তিমি ও ফিলিস্তিনি মানুষের মর্যাদা দিন

‘তিমিকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন নিউজিল্যান্ডের মাউরি রাজা। প্রথমে খবরটা তুলে ধরি: নিউজিল্যান্ডের মাউরি জনগোষ্ঠীর রাজা তিমিকে মানুষের মর্যাদা দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। সংকটাপন্ন এই প্রাণীকে রক্ষা করতে দেশটির সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে।

এ তথ্য দিয়েছে রুশ সংবাদমাধ্যম আরটি। এ নিয়ে বৃহস্পতিবার ‘ডিক্লারেশন ফর দ্য ওশান’ নামের একটি ঘোষণাপত্র প্রকাশ করেন মাউরি রাজা তুহেইতিয়া পোটাটাউতে ভেরোহেরো সপ্তম।

ঘোষণায় বলা হয়, ‘তিমির মধ্যে মানুষের মতো চলাফেরা, আচরণ ও নিজস্ব সংস্কৃতি প্রকাশের স্বতঃস্ফূর্ত ক্ষমতা রয়েছে। এতে মানুষের অনুরূপ মর্যাদা দেওয়া হলে তিমির সংরক্ষণ ও বংশবিস্তার ঝুঁকিমুক্ত হবে। তিমি অতিপ্রাকৃতিক প্রাণী হিসেবে পরিচিত মাউরিদের কাছে। নিউজিল্যান্ডের অনেক আদিবাসী তিমিকে সমুদ্রের দেবতা টাঙ্গারোয়ার পূর্বপুরুষ বলে মনে করেন।’ (যুগান্তর ২ এপ্রিল ২০২৪)

নিউজিল্যান্ডের আদিবাসী জনগোষ্ঠী হলো মাউরি। নিজ বাসভূমে যাঁরা পরবাসী হয়ে পড়েছিলেন, পশ্চিমা উপনিবেশকদের আগমন আর আগ্রাসনে। মাউরিদের রাজার এই আবেদনের পেছনে আছে প্রকৃতিকে রক্ষা করা, প্রাণবৈচিত্র্য এবং প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করার তীব্র আকাঙ্ক্ষা। তাঁরা হয়তো আশা করেছেন, মানুষ যদি তিমিকেও মানুষ হিসেবে বিবেচনা করে, তাহলে তিমি ধ্বংস করা বন্ধ করবে, তিমিকে রক্ষা করতে চাইবে।

তিমি বুদ্ধিমান প্রাণী। ১৯৮৬ সাল থেকে পৃথিবীতে তিমি মাছ শিকার নিষিদ্ধ। এরপরেও ২০২২ সালে দুই হাজারের মতো তিমি শিকার হয়েছে। এখন পৃথিবীতে নীল তিমি আছে ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজার। এদের রক্ষা করতে হবে।

মাউরি রাজার আবেদনে পৃথিবী যদি কর্ণপাত করে, তাহলে তা হবে এক বিশাল অগ্রগতি। সে ক্ষেত্রে আমরা আরেকটা আবেদন করতে চাই, ফিলিস্তিনি শিশু ও নারীদেরও যেন মানুষ হিসেবে ঘোষণা দেওয়া হয়। গত ছয় মাসে প্রায় ৩৩ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। আর ৭৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি আহত হয়েছেন। এঁদের তিন ভাগের দুই ভাগই নারী ও শিশু।

এখানে একটা নিষ্ঠুর কৌতুক বলতে চাই। বুশ সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, আমি ইরাকে এমন কঠিন আক্রমণ করব যে এক লাখ ইরাকি আর একজন বাইসাইকেলচালক মারা যাবে।

সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করল, এক লাখ ইরাকি নাহয় বুঝলাম, একজন বাইসাইকেলচালক কেন?

বুশ বললেন, বলেছিলাম কিনা, ইরাকিদের জীবন নিয়ে কেউ চিন্তিত নয়।

আমাদের এই একবিংশ শতাব্দীতে এই রকম একটা গণহত্যা সংঘটিত হচ্ছে। ২২ হাজার নারী-শিশু হত্যা করা হলো ছয় মাসে এবং হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলেছে। পৃথিবী নির্বিকার। একটু ঠান্ডা মাথায় ভাবলে প্রশ্ন জাগে, এটা হচ্ছে? এটা হতে পারে? এই পৃথিবী এটা হতে দিচ্ছে?

হ্যাঁ। এটা চলছে এবং ফিলিস্তিনিদের বিষয়ে কারও কোনো মাথাব্যথা নেই।

মানুষ যে মানুষ হয়নি, এই বিশ্বব্যবস্থা যে একটা চরম অন্যায়ের ওপরে প্রতিষ্ঠিত, এটা আমরা আবারও বুঝি গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যা থেকে। তবে এই রকম জুলুম-নিপীড়ন-হত্যা পৃথিবীর আরও অনেক জায়গাতেই ঘটছে।

মানুষ মানুষ হয়নি। মানুষ মানুষ হবে না। তিমিরা তিমি থাকলে হয়তো বাঁচতেও পারে। তিমিরা মানুষ হয়ে গেলে মানুষই তাদের বাঁচতে দেবে না। মানুষকে মারার জন্য মানুষের অ্যাটম বোমা আছে, ড্রোন আছে, স্যাটেলাইট আছে, সাবমেরিন আছে। সেসব তখন তারা ব্যবহার করবে তিমির বিরুদ্ধে।

বাঘের প্রধান শত্রু মানুষ। কিন্তু মানুষের প্রধান শত্রু বাঘ নয়। মানুষের প্রধান শত্রু মানুষ।

ফিলিস্তিনি কবি নজওয়ান দারবিশ আমাদের সঙ্গে আমেরিকার আইওয়াতে লেখক কর্মশালায় অংশ নিয়েছিলেন। জানি না তিনি এখন কোথায় আছেন, কেমন আছেন। তাঁর একটা কবিতা থেকে তুলে ধরি:

আমি দেখলাম তারা আমার চাচিদের থলেয় ভরছে

ব্যাগের কোনা বেয়ে ঝরছে তাদের উষ্ণ রক্ত

(কিন্তু আমার কোনো চাচি নেই)

আমি জানি তারা আমার তিন বছরের মেয়ে নাতাশাকে মেরে ফেলেছে

(কিন্তু আমার কোনো মেয়ে নেই)

আমাকে বলা হলো তারা আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে সিঁড়ি দিয়ে ছেঁচড়ে টেনে নিয়ে রাস্তায় ফেলে রেখেছে

(কিন্তু আমার বিয়ে হয়নি)

তারা বুটের নিচে যা মাড়াচ্ছে তা নিশ্চয়ই আমার চশমা

(কিন্তু আমি চশমা পরি না)

এখন যদি ভাবতে পারি, এই আমিটা আমিই। আমরাই। আমার চাচিকে থলেয় ভরছে, আমার তিন বছরের মেয়ে নাতাশাকে মেরে ফেলছে, আমার স্ত্রীকে ধর্ষণ করে সিঁড়ি দিয়ে ছেঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে, আর আমার চশমাকে বুটে দলছে। সমস্যা হলো আমরা তা করতে পারি না। কারণ, আমরা ভাবি, আমার কোনো চাচি নেই, আমার তিন বছরের মেয়ে নেই, আমি চশমা পরি না।

যদি ভাবতে পারতাম, ওই ফিলিস্তিনি শিশুটা আমার সন্তান, বাইডেন যদি এ রকম ভাবতে পারতেন, তাহলে হয়তো হতো। কিন্তু মানুষ হত্যাকারীর সঙ্গে সমানুভূতি বোধ করে, নিহতের সঙ্গে নয়।

  • আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক