পুতিন এখন কেন আগের চেয়েও শক্তিশালী

ষষ্ঠবারের মতো প্রেসিডেন্টের পদে বসেছেন ভ্লাদিমির পুতিনছবি : এএফপি

২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেনে সর্বাত্মক অভিযান শুরুর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন এখন সবচেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছেন।

রাশিয়ার সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে ইউক্রেনীয় বাহিনীকে চেপে ধরেছেন এবং গত দুই সপ্তাহে বেশ কয়েকটি গ্রাম দখলে নিয়েছেন। আরও অনেকগুলো লক্ষণ বলছে, রাশিয়া তাদের শক্তি ক্রমাগত বাড়িয়ে চলেছে। এতে মনে হতে পারে, ইউক্রেনীয়দের ও পশ্চিমাদের পরাজয় বাস্তবে আরও সম্ভাব্য হয়ে উঠছে।

দেশের ভেতরে গত বছর ভাগনার গ্রুপের ইয়েভগেনি প্রিগোশিনের বিদ্রোহের মুখে পড়েছিলেন ভ্লাদিমির পুতিন। পরবর্তী সময়ে প্রিগোশিন বিমান বিধ্বস্ত হয়ে নিহত হন। ভ্লাদিমির পুতিনের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ অ্যালেক্সি নাভালনি ফেব্রুয়ারি মাসে সাইবেরিয়ার বন্দিশিবিরে মৃত্যুবরণ করেন।

ষষ্ঠবারের মতো প্রেসিডেন্টের পদে বসার পর পুতিন তাঁর মিত্রদেশ উত্তর কোরিয়া ও ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক আরও পোক্ত করে ফেলেছেন। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া তাদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় অস্ত্র ও গোলাবারুদের সরবরাহ নিশ্চিত করেছে।

এর ফলে রাশিয়া তাদের যুদ্ধ-যন্ত্রকে খুব ভালোভাবেই সচল রাখতে পারছে। এর বিপরীতে গত ছয় মাসে ইউক্রেনীয় বাহিনী পশ্চিমা সামরিক সহায়তা না পাওয়ায় কারণে ব্যাপক সমস্যায় পড়েছে।

এ ছাড়া ১৬-১৭ মে বেইজিং সফরে যান ভ্লাদিমির পুতিন। সেই সফরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখার ঘোষণা দেন।

বেইজিংয়ের সঙ্গে মস্কোর সম্পর্কের এই শক্তিশালী ধারাবাহিকতার বিপরীতে বলা যায়, কিয়েভের সঙ্গে ওয়াশিংটন কিংবা পশ্চিমা রাজধানীগুলোর সম্পর্ক ততটা টেকসই নয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের ভেতরেই দেখা যাচ্ছে স্লোভাকিয়া ও হাঙ্গেরি অব্যাহতভাবে ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করে আসছে।

১০ মে রাশিয়া খারকভ অঞ্চলে আক্রমণ অভিযান শুরু করে। এর মধ্যে তারা বেশ কয়েকটা গ্রাম দখলে নিয়েছে এবং ইউক্রেনের আরও ১০ কিলোমিটার ভেতরে প্রবেশ করেছে।

রুশ বাহিনীর বোমাবর্ষণ ও গোলাবর্ষণের মুখে খারকভ অঞ্চল থেকে এ পর্যন্ত ১০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। এর ফলে অঞ্চলটিতে মানবিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কেননা খারকভ শহরে এর মধ্যে দুই লাখ বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয় আশ্রয় নিয়ে রয়েছেন।

খারকভের সাম্প্রতিক সাফল্যের সঙ্গে গত কয়েক মাসে প্রায় এক হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ ফ্রন্টলাইনের কোথাও কোথাও ভূখণ্ড জয় করতে পেরেছে রুশ বাহিনী। যদিও এই সাফল্য ক্রেমলিনের দিকে খেলার হাওয়া ঘুরিয়ে দিতে পারবে না, কিন্তু এটা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ অর্জন।

পুতিন তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেন এবং তাঁর সরকারের লোকজন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হন না। দেশের ভেতরে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে এবং মিত্রদেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সাহায্যে পুতিন নীতি-কৌশলগত ভুলগুলো শুধরে নিতে পারেন।

গত বছর পাল্টা আক্রমণ করে ইউক্রেনীয় বাহিনী রুশ বাহিনীকে যতটা পিছু হটতে বাধ্য করেছিল, এ বছর রুশ বাহিনী তার চেয়েও বেশি অগ্রসর হতে পেরেছে। যদিও বাখমুত শহর দখলে নেওয়ার এক বছরের মধ্যে ইউক্রেনের একটি মাত্র শহরের (আবদিভকা) নিয়ন্ত্রণ নিতে পেরেছে রাশিয়া, কিন্তু ভূখণ্ডের হিসাবে তারা ইউক্রেনীয়দের কাছ থেকে ৫০০ বর্গকিলোমিটারের মতো জায়গা দখলে নিতে পেরেছে।

