ডাকসুর নেতারা লাঠি হাতে ঠিক কাদের তাড়াচ্ছেন?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ডাকসুর এক নেতার একজন প্রবীণ ব্যক্তিকে লাঠি হাতে শাসানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছেছবি : ভিডিও থেকে নেওয়া

ট্রাম্প থেকে শুরু করে মোদি—যেকোনো ডানপন্থী রাজনীতি টিকেই থাকে কোনো জনগোষ্ঠী কিংবা নাগরিকদের একটি অংশের বিরুদ্ধে ‘যুদ্ধ’ জারি রেখে। ঘৃণা হচ্ছে এই যুদ্ধের সবচেয়ে বড় অস্ত্র। জাতিকেন্দ্রিক হোক আর ধর্মকেন্দ্রিক হোক, জাতীয়তাবাদ ধরনের দিক থেকে এমনিতেই খারিজিমূলক। নয়া উদারবাদী বিশ্বব্যবস্থায় সম্পদের গরিষ্ঠ অংশ আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপের ঘষায় হাতে গোনা কয়েকজনের কাছে কেন্দ্রীভূত হওয়ায় দুর্বিষহ বেকারত্ব ও কায়দা করে বেঁচে থাকার সংগ্রামের মধ্যে বিশ্বের দেশে দেশে নতুন ধারার ডানপন্থার জোয়ার দেখা যাচ্ছে। এ ব্যবস্থায় প্রাণভোমরায় কোনো গোষ্ঠীকে এমনভাবে শয়তানরূপে আঁকা, যাতে মনে হবে, জনগণের সব দুর্ভোগের কারণ হচ্ছে সেই জনগোষ্ঠী।

দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প সে কারণেই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছেন। শিকলে বেঁধে সামরিক বিমানে করে অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে তথাকথিত ঘৃণার আগুনও আবার ডলারের তেজের কাছে পানি হয়ে যায়। ট্রাম্প নিজেই ঘোষণা দিয়েছেন, ৫০ লাখ ডলারে কেনা যাবে মার্কিন নাগরিকত্ব। ফলে এখানে ঘৃণা আর বিদ্বেষটাও রাজনৈতিক আর সিলেক্টিভ; অথচ যুক্তরাষ্ট্র দেশটাই গড়ে উঠেছে অভিবাসীদের হাতে।

দ্বিতীয় দফা ক্ষমতায় আসার পর ট্রাম্প সে কারণেই অভিবাসীদের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছেন। শিকলে বেঁধে সামরিক বিমানে করে অভিবাসীদের নিজ নিজ দেশে ফেরত পাঠাচ্ছেন।
ছবি : এএফপি

ভারতে মোদি, অমিত শাহ, যোগী আদিত্যের রাজনীতির প্রাণভোমরাও মুসলিম, দলিত ও আদিবাসীদের প্রতি ঘৃণা। এখানেও মূল শিকার গরিব ও প্রান্তিক লোকেরা। গরুর মাংস রপ্তানিতে ভারত বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ হলেও গোরক্ষার নামে ‘মব লিঞ্চিং’ সে কারণেই রাজনৈতিক বৈধতা পায়। বুলডোজারে বাড়িঘর, স্থাপনা গুঁড়িয়ে দেওয়াটাও রাজনৈতিক কর্তব্য হয়ে ওঠে। কেননা, তাতে সমর্থক গোষ্ঠীর মধ্যে উন্মাদনা তৈরি করা যায়, আফিমের নেশার মতো ভুলিয়ে রাখা যায় বাস্তব জীবনের দুর্বিষহ সংকটগুলোকে।

অভিবাসী খেদানো, বুলডোজারে গুঁড়ানো আর উচ্ছেদ বিশ্বজুড়ে ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী অভিধানের প্রিয় সব শব্দে পরিণত হয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভার্চু৵য়ালি এই যুদ্ধ জারি রাখা, অ্যালগরিদমকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য তারা ব্যাপক বিনিয়োগ করে। যেকোনো বিরোধী মতের মানুষের জন্য এই ভার্চ্যুয়াল যোদ্ধারা রীতিমতো আতঙ্কের নাম।

দুই.
ওয়ার আর টেররের দীর্ঘ দুই দশকের অভিঘাত, নয়া উদারবাদী ব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে সম্পদের পূঞ্জীভবন ও পাচার, হাসিনার দীর্ঘ কর্তৃত্ববাদী শাসন—বাংলাদেশের সমাজে পরিষ্কারভাবে ডানপন্থার উল্লম্ফন ঘটিয়েছে। বিশেষ করে শিক্ষিত তরুণদের বড় একটি অংশের মধ্যে ডানপন্থী রাজনীতির বিস্তার  ঘটেছে। সম্প্রতি ডাকসু, জাকসু, চাকসু ও রাকসু নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের নিরঙ্কুশ জয়ে তার ইঙ্গিত মিলেছে।

২০০৮ সালের পর দেশে কোনো গ্রহণযোগ্য নির্বাচন না হওয়ায় কত শতাংশ নাগরিক ডানপন্থার দিকে  ঝুঁকে পড়েছেন, সেটি ধারণা করা কঠিন। ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিয়ে দেশের সামগ্রিক রাজনীতির ল্যান্ডস্কেপ সম্পর্কে ধারণা করাটাও বাস্তবসম্মত নয়; কিন্তু মধ্যপন্থী ও উদারপন্থী রাজনীতি যে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে, সেটি স্পষ্ট।

গত কয়েক সপ্তাহে জাতীয় রাজনীতির পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মূলধারার গণমাধ্যমের খবর ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আলোচনা-তর্কবিতর্কের অন্যতম একটি কেন্দ্র হয়ে রয়েছে। ডাকসু নেতারা ক্যাম্পাস থেকে হকার, ভবঘুরে, ভাসমান পরিবার ও পথশিশুদের উচ্ছেদে রীতিমতো ‘যুদ্ধ’ ঘোষণা করেছেন। একজন তো এই হুমকি দিয়ে বসেছেন যে এ উচ্ছেদ অভিযান সফল না হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। শেষ পর্যন্ত তাঁকে পদত্যাগ করতে হয়নি। কেননা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন জোরালোভাবেই উচ্ছেদ অভিযানের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, ডাকসু নেতারা মিছিল নিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করছেন। মানুষের জীবিকার সম্বলগুলো ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। অভিযানের সময় কয়েকজন হকারকে পেটানোর অভিযোগও উঠেছে। এভাবে উচ্ছেদ করা যে কতটা ঠিক ও ন্যায্য, এর পক্ষে উচ্ছেদ অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া ডাকসুর একজন নেতাকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ডাকসুর একজন নেতাকে সাফাই গাইতে দেখা গেছে।

সংগঠনের অন্য নেতা-কর্মীরও এ কাজ যে বাংলাদেশের জন্য এই মুহূর্তের সবচেয়ে জরুরি কর্তব্য, তা প্রমাণে সংঘবদ্ধ প্রচারে নেমেছেন। যাঁরা এভাবে উচ্ছেদ ও পেটানোর সমালোচনা করেছেন, তাঁদের গাঁজাখোর, মাদকসেবী, চাঁদাবাজের সহযোগী তকমা দিয়েছেন। অতি সম্প্রতি আরেকটি ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ডাকসুর সেই আলোচিত নেতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রো স্টেশনের কাছে লাঠি হাতে একজন বৃদ্ধকে শাসাচ্ছেন।

সম্প্রতি সিলেটে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তারের সময়ও আন্দোলনে ‘মাদকসেবীরা’ অংশ নিয়েছিলেন বলে পুলিশ অভিযোগ করে।
ফাইল ছবি

এটা স্বীকার করতে হবে যে ঢাকায় জনপরিসরের তীব্র সংকট থাকায় সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিছুটা ‘উন্মুক্ত পার্কে’ পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে ছুটির দিনের সন্ধ্যাগুলোয় উপচে পড়া ভিড় দেখা যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক পরিবেশকে একটি শৃঙ্খলার মধ্যে আনা দরকার, এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়; কিন্তু যেভাবে ‘বহিরাগত’, ‘মাদকাসক্ত’, ‘গাঁজাখোর’ তকমা দিয়ে উচ্ছেদ অভিযান চলছে, ভিডিও করে যেভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যেভাবে ‘বট বাহিনী’ সংঘবদ্ধভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, সেটি শেষ পর্যন্ত জনতুষ্টিবাদী রাজনীতির একটি টেস্ট কেস। তাহলে কি আমরা হকার, রিকশাচালক, ভবঘুরে, পথশিশু ও ভাসমান জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে একটি জনতুষ্টিবাদী ‘যুদ্ধ’ দেখতে পাব? আর কোন কোন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে এই ‘জনতুষ্টিবাদী যুদ্ধ’ হতে পারে, তারও কিছু আলামত ১৪ মাসেই পাওয়া গেছে।

সম্প্রতি সিলেটে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশাচালক ও বামপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের গ্রেপ্তারের সময়ও আন্দোলনে ‘মাদকসেবীরা’ অংশ নিয়েছিলেন বলে পুলিশ অভিযোগ করে। হাসিনার আমলে বিএনপি-জামায়াত ও স্বাধীনতাবিরোধী তকমা দিয়ে যে কাউকে নিপীড়নের রাজনৈতিক ন্যায্যতা দেওয়া হয়েছিল। অভ্যুত্থানের একটি বড় আকাঙ্ক্ষা ছিল তকমা দিয়ে মানুষকে নিপীড়নের দিন শেষ হতে হবে; কিন্তু ১৪ মাসে এর অবসান কতটা হয়েছে?

গণ-অভ্যুত্থানের পর নারী, জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের নানাভাবে আক্রান্ত হতে দেখেছি। সরকারের করা নারী সংস্কার কমিশন ও এই কমিশনের প্রতিবেদন নিয়ে প্রকাশ্য জনসভায় অশ্লীল গালাগাল করা হয়েছে। পোশাকের কারণে নারীদের জনপরিসরে হেনস্তা হতে হচ্ছে। যে নারীর নিরাপত্তার কথা বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গরিব ও প্রান্তিক লোকদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে, অথচ সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন কর্মচারী বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী শিক্ষার্থীকে হেনস্তা করার পর সেখানে খুব বেশি প্রতিবাদ কিন্তু দেখা যায়নি। অভ্যুত্থানের সামনের মুখ এবং সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অনেক নীতির সমালোচক কয়েকজন নারী শিক্ষককে নিয়ে ফেসবুকে সংঘবদ্ধ আক্রমণ হয়েছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও জোরালো প্রতিবাদ দেখা যায়নি।

তিন.
ভবঘুরে হোক, হকার হোক—কারও গায়ে হাত তোলা ফৌজদারি অপরাধ। ডাকসুতে কেউ বিজয়ী হয়েছেন বলেই নাগরিকদের গায়ে হাত তোলার বৈধতা পান না। এ অভিযানে যিনি সামনের কাতারের মুখ, জাতিগতভাবে সংখ্যালঘু হওয়ায় ডাকসুর বর্তমান নেতৃত্বের কৌশল নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, যে অভিযান ডাকসু নেতারা পরিচালনা করছেন, সেটির আইনি বৈধতা কি তাঁদের আছে? বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজটা কী তাহলে?

গণ-অভ্যুত্থানের আগে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হতে দেখেছি। সবারই প্রত্যাশা ছিল, অভ্যুত্থানের পরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অন্তত কিছুটা আত্মমর্যাদা ও স্বাধীন সত্তা নিয়ে দাঁড়াতে পারবে। বাস্তবে তা কতটা দেখা গেল?

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তো বাংলাদেশের বাস্তবতার বাইরের কোনো বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়। অভ্যুত্থানের পর থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একাংশকে আমরা তথাকথিত ‘বহিরাগত’ ঠেকাতে পাহারা দিতে দেখেছি; কিন্তু ‘বহিরাগত’ শব্দটা আপত্তিকর, বৈষম্যমূলক ও বর্ণবাদী দোষে দুষ্ট। গণ-অভ্যুত্থানের যে স্পিরিট ও আকাঙ্ক্ষা, তারও ঘোরবিরোধী। এমন প্রশ্নও উঠেছে, গণ-অভ্যুত্থানের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঘিরে বিভিন্ন মত ও পথের মানুষের যে সম্মিলন হচ্ছে, তাতে রাশ টেনে ধরার উদ্দেশ্য থেকেই মূলত এই অভিযান। কেননা, টিএসসি ও এর আশপাশে ফুটপাথের চায়ের দোকানগুলো ঘিরে এসব আড্ডা বসে।    

চার.
গণ-অভ্যুত্থানে শহীদদের মধ্যে শ্রমজীবীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে তাঁদের ন্যূনতম সংযোগ ছিল না। হাসিনার শেষ পাঁচ বছর অর্থনৈতিক সংকট তাঁদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। দেয়ালে পিঠ ঠেকতে ঠেকতে তাঁদের আর দম নেওয়ার জায়গা ছিল না। ছাত্রদের আন্দোলনকে তাঁরা নিজেদের আন্দোলন বলে আলিঙ্গন করে নিয়েছিলেন।

গত দেড় বছরে কৃষক ও শ্রমজীবী মানুষের জীবনযাপনের সংকট আরও তীব্র হয়েছে। গরিব মানুষ বেড়েছে, বেকার বেড়েছে। একের পর এক ফসলে লোকসান গুনে আত্মহত্যা করেছেন কৃষকেরা। শিল্পে শ্রমিকেরা কাজ হারিয়েছেন। ফলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা বা হকারি হয়ে উঠেছে কর্মসংস্থানের বিকল্প। এ রকম বাস্তবতায় গ্রাম থেকে, মফস্বল থেকে সর্বহারা মানুষের দল যে নগরে ভিড় জমাবে, সেটি বোঝার জন্য পণ্ডিত হতে হয় না। মানুষের প্রতি কিছুটা দরদ আর কিছুটা দায় থাকলেই চলে।

ঢাকার ফুটপাতগুলো কেন হাজার হাজার মানুষের ‘বেডরুম’ হয়ে ওঠে, সে প্রশ্নও ডাকসু নেতাদের, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে করতে শিখতে হবে? কেননা, যে লোকগুলোকে তাঁরা লাঠি হাতে পেটাচ্ছেন, তাড়াচ্ছেন, তাদের ট্যাক্স-ভ্যাট থেকেও পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থায়নটা আসে।
   
মনোজ দে প্রথম আলোর সম্পাদকীয় সহকারী

(মতামত লেখকের নিজস্ব)