বার্লিনের প্রাচীর পতন: যেই রাতে সবকিছু বদলে গেল

বিভেদের দেয়াল ভাঙছেন পূর্ব জার্মানির এক নাগরিক, সালটি ১৯৮৯ফাইল ছবি: রয়টার্স

সেদিন সকালে পশ্চিম বার্লিনের বাসিন্দারা ঘুম থেকে উঠে রাস্তায় অদ্ভুত দৃশ্য দেখলেন। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখলেন, শত শত মানুষ পূর্ব বার্লিনের দিক থেকে পশ্চিম বার্লিনের কেন্দ্র কুডামের দিকে হেঁটে চলেছে। কোনো হইচই নেই। সবাই কেমন আতঙ্কগ্রস্ত। পশ্চিমে পা রেখেও বিশ্বাস হয় না তারা পশ্চিমে এসেছেন।

আগের দিন বিকেলে সবাই টেলিভিশনে সাবলস্কির সেই বিখ্যাত ঘোষণাটি শুনেছিল। পূর্ব জার্মানি কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর মুখপাত্র গুন্টার সাবলস্কি, ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের পশ্চিম বার্লিনে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন। যা কেউ ঠিকমতো বুঝতে পারেনি। অনেকেই ভাবল, হয়তো কেবল ভিসা সহজ হবে, কেউ কল্পনাও করেনি রাতারাতি বার্লিনের দেয়ালটা হারিয়ে যাবে।

৯ নভেম্বর সন্ধ্যা থেকেই শুরু হয় বার্লিনকে বিভক্ত করে রাখা ২৮ বছর আগের তৈরি প্রাচীর গুঁড়িয়ে দেওয়ার কাজ। ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞা থাকায় পশ্চিম না দেখা যুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্ম বাঁধভাঙা আনন্দে ছুটতে থাকে পূর্ব থেকে পশ্চিমের দিকে। আর পশ্চিমের মানুষ ছোটে পূর্বের দিকে। দীর্ঘদিনের না দেখা বন্ধু-স্বজন আর কেউবা ফেলে আসা অতিপরিচিত অতীতকে ফিরে পেতে। পুঁজিবাদ আর সমাজতন্ত্রের সব রক্তচক্ষু, আইনের বেড়াজাল শিথিল ও ম্লান হয়ে যায় দুই বার্লিনবাসীর মহামিলনে।

১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর সকাল, তখনও বার্লিন প্রাচীরের ওপর দাঁড়িয়েছিলেন পূর্ব জার্মানির সীমান্তরক্ষীরা। জনতাও জড়ো হয়েছিল, সেই দিনই শুরু হয় প্রাচীর ভাঙার কাজ
ফাইল ছবি: রয়টার্স
আরও পড়ুন

প্রাচীর ভাঙার ধ্বংসযজ্ঞ চলেছিল দুই রাত ধরে। প্রাচীর ভাঙার আনন্দে কেউ হেসেছে, কেউ কেঁদেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে প্রাচীর গোটা জার্মানিকেই মানসিকভাবে দ্বিখণ্ডিত করে রেখেছিল। সেই প্রাচীর ভাঙার আনন্দে হাজার হাজার পূর্ব আর পশ্চিম বার্লিনবাসী প্রাচীর পেরিয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করেছিল। সেই সময় জার্মানরা আবার বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল, জার্মানরা আবার এক হবে। প্রাচীর পতন-পরবর্তী ঘটনাগুলো আরও দ্রুত, আরও নাটকীয়।

বিভাজনের কেন্দ্রে ছিল যে দেয়াল, তা ভাঙার পর দেখা গেল আবেগঘন মিলন
ফাইল ছবি: রয়টার্স

তৎকালীন পশ্চিম জার্মান সরকার পূর্ব জার্মানিতে দ্রুত ঘটে যাওয়া এসব ঘটনায় হতবাক হয়েছিল। আর জার্মানির পূর্বাঞ্চলের জনগণ খুব শিগগির দুই জার্মানির পুনরেকত্রীকরণের ব্যাপারে তাগাদা দিচ্ছিল।

শেষ পর্যন্ত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মিত্রদেশগুলো এবং পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির নেতাদের ধারাবাহিক আলোচনার পর ১৯৯০ সালের ৩ অক্টোবর দুই জার্মানি একীভূত হয়। সেই সময় জার্মানির চ্যান্সেলর হেলমুট কোহল বলেছিলেন, ‘জার্মান জাতির গৌরব করার তেমন কিছু নেই। তবে বার্লিন প্রাচীরের পতন ও জার্মান জাতির একত্রীকরণ নিয়ে আমরা গর্বিত।’

বার্লিন প্রাচীরের দুই ধারে পূর্ব ও পশ্চিম জার্মানির জনগণ। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর
ফাইল ছবি : রয়টার্স

ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দায় নিয়েই জার্মানি বা বার্লিনের বিভক্তি এসেছিল। যুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ আর মানসিকভাবে বিপর্যয়সহ জার্মান জাতি নিজেদের বিভক্তি কোনো সময় চায়নি।

একাধারে যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সারা দেশ, স্বজন হারানোর বেদনা, যুদ্ধ বিজয়ী মিত্রশক্তির হাতে হাজার হাজার বন্দী, যুদ্ধের দায়ভার বহন, তারপর আবার দেশটির বিভক্তি। জার্মান জাতি এসব মানতে পারেনি। তবে নাৎসি হিটলারের জবরদখলের যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত ইউরোপের দেশগুলো ও তাদের নেতারা সেই সময়কার ফ্যাসিবাদী জার্মান রাষ্ট্রের বিভক্তি চেয়েছিলেন।

প্রায় ৮০ বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানরা প্রায় সমগ্র ইউরোপ দখল করে ফেলেছিল। যুদ্ধে প্রায় ছয় কোটি মানুষের মৃত্যু আর ইউরোপজুড়ে ধ্বংসলীলার চিহ্ন রেখে ১৯৪৫ সালের ৮ মে হিটলারের আত্মহননের মধ্য দিয়ে বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। তবে ইউরোপের দেশ ও জাতিসত্তাগুলোর মধ্যে ক্ষতচিহ্ন ও অবিশ্বাসবোধ রয়ে যায়।

বার্লিন প্রাচীর পতনের ৩৬ বছর পূর্ণ হলেও উভয় অংশের জনগণের চিন্তাচেতনার প্রাচীর এখনো ভেঙে পড়েনি। বলা যায়, ১৯৮৯ সালই ইতিহাসের শেষ ছিল না, বরং তা ছিল আসলে একটি জটিল বিপরীতমুখী সময়কে সমন্বিত করার সূচনাবিন্দু।

হিটলারের জার্মানি যে মিত্রশক্তির কাছে পরাজিত হয়, তার এক অংশে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইংল্যান্ড। যারা ছিল পুঁজিবাদী দর্শন ও অর্থনীতির ধারক। অন্য অংশে ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন, যারা ছিল সমাজতান্ত্রিক দর্শন ও অর্থনীতির ধারক। জার্মান জাতির পরাজয়ের সঙ্গে সঙ্গে জার্মানি ভাগের মাধ্যমে দুটি অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ব্যবস্থা চালু হয়েছিল-পশ্চিমে পুঁজিবাদ ও পূর্বে সমাজতন্ত্র। আর দুই জার্মানি তাদের পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ধারা নিয়েই এগিয়ে যাচ্ছিল।

আরও পড়ুন

আশির দশকের শেষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচভের শুরু করা গ্লাসনস্ত ও পেরেস্ত্রোইকা কর্মসূচির হাত ধরে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোতে অধিকতর গণতন্ত্র ও নাগরিক অধিকারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সেই আন্দোলনের ঢেউ লাগে সাবেক পূর্ব জার্মানিতেও।

১৯৮৯ সালের শেষের দিকে সাবেক পূর্ব জার্মানির বড় শহরগুলোতে প্রচণ্ড ঠান্ডা উপেক্ষা করে নাগরিক আন্দোলন এবং চার্চের ব্যানারে হাজার হাজার লোক রাস্তায় নেমে আসে। তারা গণতন্ত্র আর রাজনৈতিক সংস্কারের দাবি জানাতে থাকে।

গত শতকের ৫০ এর দশক, যখন দুই বার্লিনের মাঝে প্রাচীর উঠছিল
ফাইল ছবি: এপি

বার্লিন প্রাচীর ভেঙে পড়ার এক মাস আগে ১৯৮৯ সালের ৯ অক্টোবর পূর্ব জার্মানির নাগরিক আন্দোলনের ডাক দিয়েছিল। লাইপজিগের রাস্তায় নেমে আসে প্রায় ৭০ হাজার মানুষ। সেটাই ছিল পূর্ব জার্মানির সমাজতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে বৃহত্তম নাগরিক বিদ্রোহ। এরপর শুধু লাইপজিগ নয়, ছোট-বড় শহরসহ আন্দোলনের ঢেউ লাগে রাজধানী পূর্ব বার্লিনেও।

৪ নভেম্বর পূর্ব বার্লিনের প্রাণকেন্দ্র আলেক্সান্ডার স্কয়ারে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। নানা অস্থিরতার মধ্যে পূর্ব জার্মানির পার্টি সেক্রেটারি এরিখ হোনিকার পদত্যাগ করেন। ধস নামতে শুরু করে কমিউনিস্ট সরকারের অভ্যন্তরে, ৮ নভেম্বর পদত্যাগ করেন পূর্ব জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যরা। ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর পূর্ব জার্মানি কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকমণ্ডলীর মুখপাত্র গুন্টার সাবলস্কি পূর্ব জার্মানির নাগরিকদের পশ্চিম বার্লিনে যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেন।

এত গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর বিভক্ত জার্মানির ইতিহাসের কথা। কিন্তু বার্লিনের প্রাচীর পতনের পর জার্মান সমাজ ও রাজনীতি নিয়ে মানুষের উপলব্ধি কি! প্রাচীরের পতনের ৩৬ বছর অতিবাহিত হলেও জার্মানির দুই অংশের মানুষের মধ্যে একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রাচীরের অবসান এখনো ঘটেনি।

পাথর দিয়ে দেয়াল ভাঙছেন এক শিশু
ছবি : রয়টার্স

ইতিহাসের ধারাবাহিকতা থেকে যে দেশটি বিভক্ত এবং পরে একত্রীত হয়েছে, সেখানে আবার নব্য নাৎসি দলের আস্ফালন এখন সবাইকে শঙ্কিত করছে। জার্মানির পূর্বাঞ্চলের মানুষ, জার্মানির কট্টর জাতীয়তাবাদী অলটারনেটিভ ফর জার্মানি দলের বড় সমর্থক। সাম্প্রতিক কালের নির্বাচনগুলোতে দলটি ২০ থেকে ৩০ শতাংশ ভোট পাচ্ছে। জার্মানির পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন জোট সরকারের বিপরীতে তারা অন্যতম বিরোধী দল।

বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে, বিগত বছরগুলোতে সাবেক পূর্ব জার্মানিতে অনেক সংস্কার হলেও ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলগুলো বঞ্চিত এলাকাগুলোর মানুষের কাছ গিয়ে তাদের ভুলগুলো ভাঙাতে পারেনি। তবে পূর্বাঞ্চলে একটি বিশৃঙ্খল রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হওয়ার আগে তাদের মুখোমুখি হওয়ার সময় এখনো শেষ হয়ে যায়নি।

এই মুহূর্তে জার্মানিতে রক্ষণশীল কট্টরবাদী দল জার্মানির জন্য বিকল্প বা এ এফ ডি দলটির ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তা রাজনীতির আকাশে কালো মেঘ হিসাবে দেখা হচ্ছে। এই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জার্মান চ্যান্সেলর ফ্রীডরীশ মের্জের অভিবাসীদের নিয়ে একটি উক্তি নিয়ে নানা সমালোচনা হচ্ছে। উনি জার্মানির ‘সিটিস্কেপ’ বলতে দেশটিতে অভিবাসীদের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। বা অভিবাসীদের কারণে জার্মান শহরগুলোতে মানুষ কতটা নিরাপদ বোধ করে? যা মূলত রক্ষণশীল কট্টরবাদী দলগুলোই বলে থাকে।

বার্লিনে প্রাচীর এখন আর নেই, তবে ধরে রাখা হয়েছে তার স্মৃতি
ছবি: ডয়চে ভেলে

ফ্রিডরিখ মের্জের সমালোচকেরা ‘সিটিস্কেপ’ সম্পর্কে চ্যান্সেলর তার বক্তব্য দ্বারা আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছেন তা নিয়ে বিভ্রান্ত। অনেকেই বলেছেন চ্যান্সেলরর এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়ে তার জাতি ও বর্ণ বিদ্বেষী আচরণ ফুটে উঠেছে।

বার্লিন প্রাচীর পতনের ৩৬ বছর পূর্ণ হলেও উভয় অংশের জনগণের চিন্তাচেতনার প্রাচীর এখনো ভেঙে পড়েনি। বলা যায়, ১৯৮৯ সালই ইতিহাসের শেষ ছিল না, বরং তা ছিল আসলে একটি জটিল বিপরীতমুখী সময়কে সমন্বিত করার সূচনাবিন্দু।

  • সরাফ আহমেদ প্রথম আলোর জার্মান প্রতিনিধি

ই–মেইল: [email protected]

*মতামত লেখকের নিজস্ব