয়া জবাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করছে। প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ হবে এ মাসের ১৫ তারিখের মধ্যে।

তারপর আবার দ্বিতীয় পর্যায়ে আলোচনা হবে, যাতে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতপার্থক্য দূর করা যায় এবং একটি ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংস্কার কার্যকর করা যায়, যাতে সত্যি সত্যি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। এ জন্য ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান রাজনৈতিক দলগুলোকে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করার আহ্বান জানিয়েছেন, যাতে তারা তাদের মধ্যকার মতপার্থক্য কমিয়ে আনতে পারে। তারপরও মানুষ আশাবাদী হতে পারছে না যে তাদের চাওয়া অনুযায়ী একটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে? অথচ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ইতিমধ্যে বলেছেন, এত চমৎকার অনুষ্ঠান হবে এবার বাংলাদেশে যে সারা বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রইবে।

আমার উদ্বেগ নিজেদের মধ্যে যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে, সেটা নিয়ে। অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, তিনি কোনো সংস্কার চাপিয়ে দেবেন না। যতখানি পর্যন্ত ঐকমত্য হবে, ততখানি পর্যন্ত সংস্কার করবেন এবং তারই ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। কিন্তু এখন তো নির্বাচনের সময় নিয়েই সরাসরি মতপার্থক্য হচ্ছে। কী করবেন মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর সরকার? আলী রীয়াজ বলেছেন, মৌলিক বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করার জন্য কথা বলুন নিজেদের মধ্যে। তাতেও যদি ঐকমত্য না হয়?

কোনো সন্দেহ নেই বর্তমান সরকার এবং তাদের নিয়োজিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সংস্কার প্রশ্নে দৃশ্যত দিবারাত্রি পরিশ্রম করছে। এ জন্য তারা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে ১৬৬টি প্রশ্ন উত্থাপন করেছে, যার ওপর দলগুলো তাদের মন্তব্য বা মতামত পেশ করছে। একেকটা দল যেভাবে তাদের মতামত প্রকাশ করছে, তাতে কমপক্ষে এক শর ওপর প্রশ্নে দলগুলো ঐকমত্য প্রকাশ করেছে। কিন্তু এই মুহূর্তে দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি একটি মৌলিক বিষয়ে দ্বিমত পোষণ করেছে। সেটা হচ্ছে, সংবিধান সংশোধনের প্রশ্নে তারা মনে করছে সংসদকে এড়িয়ে গিয়ে এটা করা সম্ভব নয়।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যেসব বিষয়ে মতপার্থক্য হচ্ছে, সে বিষয়ে অল্প একটু আলোচনা করে নেওয়া ভালো হবে। ছোটখাটো দু-চারটি বিষয়ের কথা বলি। যেমন প্রধানমন্ত্রী দুবারের বেশি থাকতে পারবেন কি না, দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ ও এর উচ্চকক্ষের গঠন, সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ইত্যাদি।

আমার মতে, এগুলো নিয়ে তেমন চিন্তিত হওয়ার বিষয় নেই। এগুলো নিয়ে হয়তো আলাপ-আলোচনা করে সমাধানে আসা যাবে। কিন্তু আদর্শ বা চিন্তাগতভাবে সরাসরি বিপরীতমুখী ভাবধারার সংস্কারের কথা বলছেন কেউ কেউ। যেমন কেউ কেউ খেলাফত প্রতিষ্ঠা করতে চান, কিংবা ইসলামিক রাষ্ট্র গঠন করতে চান; বহুত্ববাদের বিরোধিতা করেন। বিপরীত পক্ষে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলেন, গণতান্ত্রিক ও সেক্যুলার রাষ্ট্রের কথা বলেন। এগুলোর নিষ্পত্তি হবে কীভাবে?

এগুলো হলো বিশ্বাসের ব্যাপার এবং বিশ্বাসের জন্য মানুষ জীবন দিয়ে দিতে পারে। না, আমি এ কথা বলছি না যে পরিস্থিতির ততটা অবনতি হয়েছে। কিন্তু নারীনীতি নিয়ে আমরা ধৈর্যের অভাব দেখেছি। স্পষ্টত নারীদের অপমান করে কথা বলা হয়েছে। অথচ এই নারীরা বিগত স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। ঐকমত্য কমিশনের ভাইস চেয়ারম্যান ৭ তারিখে নাগরিক ঐক্যের সঙ্গে আলোচনাকালে রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে আহ্বান জানিয়েছেন মৌলিক বিষয়ে যেসব মতপার্থক্য আছে, সেগুলো নিয়েও নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করতে। সে রকম আলোচনা কি হবে?

আগস্টের অভ্যুত্থানের পর এটা আশা করে গিয়েছিল যে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন দেখা যাবে। এখন পরস্পরের প্রতি ভালোবাসা–শ্রদ্ধা বেড়ে যাবে, আমাদের আচরণে–উচ্চারণে তার প্রকাশ ঘটবে; আমরা কাউকে স্বৈরাচারের ভাষায় হুমকি দিয়ে কথা বলব না। কাউকে ভয় দেখাব না, অপমান করব না। বরং সব ব্যাপারেই আমরা ধৈর্যশীল হব। সেই যে গণতন্ত্রের অমোঘ বাণী আছে; আমি তোমার কথার সঙ্গে একমত হতে না পারি, কিন্তু তোমার কথা বলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য প্রয়োজনে আমি জীবন দিতে রাজি আছি। এ রকম মনোভাব গড়ে উঠবে রাজনীতির অঙ্গনে।

কিন্তু সে রকম কোনো উদ্যোগ যে আজ পর্যন্ত গ্রহণ করা হয়েছে, তার কোনো খবর আমরা জানি না। বরং একরকম পাল্টাপাল্টি শুরু হয়েছে তা দেখছে জনগণ এবং তাতেই তাদের উদ্বেগ বাড়ছে। ইতিমধ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে হানাহানি হয়েছে, নিজেদের মধ্যে হানাহানিতে মানুষ মারা গেছে। কোথাও নবগঠিত এনসিপি অভিযোগ করেছে, তাদের ওপর হামলা করা হচ্ছে, সভা করতে দেওয়া হচ্ছে না এবং প্রশাসন একটি বিশেষ দলকে বিশেষ সুবিধা প্রদান করছে।

জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী ছাত্রনেতৃত্বের উদ্যোগে গঠিত নতুন দল এনসিপি। সংগতভাবে তাদের মধ্যেই সম্ভবত এই অভ্যুত্থান নিয়ে অভ্যুত্থানে শহীদ হওয়া মানুষগুলোর জন্য দরদ বেশি। অন্যদের দরদ যে কম, সেটা আমি বলছি না।

কিন্তু এটাও সত্য, বয়স ও অভিজ্ঞতার কারণেই বয়স্করা দরদ বুকের মধ্যে চেপে রাখতে পারেন। এমনকি মাঝেমধ্যে কথায়ও সংযত থাকতে পারেন। হয়তো তরুণেরা ততখানি পারেন না। কিন্তু বিষয়টা যখন রাজনীতি, তখন তা প্রেম-ভালোবাসার আবেগ দিয়ে নির্ধারিত হয় না। যে পৈশাচিকতা, নিষ্ঠুরতা, নৃশংসতা দিয়ে পরাজিত স্বৈরাচার ক্ষমতা টিকে রাখতে পাখির মতো গুলি করে মানুষ হত্যা করেছিল, আজ বিজয়ের পর সেই রক্তের প্রতিশোধ চাই। এটাই সংগত, ন্যায্য। এই চাওয়ার মধ্যে কোনো দোষ নেই। কিন্তু এই না হলে দেশে নির্বাচন হবে না, গণতন্ত্র আসবে না—এই চাওয়ার মধ্যে ভুল আছে। এনসিপি এ রকম করেই বলেছে এবং কোনো কোনো দল তাদেরকে এই বক্তব্যে সমর্থন করেছে। মনে হচ্ছে নির্দিষ্ট চিন্তার ভিত্তিতে একটা ঐক্য প্রচেষ্টা চলছে।

৫ তারিখে প্রেসক্লাবে ডিপ্লোমেটিক করেসপনডেন্ট বাংলাদেশের (ডিকাব) এক অনুষ্ঠানে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাংলাদেশে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার বলেন, বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের আগে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে পর্যাপ্ত সময় দেওয়ার পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন। তিনি এ–ও বলেন, নির্বাচন কবে হবে, সে সিদ্ধান্ত নেবে বাংলাদেশ। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এ জন্য কাউকে চাপ দেবে না।

সে তো ভালো কথা। কিন্তু একটু পর্যাপ্ত সময় মানে কী? মিলার কি একটু সেই ভাষায় কথা বললেন না, যাঁরা বিলম্বে নির্বাচন চান?

কিন্তু আমার উদ্বেগ সেটা নিয়ে নয়। আমার উদ্বেগ নিজেদের মধ্যে যে বিভাজন দেখা যাচ্ছে, সেটা নিয়ে। অধ্যাপক ইউনূস বলেছেন, তিনি কোনো সংস্কার চাপিয়ে দেবেন না। যতখানি পর্যন্ত ঐকমত্য হবে, ততখানি পর্যন্ত সংস্কার করবেন এবং তারই ভিত্তিতে নির্বাচন হবে। কিন্তু এখন তো নির্বাচনের সময় নিয়েই সরাসরি মতপার্থক্য হচ্ছে। কী করবেন মুহাম্মদ ইউনূস এবং তাঁর সরকার? আলী রীয়াজ বলেছেন, মৌলিক বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করার জন্য কথা বলুন নিজেদের মধ্যে। তাতেও যদি ঐকমত্য না হয়?

  • মাহমুদুর রহমান মান্না নাগরিক ঐক্যের সভাপতি

    [মতামত লেখকের নিজস্ব]