পাকিস্তানের বেপরোয়া সরকার সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ মানতে অস্বীকার করেছে। আর শীর্ষ আদালতের ভেতরেই বিভাজন ক্রমে বিস্তৃত হচ্ছে। সব মিলিয়ে তৈরি হয়েছে খুব বিপজ্জনক অচলাবস্থা। সেনাসমর্থিত শাসনব্যবস্থা মরিয়া হয়ে চেষ্টা করছে একটি দৃঢ় বিচারব্যবস্থাকে পোষ মানানোর। আর তা রাষ্ট্রের সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে। চলমান সংঘাতের শেষ খেলা কোথায় কার হাতে আছে, তা অনিশ্চিত।
নড়বড়ে ক্ষমতাসীন জোট এবং পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশনের মধ্যে অশুভ মৈত্রী এই সংকটকে ডেকে এনেছে। ১২ জুলাই সর্বোচ্চ আদালত রায় দিয়েছেন, তেহরিক–ই–ইনসাফকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নারী ও সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত আসনের উপযুক্ত অংশ দিতে হবে। জোট ও নির্বাচন কমিশন এ রায় কার্যকর করতে অস্বীকার করেছে। এ এক নজিরবিহীন আচরণ।
শীর্ষ বিচারকদের মধ্যে অস্থিরতা জনগণ জানতে পারছে। রায় না মানার পেছনে এ ঘটনা উৎসাহ জুগিয়েছে, তা স্পষ্ট। বিদায়ী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে অন্য জ্যেষ্ঠ বিচারকদের প্রকাশ্য বিরোধ নওয়াজ শরিফের মুসলিম লীগ ভালোমতো কাজে লাগাচ্ছে। এই বিরোধ যত বড় হবে, তাদের পক্ষে শীর্ষ আদালতের আদেশ অমান্য করা তত সহজ হবে।
এটা খুবই স্পষ্ট যে আদালতকে নিজের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য সরকার প্রধান বিচারপতির ওপর বাজি ধরছে। প্রেসিডেন্ট কর্তৃক জারি করা সর্বশেষ অধ্যাদেশ কার্যত প্রধান বিচারপতির মাস্টার রোস্টার হিসেবে ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেছে। আগের আইনে তা সীমাবদ্ধ ছিল। মাস্টার রোস্টার মানে, কখন কোন বেঞ্চের শুনানি হবে, তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা।
অনেকেই পুরো বিষয়টিতে প্রধান বিচারপতি কাজী ফয়েজ ঈসার ভূমিকাকে দেশের শীর্ষ বিচারপতির কাছ থেকে অপ্রত্যাশিত বলে মনে করেছেন।
অধ্যাদেশ জারি হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে প্রধান বিচারপতি কী করলেন? তিনি বিচারপতি মুনিব আখতারকে অপসারণ করে তিন সদস্যের প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রসিডিউর কমিটি পুনর্গঠন করলেন। অথচ বিচারপতি মুনিব ছিলেন বিচারকদের মধ্যে তৃতীয় জ্যেষ্ঠ। বিচারপতি মনসুর আলী শাহ কমিটির অংশ হতে অস্বীকার করে অধ্যাদেশের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।
কমিটির অবিলম্বে পুনর্গঠনকে অপ্রয়োজনীয় এবং পছন্দমতো সদস্য অন্তর্ভুক্ত করাকে অগণতান্ত্রিক এবং ‘ওয়ান-ম্যান শো’ হিসেবে উল্লেখ করে বিচারপতি শাহ আদালতের কাছে অধ্যাদেশটির সম্পূর্ণ পর্যালোচনা চান। কিন্তু প্রশ্ন হলো, আগামী মাসে অবসরে যাওয়া প্রধান বিচারপতি সর্বোচ্চ আদালতের স্বাধীনতা ও পবিত্রতা রক্ষায় প্রস্তুত কি না। অনেকেই মনে করছেন যে তাঁর ভূমিকা বিচার বিভাগে বিভাজন উসকে দিয়েছে।
সর্বোচ্চ আদালতের এমন সব ঘটনা সরকারের আদালতকে আরও দুর্বল করার প্রয়াসকে উত্সাহিত করবে। এ খেলা বিপজ্জনক। এর মধ্য দিয়ে পুরো ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। দেশকে ঠেলে দিতে পারে নৈরাজ্যের দিকে।
সংরক্ষিত আসন পুনর্বণ্টনে অস্বীকৃতি সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের জন্য সরকারের পরিকল্পনার অংশ। এটি তথাকথিত বিচার বিভাগীয় সংস্কার উদ্যোগের আড়ালে শীর্ষ বিচার বিভাগের ক্ষমতা ছেঁটে দেওয়ার চেষ্টা। ক্ষমতাসীন জোট আগে চেষ্টা করে পার্লামেন্টে প্রয়োজনীয় সংখ্যার সদস্য সংগ্রহ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু তারা সে পরিকল্পনা ছেড়ে দেয়নি।