ইউক্রেনের ওপর রুশ বাহিনী চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্র ইউক্রেনের কাছে পৌঁছানোর পরও ইউক্রেন অস্ত্রের ঘাটতিতে ভুগছে।

পশ্চিমা মিত্ররা অব্যাহতভাবে বলে চলেছে, ইউক্রেনকে সহায়তা দেওয়ার বিষয়টি তাদের অগ্রাধিকারে রয়েছে, কিন্তু তারপরও শঙ্কা রয়েই গেছে। সবার চোখ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিকে। রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেনের জন্য সহযোগিতা কাটছাঁট করার ঘোষণা দিয়েছেন।

বর্তমান প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্র্যাট প্রার্থী জো বাইডেন ইউক্রেনকে সমর্থন দেওয়ার ব্যাপারে তার শক্ত অঙ্গীকার জানালেও দ্বিতীয় দফায় তার বিজয় নিয়ে অনিশ্চয়তা আছে।

পশ্চিমাদের মতের ভিন্নতা
রুশদের জব্দ করা সম্পদ ব্যবহার করে সেই মুনাফা থেকে কীভাবে ইউক্রেনকে সহযোগিতা করা যাবে, তা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছে। কিন্তু জি-৭-এর দেশগুলো এখনো একমত হতে পারেনি ইউক্রেনকে কীভাবে আর্থিকভাবে সহযোগিতাটা অব্যাহত রাখা যাবে। বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোতে স্থগিত করে রাখা রুশদের সম্পত্তি কীভাবে ব্যবহার করা যাবে, তা নিয়ে একমত হতে পারেনি।

এ বিষয়টি রাশিয়া যে শক্তিশালী আর ইউক্রেন ও পশ্চিমারা যে খানিকটা দুর্বল, সেটাই প্রকাশ করছে। দুই বছরের বেশি সময় ধরে রাশিয়া ইউক্রেনে নিষ্ঠুরভাবে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেনকে পশ্চিমারা যে অস্ত্র দিচ্ছে, সেই অস্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রে শর্ত বেঁধে দেওয়া হয়েছে। যদিও দুই বছর পর এসে ধীরে হলেও এই নীতি বদলাচ্ছে। ইউক্রেনীয় বাহিনী কোথায়, কীভাবে পশ্চিমা অস্ত্র ব্যবহার করবে, তা নিয়ে বিধিনিষেধ শিথিল করা হচ্ছে।

রাশিয়া তাদের সেনাবাহিনীতে বিপুলসংখ্যক তরুণকে নিযুক্ত করতে পেরেছে। তাঁদের আত্মত্যাগে গত বছর ইউক্রেনের পাল্টা আক্রমণ তারা ঠেকিয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল। আর এ বছর আক্রমণ অভিযান পরিচালনা করতে পারছে।

পক্ষান্তরে এই এপ্রিলে মাত্র ইউক্রেন তাদের সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলক নিয়োগসংক্রান্ত আইন সংস্কার করতে পারল। এর ফলে অপেক্ষাকৃত তরুণ, সুদক্ষ ও অস্ত্রে সুসজ্জিত যোদ্ধাদের পাবে ইউক্রেন। কিন্তু সেটা বাস্তব রূপ পেতে আরও অনেক দিন লেগে যাবে।

পুতিন তাঁর নিজের সিদ্ধান্ত নিজে নেন এবং তাঁর সরকারের লোকজন সেই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে কুণ্ঠিত হন না। দেশের ভেতরে বিভিন্ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে এবং মিত্রদেশগুলোর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের সাহায্যে পুতিন নীতি-কৌশলগত ভুলগুলো শুধরে নিতে পারেন।

অন্যদিকে ন্যাটোর ৩২ দেশ ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের ২৭ দেশ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে সব সময়ই ভিন্ন ভিন্ন পথে হাঁটে। সে কারণে একটা সুস্থির নীতি–কৌশল নেওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। ফলে ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে স্থায়ী সংকট তৈরি হয়েছে। এর ফলে ইউক্রেন হয়তো পরাজয়ের মুখে পড়ছে না, কিন্তু বিজয়ের পথও তৈরি হচ্ছে না।

পুতিনের শক্তিটা অবশ্য চূড়ান্ত নয়, আপেক্ষিক। ইউক্রেন ও পশ্চিমের জন্য পুতিনের এই শক্তিটা একই সঙ্গে বিপদের ও সুযোগের।

  • স্টেফান উলফ, ইংল্যান্ডের বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা বিষয়ের অধ্যাপক
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত