ব্যাংক একত্রীকরণ: ঋণখেলাপিদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী হবে?

পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে পাঁচটি বড় ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বেসরকারি খাতের এক্সিম ব্যাংক সবচেয়ে দুর্বল পদ্মা ব্যাংককে অধিগ্রহণ করেছে সবার আগে।

এরপর বাংলাদেশ ব্যাংক ঘোষণা দিয়েছিল, বেসিক ব্যাংক একীভূত হবে সিটি ব্যাংকের সঙ্গে। তারপর সোনালী ব্যাংক অধিগ্রহণ করেছে বিডিবিএলকে। এরপর একীভূত হয়েছে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক।

সবশেষে ঈদের ছুটির আগের দিন বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ঘোষণা এসেছে বেসরকারি ব্যাংক ইউসিবি ও ন্যাশনাল ব্যাংক একীভূত হওয়ার।

কী শর্তে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অপেক্ষাকৃত সবল ব্যাংকের সঙ্গে একত্রীকরণ হলো, তা এখনো জানা যায়নি। তবে সিদ্ধান্তগুলো যে বিশেষজ্ঞ বা ওই ব্যাংকগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পছন্দ হয়নি, তা বোঝা যায়। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া আরও এগোনোর পর বোঝা যাবে সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে কি না।

আরও পাঁচটি দুর্বল ব্যাংককে ‘মার্জার’-এ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সে সিদ্ধান্ত স্থগিত করা হয়েছে। শর্তগুলো বিস্তারিত না জেনে এখনই মার্জারের ভালোমন্দ সম্পর্কে মন্তব্য করা সময়োচিত না হলেও কয়েকটি মন্তব্য করা সমীচীন।

আরও পড়ুন

সোনালী ব্যাংক ও বিডিবিএল একীভূত হওয়ার সিদ্ধান্তটি যৌক্তিক। দীর্ঘমেয়াদি শিল্পঋণ দিতে আলাদা ব্যাংক থাকার ভালো যুক্তি নেই।

বিডিবিএলের আগে দুটি শিল্পায়ন অর্থায়ন প্রতিষ্ঠান খেলাপি ঋণে জর্জরিত ছিল—একটি বাংলাদেশ শিল্প ব্যাংক, অপরটি বাংলাদেশ শিল্প ঋণ সংস্থা (বিএসআরএস)। পরবর্তী সময়ে সাধারণ বাণিজ্যিক ব্যাংকে রূপান্তরিত করা হলেও ব্যর্থ হয়েছে ব্যাংকগুলো। বিডিবিএলের খেলাপি ঋণগুলো দীর্ঘদিনের। আদায় হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় নেই। এই বোঝা সোনালী ব্যাংক কীভাবে সামলায়, দেখার অপেক্ষায় রইলাম।

কৃষি ব্যাংকের সঙ্গে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের মার্জারও যৌক্তিক। আলাদা করে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্তটিই ভুল ছিল। কৃষি ব্যাংকের শাখা বাড়িয়েই দায়িত্বটি পালন করা হতো।

বেসিক অত্যন্ত ভালো একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ছিল। খেলাপি ঋণের অনুপাত এক দশক আগেও ৩-৪ শতাংশের বেশি ছিল না। শেখ আবদুল হাই বাচ্চুকে চেয়ারম্যান করে রেখে কয়েক বছর লুটপাট করতে দিয়ে বর্তমান সরকার ব্যাংকটিকে ধ্বংস করেছে।

আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতিবারই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতা অনুযায়ী ওসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর প্রতি অসম্মান জানিয়ে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স বিতরণের খামখেয়ালিপনা অব্যাহতভাবে চলেছে। এর পেছনে যে ছিল বিশুদ্ধ স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

প্রয়াত সাবেক অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বেশ কয়েকবার আবদুল হাই বাচ্চুকে অপসারণ করতে বললেও সরকার রহস্যজনক কারণে বহুদিন তাতে সাড়া দেয়নি।

অবশেষে তাঁকে অপসারণ করে আলাউদ্দিন মজিদকে চেয়ারম্যান করা হলেও ব্যাংকটিকে আর পতনের ধারা থেকে ফেরানো যায়নি। ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ এখন ৬৮ শতাংশের বেশি। আলাদাভাবে ব্যাংকটি চালানো অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। মার্জারের মাধ্যমে ব্যাংকটির অবসায়ন সময়োচিত সিদ্ধান্ত।

কিন্তু সিটি ব্যাংক একটি বেসরকারি ব্যাংক। পতনোন্মুখ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকটির বোঝা তারা কীভাবে বহন করে, সেটাই বড় প্রশ্ন। বেসিকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও এ সিদ্ধান্তে খুশি নন। তাঁরা একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের সঙ্গে একীভূত হওয়ার ইচ্ছা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি দিয়েছেন।

ন্যাশনাল ব্যাংক জন্মলগ্ন থেকেই লুটপাটের শিকার। প্রথম প্রজন্মের অন্যতম বেসরকারি ব্যাংক হিসেবে ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণের পর ব্যাংকটি বেসরকারি খাতের একটি বড় ব্যাংকে পরিণত হয়।

কিন্তু সিকদার পরিবারের দুই ভাই রণ হক সিকদার ও রিক হক সিকদারের হাতে পড়ার পর ব্যাংকটি লাটে ওঠার উপক্রম হয়েছে কয়েক বছর আগেই (জনশ্রুতি রয়েছে যে প্রথম থেকেই বিভিন্ন নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ীর লুটপাটের শিকার হয়েছিল ব্যাংকটি)।

আরও পড়ুন

এ রকম একটি নিমজ্জমান বেসরকারি ব্যাংককে ইউসিবি কীভাবে উদ্ধার করবে, তা–ও বড় প্রশ্ন। ইতিমধ্যেই ন্যাশনাল ব্যাংকের পর্ষদ ঘোষণা করেছে যে তারা একীভূত হতে চায় না। তারা নাকি নিজেরাই ব্যাংকটিকে সংকট থেকে উদ্ধারের প্রয়াস চালাবে।

খেলাপি ঋণ ব্যাংক খাতের সবচেয়ে পুরোনো ও মারাত্মক সমস্যা। বর্তমানে দেশের প্রায় ১৮ লাখ কোটি টাকা ব্যাংকঋণের মধ্যে কমপক্ষে সাড়ে ৪ লাখ কোটি টাকা খেলাপিতে পর্যবসিত হয়েছে, যদিও নানা কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক তিন মাস পরপর প্রকাশিত ‘ক্লাসিফায়েড ঋণের’ হিসাবে মাত্র ১ লাখ ৪৫ হাজার কোটি টাকাকে ক্লাসিফায়েড দেখাচ্ছে। বাকি খেলাপি ঋণকে ‘টেকনিক্যাল কারণে’ হিসাবের বাইরে রাখছে।

অর্থঋণ আদালত, হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ঝুলে থাকা মামলায় বছরের পর বছর আটকে থাকায় এর মধ্যে কমপক্ষে আড়াই লাখ কোটি টাকাকে টেকনিক্যালি ‘ক্লাসিফায়েড’ বলা যাচ্ছে না।

এর সঙ্গে যুক্ত হবে ৬৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ৫ বছরের অধিক পুরোনো ‘মন্দ ঋণ’। বিভিন্ন ব্যাংক ‘রাইট অফ’ করে দেওয়ায় সেগুলোকেও আর বাংলাদেশ ব্যাংক প্রকাশিত ‘ক্লাসিফায়েড লোনে’ অন্তর্ভুক্ত করা যাচ্ছে না। এর পাশাপাশি আড়াল হয়ে যাচ্ছে বারবার নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘রিশিডিউল’ করা ‘পরিশোধের নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে যাওয়া’ বিপুল পরিমাণ ঋণ, যেগুলোর প্রকৃত পরিমাণ বাংলাদেশ ব্যাংকেরও অজানা। আরেকটা ক্যাটাগরির ঋণও অনিয়মিত, যেগুলোকে নতুন ঋণের সঙ্গে সমন্বয় করে বিভিন্ন ব্যাংক নিয়মিত দেখিয়ে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক এটি ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না।

ওপরের সব কটি ক্যাটাগরি যোগ করলে সন্দেহাতীতভাবে বলা যাবে যে খেলাপি ঋণ সমস্যাটা তিন দশক আগেই ব্যাংক খাতের ‘নিরাময়-অযোগ্য ক্যানসারে’ পরিণত হয়েছে। দুর্ভাগ্য হলো, এসব জানা সত্ত্বেও সরকার এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা ৩০ বছর ধরে সমস্যাটিকে কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে চলেছেন।

উল্টো ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতাসীন বর্তমান সরকার দফায় দফায় আরও ৩০টির বেশি নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার খামখেয়ালি সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছে। এতে একত্রীকরণের সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগেই মোট বাণিজ্যিক ব্যাংকের সংখ্যা পৌঁছে গিয়েছিল ৬১-তে।

আরও পড়ুন

আবুল মাল আবদুল মুহিত প্রতিবারই নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে ক্ষমতা অনুযায়ী ওসব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে গেছেন, কিন্তু তাঁর প্রতি অসম্মান জানিয়ে নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স বিতরণের খামখেয়ালিপনা অব্যাহতভাবে চলেছে। এর পেছনে যে ছিল বিশুদ্ধ স্বজনপ্রীতি ও দলীয় বিবেচনা, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

এমন অনেকেই লাইসেন্স পেয়েছেন, যাঁদের নতুন ব্যাংকের লাইসেন্স গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় ২০ কোটি টাকা মূলধন থাকার কথাই বিশ্বাসযোগ্য নয় (ওই সব ব্যাংকের ‘ব্যবসায়ী পরিচালকেরাই’ সম্ভবত লাইসেন্সের অর্থ পরিশোধ করে দিয়েছেন)!

এভাবে ব্যাংক খোলার যথেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবারই সর্বশক্তি দিয়ে আমি প্রতিবাদ জানিয়েছি। কিন্তু কাজ হয়নি। পাঠকদের জানাচ্ছি, দেশের ব্যাংক খাতের সবচেয়ে বড় শক্তির উৎস ১ কোটি ৫৫ লাখ প্রবাসী বাংলাদেশি। তাঁরা আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে কিংবা হুন্ডির মাধ্যমে যেভাবেই রেমিট্যান্স পাঠান না কেন, তার একটা বড় অংশ নিরাপত্তার খাতিরে ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হবেই। এটি বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে আমানতের একটা ঢল চলমান রেখেছে। সে জন্য খেলাপি ঋণ সমস্যা তিন দশক আগেই মহাসংকটে পরিণত হলেও ব্যাংকগুলোকে বড়সড় তারল্যসংকটে পড়তে হয়নি।

ব্যাপারটা জানে বলে বিএনপি বা আওয়ামী লীগ কোনো সরকারই খেলাপি ঋণ আদায়ে কখনো কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। ১৯৯৮ সালে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ ১০ ঋণখেলাপির খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠনের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। প্রস্তাবটি কোনো সরকারই বিবেচনায় নেয়নি। বরং বিএনপি-জামায়াত জোট ক্ষমতায় আসার পর খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলা ‘কালচারে’ পরিণত হয়েছিল।

উদাহরণত, আওয়ামী লীগের ১৯৯৯ সালে প্রতিষ্ঠিত দেউলিয়া আদালতকে বিএনপি পুরো নিষ্ক্রিয় করে ফেলেছিল। গত ২৩ বছরেও সে আদালতের ঘুম ভাঙেনি। খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার এই সংস্কৃতি এমনভাবে গেড়ে বসেছে যে সদ্য সাবেক অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল অভূতপূর্ব কয়েকটি ‘অযৌক্তিক ও অন্যায় সুবিধা’ দিয়ে রাঘববোয়াল ঋণখেলাপিদের নাম তালিকা থেকেই উধাও করে দেওয়ার ব্যবস্থা করে গেছেন।

অতএব খেলাপি ঋণের ব্যাপারে এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি অব্যাহত রেখে ‘ব্যাংকের মার্জার’ ব্যাংক খাতকে সবল করে তুলবে, এমন আশা করার সুযোগ আছে কি? 

ড. মইনুল ইসলাম অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক