সংসদের বিরোধী দল, ক্ষমতার ভাগ ও রাজনীতির বৈপরীত্য

জাতীয় সংসদের অধিবেশনফাইল ছবি

করপোরেট গভর্ন্যান্স ইস্যুতে ‘টপ ডাউন ডিজায়ার’ (ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া) থেকে নীতি-সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যদের রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারণের ক্ষেত্রে তেমন প্রয়োগ দেখা গেল সর্বশেষ সংসদে। ভালো-খারাপের সিদ্ধান্তে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সময় আছে। তা সময়ের হাতে ছেড়ে দেওয়া বরং ভালো। তারপরও বিষয়টি নিয়ে আলাপ করি ইংল্যান্ডের ইউনিভার্সিটি অব হালের আইনের অধ্যাপক জসীম আলী চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি বাংলাদেশের বিরোধী দলকে ‘কো-অপ্টেড অপজিশন’(সহযোজিত বিরোধী দল) নাম দিতে চান।

ভূমিধস বিজয় নিয়ে ট্রেজারি বেঞ্চে বসা সরকারি দল নিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু প্রথম সংসদ থেকেই। সেই পরিস্থিতিতে সরকারকে ‘চেক অ্যান্ড ব্যালান্সে’র চালুনি অতিক্রম করতে বিরোধী দলে ছিলেন কিছু সংসদ সদস্য। একই অবস্থা হয়েছে এবারও। ৬২ জন স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য না জাতীয় পার্টি—কে হবে বিরোধী দল, এর নিষ্পত্তি তাঁরা করেননি। কারা বিরোধী দলের আসনে বসবে, তা ঠিক করেছেন কার্যত সংসদনেতা।

ব্যক্তি বা ব্যক্তিসমষ্টি (এজেন্সি/দল/করপোরেশন) যেকোনো তৎপরতায় সংশ্লিষ্ট হয় শনাক্তযোগ্য ব্যক্তিসত্তা (সাবজেক্টিভিটি) হয়ে ওঠার জন্য, তাত্ত্বিক ও বুদ্ধিজীবী তালাল আসাদ এমনটা মনে করেন। এরপরও মাঝেমধ্যে এমনভাবে শনাক্ত করা হয় যে তার জন্য যা রীতিমতো অবমাননাকর। যে পরিস্থিতির মূর্ত উদাহরণ আমাদের বিরোধী দল (সংসদীয়) জাতীয় পার্টি।

এমন অরুচিকর অভিধায় ভূষিত করা হয় সংসদের বিরোধী দলকে, যে শব্দ আসলে অসংসদীয়। নিশ্চিতভাবে ভদ্রতার চালুনিতে আটকে যাবে, তা যদি সংসদে উচ্চারিত হয়। কিন্তু জনপরিসরে বিরোধী দলকে এমন সব কটুবাক্য শুনতে হয়। অথচ প্রথম সংসদে বাকি সদস্যদের প্রয়াত নেতা জিল্লুর রহমান ‘তথাকথিত বিরোধী দল’ বলায় উত্তাপ ছড়িয়েছিল। তখন ‘তথাকথিত’ শব্দের যে শ্লেষ ছিল, এখন চারপেয়ে জন্তুর সঙ্গে তুলনা করলেও সেই শ্লেষ জাগে না।

সংবিধানের ১৫২ অনুচ্ছেদে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে: ‘রাজনৈতিক দল বলিতে এমন একটি অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি অন্তর্ভুক্ত, যে অধিসঙ্ঘ বা ব্যক্তিসমষ্টি সংসদের অভ্যন্তরে বা বাহিরে স্বাতন্ত্র্যসূচক কোন নামে কার্য করেন এবং কোন রাজনৈতিক মত প্রচারের বা কোন রাজনৈতিক তৎপরতা পরিচালনার উদ্দেশ্যে অন্যান্য অধিসঙ্ঘ হইতে পৃথক কোন অধিসঙ্ঘ হিসাবে নিজদিগকে প্রকাশ করেন।’

আদর্শ সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ‘গভর্নমেন্ট ইন ওয়েটিং’ ভাবা হয়। এখন কেউ অপেক্ষা করতে চায় না। ক্ষমতার ভাগ নিতে বিরোধী দলে থেকেও সরকারের অংশ হতে চায়। রাজনীতি যেন তার বৈপরীত্যকেই বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধারণ করেছে।

জাতীয় সংসদে সরকারের বিরোধিতাকারী দলগুলো বিরোধী দল হিসেবে পরিচিত। বিরোধী দল হতে হলে ন্যূনতম কতজন সংসদ সদস্য থাকতে হবে, তা-ও সংবিধান কিংবা সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে উল্লেখ নেই। তবে বিরোধী দলের নেতা কে হবেন, তা উল্লেখ আছে কার্যপ্রণালিবিধিতে। এসব সাংবিধানিক বিধানাবলি আর প্রয়োগকলা মাথায় রেখে বলা যায় সংসদীয় বিরোধী দল ইস্যুতে আমাদের সংসদ এক যেন ‘ল্যাবরেটরি’।

আওয়ামী লীগের সমচেতনাসম্পন্ন রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ গড়ে ওঠেনি। এটা অস্বীকার করা যাবে না, হেফাজত ইসলামের মতো ধর্মীয় সংগঠনের সঙ্গে ‘আপস’ করে আওয়ামী লীগও ‘পলিটিক্যাল ফ্যালাসির’ জন্ম দিয়েছে। এ রকম অবস্থায় গণতন্ত্রের বিকাশের জন্য প্রয়োজন অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনীতি করা দলগুলোর ঐকমত্য।

স্বতন্ত্র সংসদ সদস্যরা মিলে সরকার ও বিরোধী উভয় দলের রাজনৈতিক আদর্শের সমরূপতা বরং নতুন সংসদীয় ধারার জন্ম দিতে পারে। আনুষ্ঠানিক বিরোধী রাজনৈতিক দলের অনুপস্থিতিতে এমন উদ্যোগ সংসদীয় উদাহরণও তৈরি করতে পারে। পলিটিক্যাল সায়েন্টিস্ট আর্নেস্ট বার্কার বিরোধী দলকে রাজনৈতিক ব্যবস্থার ‘সেফটি ভাল্‌ভ’ বলে অভিহিত করেন।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির ভূমিধস বিজয় অনিশ্চিত করেছিল ভারতের আইনসভায় বিরোধী দল নির্ধারণের বিষয়টি। এতে একটি বড় সংকট তৈরি হয়েছে। আর এই সংকটের নাম বিরোধীদলীয় নেতা নির্বাচন। কংগ্রেস দক্ষিণ এশিয়ায় ইতিহাসের প্রাচীন সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল, অথচ মোট আসনসংখ্যার ১০ শতাংশ আসন না পাওয়ায় সংসদীয় ব্যবস্থায় এক সংকট তৈরি হয়েছিল।

ভারতের সংসদীয় রীতি অনুযায়ী, বিরোধী দলনেতা ছাড়া সংসদীয় কাজকর্ম চলতে পারে না। সংসদীয় আইনে এমন অনেক বিষয় আছে, যেখানে বিরোধী দলনেতার অনুমোদন প্রয়োজন। যেমন সেন্ট্রাল ভিজিল্যান্স কমিশন, কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোপ্রধানের নিয়োগ বা লোকপাল নিয়োগ।

তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে নির্ধারিত আইন সংশোধন করে কাজ চলতে পারে। ১৯৫২ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত প্রথম পাঁচটি সংসদীয় নির্বাচনে কোনো বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন না। চতুর্থ লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস দুই ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। আর চরম ভরাডুবির কারণে বিরোধী দলের আসনেও বসতে পারেনি কংগ্রেস।

ইতিহাস বলে, আঠারো শতকের আগে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভিত্তিভূমি বলে পরিচিত ইংল্যান্ডেও বিরোধী দলের ধারণার উদ্ভব ঘটেনি। তবে প্রয়োজনের নিরিখে বিরোধী দলের ধারণার উদ্ভবের আগে ‘বিরোধী’দের কাজ কী, কেন দরকার বিরোধী দল, সেটা অনুভূত হতে শুরু করে। বিরোধীরা কেবল সরকারের বিরোধিতাই করবে না, তাঁরা বিকল্পও উপস্থাপনও করবে। দেশ শাসনে শামিল হবে পরামর্শ দিয়ে। এ কারণেই ইংল্যান্ডে সরকার ছাড়াও আরও রাজনৈতিক দলের উদ্ভব ঘটে।

আদর্শ সংসদীয় ব্যবস্থায় বিরোধী দলকে ‘গভর্নমেন্ট ইন ওয়েটিং’ ভাবা হয়। এখন কেউ অপেক্ষা করতে চায় না। ক্ষমতার ভাগ নিতে বিরোধী দলে থেকেও সরকারের অংশ হতে চায়। রাজনীতি যেন তার বৈপরীত্যকেই বৈশিষ্ট্য হিসেবে ধারণ করেছে।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট