বিশ্বরাজনীতিতে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি একটি বহুল আলোচিত ও বিতর্কিত ইস্যু। পশ্চিমা শক্তিগুলো, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েল, বহু বছর ধরে অভিযোগ করে আসছে, ইরান নাকি গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) বা যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব গোয়েন্দা সংস্থাগুলো আজ পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি, যা এ দাবিকে প্রতিষ্ঠিত করে। অন্যদিকে ইরান শুরু থেকেই বলে আসছে যে তাদের পরমাণু কর্মসূচি সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত।
প্রশ্ন হলো, যদি ইরান সত্যিই পারমাণবিক অস্ত্র বানাতে চাইত, তাহলে গত দুই দশকে তা তৈরি করেনি কেন? আর যদি তা না-ই চায়, তাহলে উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে কেন? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পেতে হলে ইরানের ধর্মীয় অবস্থান, কৌশলগত চিন্তা, রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির দ্বিচারিতা একত্রে বিশ্লেষণ করতে হবে।
ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা ও নৈতিক অবস্থান
২০০৩ সালে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি ঐতিহাসিক ফতোয়া জারি করেন। সেখানে স্পষ্টভাবে বলা হয়, ‘পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি, মজুত কিংবা ব্যবহার ইসলামের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ হারাম।’ এ সিদ্ধান্ত শুধুই ধর্মীয় নয়, বরং একটি নৈতিক অবস্থানও, যেখানে নিরীহ মানুষ হত্যাকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। পারমাণবিক বোমা শুধু সামরিক লক্ষ্যবস্তু ধ্বংস করে না, বরং শহর, জনপদ ও লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ হরণ করে। ইসলামের যুদ্ধনীতিতে বেসামরিক নাগরিকদের হত্যা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
ইরান মনে করে, পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার শুধু মানবতার বিরুদ্ধে নয়, পরিবেশ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বিরুদ্ধে চরম অন্যায়। হিরোশিমা-নাগাসাকির দৃষ্টান্ত এ বিষয়ে যথেষ্ট প্রমাণ দেয়।
কৌশলগত ও সামরিক বাস্তবতা
অনেকের ধারণা, পারমাণবিক অস্ত্র থাকলেই একটি দেশ নিরাপদ থাকে। কিন্তু বাস্তবতা ভিন্ন। পাকিস্তান ১৯৯৮ সালে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করলেও ২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মুখে আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানে অংশ নিতে বাধ্য হয়। উত্তর কোরিয়া পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে। এমনকি রাশিয়া, যাদের বিশ্বের সর্বোচ্চ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটোর সঙ্গে কৌশলগতভাবে চাপে পড়েছে। ইসরায়েলও অঘোষিত পারমাণবিক অস্ত্রধারী হওয়া সত্ত্বেও ইরানের ‘অপারেশন ট্রু প্রমিজ’-এ বড় ধরনের সামরিক ক্ষয়ক্ষতির শিকার হয়েছে।
এ বাস্তবতা ইরানকে বুঝিয়ে দিয়েছে, পারমাণবিক অস্ত্র নয়, কার্যকর প্রতিরোধক্ষমতা ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিই নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে। তাই তারা শক্তিশালী ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র, চালকবিহীন বিমান বা ড্রোন এবং কৌশলগত অস্ত্র নির্মাণে জোর দিয়েছে।
রাজনৈতিক ঝুঁকি ও আন্তর্জাতিক চাপ
এ কথা সত্য যে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর প্রয়োজনীয় ইউরোনিয়াম ইরানের রয়েছে। ইচ্ছা করলেই তা পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর প্রয়োজনীয় ৯০ মাত্রায় সমৃদ্ধ করা সম্ভব। কিন্তু তারপরও ইরান পারমাণবিক অস্ত্রের দিকে যাচ্ছে না। ধর্মীয় বাধা অতিক্রম করে ইরান যদি পারমাণবিক বোমা তৈরি করতে যায়, তাহলে অন্তত তিনটি বড় ঝুঁকি সামনে চলে আসবে বলে বিশ্লেষকেরা মনে করেন। এগুলো হলো—
১. কঠোর নিষেধাজ্ঞা: ১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের পর থেকে ইরানের বিরুদ্ধে নানা নিষেধাজ্ঞা দিতে থাকে যুক্তরাষ্ট্র। ২০০৫ সালের পর থেকে ইরান–সম্পর্কিত দেড় হাজারের বেশি নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। নতুন করে মার্কিন কিংবা জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হলে জনগণের ওপর চাপ আরও বাড়বে।
২. মিত্রদের সমর্থন হারানো: রাশিয়া ও চীনের মতো মিত্রদেশগুলোর পক্ষেও তখন ইরানকে প্রকাশ্য সমর্থন দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এনপিটির সদস্য হিসেবে তারা চাইবে না নতুন কেউ পারমাণবিক শক্তিধর হোক।