এদিকে সুপ্রিম কোর্টের রায় বাস্তবায়ন স্থগিত করতে নির্বাচনী বিধিমালায় পরিবর্তন এনেছে সরকার। জাতীয় পরিষদের স্পিকারও নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়ে বলেছে যে আদালতের আদেশ কার্যকর করা যাবে না। আদালতের আদেশ প্রকাশের পর সরকার ও বিচারকদের মধ্যে স্থবিরতা আরও তীব্র হয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
ফেডারেল আইনমন্ত্রী রায়কে সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেছেন। ঘোষণা করেছেন যে নির্বাচন আইনের সাম্প্রতিক সংশোধনগুলো সক্রিয় আছে। সুতরাং আইন অনুসারেই, আইনপ্রণেতাদের অবস্থান বিষয়ে অন্য কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, এমন অনেক প্রশ্ন রয়েছে বিস্তারিত রায়ে, যার উত্তর নেই। তিনি এ বিষয়ে অনড় যে পার্লামেন্টের আইন প্রণয়নের অধিকার সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ওপর অগ্রাধিকার পাবে।
সামরিক শাসনের সময় ছাড়া সরকার এত নির্লজ্জভাবে সুপ্রিম কোর্টের আদেশ অমান্য করেছে, এমন উদাহরণ নেই। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায়ে স্পষ্টভাবে বলা বলেছে, কোনো রাজনৈতিক দলকে নির্বাচন করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। তিনজন ভিন্নমত পোষণকারী বিচারক সম্মত হয়েছেন যে তেহরিক–ই–ইনসাফ সংসদীয় দল হিসেবে বিদ্যমান। আর তাই সংরক্ষিত আসনগুলোর প্রাপ্য অংশে তাদের অধিকার অস্বীকার করা যায় না। সরকার যেটা মানতে রাজি নয়, তা হলো তারা পছন্দ করুক বা না করুক, সুপ্রিম কোর্টের রায় সব রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক।
সর্বোচ্চ আদালতের রায় না মানা গুরুতর সাংবিধানিক সংকটের দিকে নিয়ে যাবে। এমন নজির রাষ্ট্রের পুরো কাঠামোকে ধ্বংস করে দিতে পারে। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা শুরু থেকেই সন্দেহজনক। তারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা প্রদানকারী নিরপেক্ষ সংস্থা হিসেবে কাজ করেনি। সর্বোচ্চ আদালতের আদেশ বাস্তবায়নে নির্বাচন কমিশনের অনীহা এই অভিযোগের প্রমাণ দেয় যে তারা চালিত হচ্ছে নিরাপত্তা সংস্থার নির্দেশেই।
এখন পাকিস্তানে যা হচ্ছে, তা মূলত চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন কমিশন পরিচালিত বিতর্কিত নির্বাচনের ফলাফল। কারচুপির নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ বৈধতার সরকারকে ক্ষমতায় এনে পুরো রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বিকৃত করে ফেলেছে।
এই রায় নির্বাচনী সংস্থার ভূমিকায় এক জঘন্য কালো ছোপ হয়ে থাকবে। এই সব ঘটনা থেকে বোঝা যাচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের বেআইনি কাজগুলো তেহরিক–ই–ইনসাফের জন্যই শুধু ক্ষতিকারক নয়; এর ফলে পুরো নির্বাচনব্যবস্থা, সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করার এখতিয়ার উল্লেখযোগ্যভাবে লঙ্ঘিত হবে। ফলে বর্তমান আইনি ও শাসনকাঠামোর প্রাতিষ্ঠানিক বৈধতাই ঝুঁকির মুখে পড়ে যাবে।
আদালতের রায়টি লিখেছেন বিচারপতি মনসুর আলী শাহ। তিনি সতর্ক করেছিলেন যে আদালতের আদেশ বাধ্যতামূলক। তা মানার ক্ষেত্রে যেকোনো ‘অসম্মতি’ গুরুতর পরিণতি ডেকে আনতে পারে। কিন্তু আদালত নিজেই এখন বিভক্ত। এমন অবস্থায় সর্বোচ্চ আদালত কি তার সাংবিধানিক কর্তৃত্ব এবং আইনের শাসন বজায় রাখতে পারবে? এখন সেই পরীক্ষা এসেছে সামনে। কিন্তু তার চেয়ে বড় কথা, এত সব বিপদের মধ্যেও কি কোনো রাজনৈতিক কাঠামো টিকে থাকতে পারে?
● জাহিদ হুসেইন, লেখক ও সাংবাদিক
ডন থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ জাভেদ হুসেন