কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যত গর্জন, তত বর্ষণ হবে?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) যুগ হয়তো শেষ পর্যন্ত চলেই এল। ওপেন এআইয়ের চ্যাটবটগুলো গত নভেম্বর থেকেই তাদের যাত্রা শুরু করে দিয়েছে। এখন এমন এক দিনও যাচ্ছে না, যেদিন তাদের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। 

এখন কথা হচ্ছে, এই এআইয়ের যে এত উত্থান, তাতে অর্থনীতিতে কী প্রভাব পড়বে? গোল্ডম্যান স্যাকসের গবেষণায় বলা হচ্ছে, এর ফলে আগামী ১০ বছরে সারা পৃথিবীর বার্ষিক জিডিপিতে ৭ শতাংশ বৃদ্ধি হবে, অর্থাৎ তাতে ৭ ট্রিলিয়ন ডলার যোগ হবে। যেসব প্রতিষ্ঠান এ প্রযুক্তি গ্রহণ করবে, তাদের বার্ষিক শ্রম-উৎপাদনশীলতা বাড়বে ৩ শতাংশ। এ রকম আরও কিছু গবেষণায় অনেক আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে এখনো তেমন কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না; বরং অনেকে বলছেন, তাঁরা আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে এমন কিছু ঘটবে বলেও মনে করছেন না। অতীতের অভিজ্ঞতাও তা–ই বলে। অতীতে কখনো কোনো প্রযুক্তি এককভাবে কোনো অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে পরিবর্তন আনতে পারেনি। অনেকে যে বলেন, ‘স্পিনিং জেনি’ আবিষ্কারের ফলেই অষ্টাদশ শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লব সংগঠিত হয়েছে, আসলে তা নয়। সেখানে অনেক বিষয় কাজ করেছিল, যেমন কয়লার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার, সম্পত্তির অধিকারের ক্ষেত্রে পরিবর্তন, বিজ্ঞানের অগ্রগতি ইত্যাদি। অনেকে যে মনে করেন, রেললাইন আমেরিকান অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে—নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ রবার্ট ফগেল সেটাকে ভুল প্রমাণ করেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, রেললাইনের কারণে ১৮৯০ সালের ১ জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু আয় যেখানে গিয়ে দাঁড়ায়, সেটা রেললাইন না হলেও ওই একই বছর ৩১ মার্চের মধ্যে সেই জায়গায় পৌঁছে যেত।

এআইয়ের ক্ষেত্রে বাড়তি যে সমস্যা হবে, সেটা হলো নতুন একটা প্রযুক্তি এসে আগে যেমন কিছু কোম্পানিকে একচেটিয়া ব্যবসা করার সুযোগ করে দিত, সে তেমনটা দিতে পারবে না। আগে ফোর্ড বা রকফেলাররা যে সুযোগ পেয়েছেন অথবা সাম্প্রতিক কালে জেফ বেজোস বা মার্ক জাকারবার্গরা যে ব্যবসা করেছেন, সেটা এআই কোম্পানিগুলো করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না। বাজারে এখন যত এআই আছে, সেগুলো প্রায় একই। ফলে ক্রেতারা কোনো একটা বিশেষ ব্র্যান্ডের দিকে ঝুঁকছে না। আর বেশির ভাগ কোড বা কৌশল যেহেতু এখন অনলাইনে পাওয়া যায়, ফলে অপেশাদার লোকেরাও এখন নতুন নতুন মডেল তৈরি করে ফেলতে পারবে। 

প্রযুক্তি মানুষের চাকরি কেড়ে নেবে বলে যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা এখনো সত্যি হয়নি। অবাক ব্যাপার হচ্ছে, গত দশকে উন্নত বিশ্বে বেকারত্বের হার অর্ধেকে নেমে এসেছে। যেসব দেশে অটোমেশন ও রোবোটিকসের ব্যবহার সবচেয়ে বেশি, যেমন জাপান, সিঙ্গাপুর ও দক্ষিণ কোরিয়া, সেসব দেশে বেকারত্ব সবচেয়ে কম। আমেরিকান ব্যুরো অব লেবার স্ট্যাটিসটিকস দেখেছে, যেসব চাকরিকে আগে ঝুঁকিপূর্ণ মনে হয়েছিল, সেগুলোকে এখন আর তেমন ঝুঁকিপূর্ণ মনে হচ্ছে না। বরং যেটাকে ‘চাকরি তৃপ্তি’ বলে, ২০১০–এর দশকে আমেরিকানদের সেই তৃপ্তি বেড়েছে।

তবে কোনো কোনো কোম্পানিতে যে ছাঁটাই হয়নি, তা নয়। অনেকে মনে করছেন, ২০২০ সালে কোভিডের সময় যুক্তরাষ্ট্রে যে ১৫ শতাংশ বেকারত্ব বেড়েছিল, সেই অবস্থা আবার হতে পারে। তবে এটাও ঠিক, প্রযুক্তি আসার সঙ্গে সঙ্গে যে মানুষের চাকরি চলে যায়, সেটা আগে খুব একটা দেখা যায়নি। যেমন ১৮৯২ সালে যখন স্বয়ংক্রিয় টেলিফোন সুইচিং সিস্টেম চালু হয়, তখন কিন্তু অপারেটরদের চাকরি চলে যায়নি; বরং আমেরিকান অপারেটরদের সংখ্যা তখন বেড়ে যায়—মধ্য বিংশ শতাব্দীতে এসে সেটা ৩ লাখ ৫০ হাজারে দাঁড়ায় এবং এই পেশা ১৯৮০–এর দশক পর্যন্ত টিকে থাকে। এআইয়ের ক্ষেত্রে হয়তো আরও কম সময় লাগবে, কিন্তু যত দ্রুত এবং যত মানুষ চাকরি হারাবে বলে মনে করা হচ্ছে, তত দ্রুত এবং তত বেশি মানুষের চাকরি হারানোর লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। 

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বেশি, সেখানে প্রযুক্তি খুব বেশি সুবিধা করতে পারে না। যেমন সরকারের সবচেয়ে বেশি নিয়ন্ত্রণ যেহেতু থাকে শিক্ষা ও স্বাস্থ্যে, সেখানে প্রযুক্তি তুলনামূলকভাবে ধীরে আসে। উল্টো দিকে যেখানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ কম, সেখানে প্রতিযোগিতা বেশি থাকার কারণে প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার ঘটে। 

এখানে আশার বিষয় হচ্ছে, এআইয়ের কারণে যেসব পেশাকে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ মনে করা হচ্ছে, তাদের বেশির ভাগ সরকারনিয়ন্ত্রিত। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের মি. ফেলটনের গবেষণা মতে, সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ২০টি পেশার প্রথম ১৪টি শিক্ষকতার (বিদেশি ভাষা শিক্ষকের পেশা অন্যতম) সঙ্গে যুক্ত। একই কথা পুলিশ পেশার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এ কারণেই হয়তো ইতালি ইতিমধ্যে চ্যাটজিপিটিকে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে এবং একই পথে হয়তো হাঁটছে ফ্রান্স, জার্মানি ও আয়ারল্যান্ড। 

ফগেল তাঁর গবেষণায় এটা বলেননি যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে রেইল রোডের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। তিনি বলেছেন, সেটাকে যতটা গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়, আসলে তত গুরুত্বপূর্ণ ছিল না। একুশ শতকের মাঝামাঝি গিয়ে অন্য কোনো নোবেল বিজয়ী গবেষক এআই সম্পর্কে এই একই কথা বলবেন কি না কে জানে।

সৈয়দ মো. গোলাম ফারুক পিএসসির সদস্য এবং মাউশি ও নায়েমের সাবেক মহাপরিচালক