৩. ইসরায়েলি ও মার্কিন হামলা: গত ১৩ ও ২২ জুন ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র যৌথভাবে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায়। তাদের অভিযোগ ছিল ইরান পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর কাছাকাছি রয়েছে। আর যদি বোমা বানায়, তাহলে তারা সম্মিলিতভাবে হামলা চালাবে, এতে সন্দেহ নেই।
আন্তর্জাতিক চুক্তি ও দ্বিমুখিতা
ইরান ১৯৬৮ সালের পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির (এনপিটি) সদস্য। সেই অনুযায়ী, তারা শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের অধিকার রাখে। ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত জয়েন্ট কম্প্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) অনুযায়ী, ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ সীমিত রাখে এবং আইএইএর পরিদর্শনে সম্মতি দেয়। কিন্তু ২০১৮ সালে ট্রাম্প প্রশাসন একতরফাভাবে চুক্তি থেকে বেরিয়ে যায়, ফলে ইরানও কিছু ক্ষেত্রে অবস্থান পাল্টায়।
এরপরও ইরান ৯০ শতাংশ সমৃদ্ধ ইউরেনিয়াম উৎপাদন করেনি, যেটি অস্ত্র তৈরির জন্য প্রয়োজন। তা সত্ত্বেও গত ১৩ জুনের হামলার আগে আইএইএ ইরানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলে এবং কয়েক দিন পরেই ইসরায়েল হামলা চালায়। পরে যুক্তরাষ্ট্রও হামলায় যুক্ত হয়। এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইরান সংস্থাটির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে এবং আইএইএর সঙ্গে সম্পর্ক স্থগিত করে। সংস্থার প্রধান রাফায়েল গ্রোসির সফরের অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করে।
ইরান কেন উচ্চমাত্রায় ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করছে
যদিও ইরান সরকার পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির বিরুদ্ধে স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছে এবং সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি একটি ধর্মীয় ফতোয়া জারি করে একে ‘হারাম’ ঘোষণা করেছেন, তারপরও দেশটি ৬০ শতাংশ পর্যন্ত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ চালিয়ে যাচ্ছে। বিশ্লেষকেরা একে চাপ প্রয়োগের কৌশল হিসেবে দেখছেন।
এই সমৃদ্ধকরণ ইরানের জন্য কয়েকটি কৌশলগত সুবিধা আনে।এক. আলোচনায় প্রভাব বাড়ানো। বিশেষ করে জেসিপিওএ চুক্তি পুনরুজ্জীবনের জন্য প্রয়োজনে অল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্র-মানের ইউরেনিয়ামতৈরির সক্ষমতা অর্জন। দুই. আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমতা আনা। যেমন ইসরায়েলের পারমাণবিক অস্ত্রভান্ডার ও সৌদি পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার প্রেক্ষাপটে এবং জাতীয় মর্যাদা ও প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে পারমাণবিক প্রযুক্তি রক্ষা।
সুতরাং বোমা বানানোর ঘোষণা না দিলেও ইরান এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করেছে, যাতে প্রয়োজনে পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জন করা যায় এবং এর মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নিজেদের অবস্থানকে শক্তিশালী করা সম্ভব হয়।
যুক্তরাষ্ট্র-ইসরায়েলের দ্বিচারিতা
যুক্তরাষ্ট্র ইরানের পরমাণু কর্মসূচির বিরুদ্ধাচরণ করলেও ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের আগে ওয়াশিংটন নিজেই তেহরানকে পারমাণবিক প্রযুক্তি সরবরাহ করেছিল। কিন্তু বিপ্লবের পর সেই ইরানকেই হুমকি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
অন্যদিকে ইসরায়েল কখনোই এনপিটিতে স্বাক্ষর করেনি। কিন্তু ধারণা করা হয়, তারা ৮০ থেকে ৪০০টি পারমাণবিক বোমার মালিক। কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থাই তাদের জবাবদিহির আওতায় আনে না। অথচ যুক্তরাষ্ট্র তেল আবিবকে সব ধরনের সহয়তা দিয়ে যাচ্ছে। এই দ্বিচারিতাকে বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি অভিহিত করেছেন, ‘যে অস্ত্র ইসরায়েলের হাতে নিরাপত্তা, সেটি ইরানের হাতে হুমকি—এটাই বিশ্বরাজনীতির ভণ্ডামি।’
শক্তি নয়, নীতি
ইরান জানে, পারমাণবিক বোমা কেবল নৈতিকভাবে নয়, কৌশলগতভাবেও আত্মঘাতী। তাই তারা অস্ত্রের নয়, নীতির পথ বেছে নিয়েছে। শান্তিপূর্ণ পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং সেই অধিকার রক্ষাই ইরানের লক্ষ্য। আন্তর্জাতিক সমাজের উচিত এ অবস্থানকে সম্মান জানিয়ে কূটনৈতিক সমাধানে এগিয়ে আসা। চাপ নয়, সংলাপই পারে উত্তেজনার পথ থেকে বিশ্বকে ফিরিয়ে আনতে। একটি ন্যায্য ও নিরাপদ বিশ্ব গড়তে হলে দ্বিচারিতা নয়, চাই আন্তরিকতা ও সম্মানভিত্তিক অংশগ্রহণ।
আশরাফুর রহমান রেডিও তেহরানের সাংবাদিক
*মতামত লেখকের নিজস্ব