তৌফিক-ই-ইলাহীর মামলায় আইসিটির আটকসংক্রান্ত বিধি প্রশ্নের মুখোমুখি

২৭ অক্টোবর তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীকে ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং ‘গ্রেপ্তার দেখানো’ হয়।ছবি: সংগৃহীত

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের (আইসিটি) প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আদালতে ২০২৪ সালের ১৭ অক্টোবর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা  তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির জন্য আবেদন করেন।

ওই সময় তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বয়স ছিল ৭৯ বছর। এই আবেদনে আরও ৪৪ জনের নাম ছিল, তাঁরা সবাই আওয়ামী লীগের নেতা অথবা দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ।

খ্যাতিমান মুক্তিযোদ্ধা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ২০০৯ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ১৫ বছর ধরে শেখ হাসিনার জ্বালানি উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করেছেন। এর আগে আওয়ামী লীগে প্রথমবার ক্ষমতায় থাকাকালীন তিনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে কাজ করেছেন ১৯৯৭ থেকে ২০০০ সালে।

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী সচিব হওয়ারও অনেক আগে থেকে শেখ হাসিনার পরিচিত ছিলেন বলে জানা যায়; কিন্তু তিনি কখনোই আওয়ামী লীগের আনুষ্ঠানিক সদস্য ছিলেন না।

জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত করেছেন, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে জনাব চৌধুরী বিদ্যুৎ ও জ্বালানিবিষয়ক কাজেই জড়িত থেকেছেন। আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক কাজে তিনি অংশগ্রহণ করেননি।

আরও পড়ুন

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর গ্রেপ্তারি পরোয়ানা চেয়ে আইসিটিতে যে আবেদন করা হয়েছে, সেখানে প্রধান প্রসিকিউটর বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা (জনাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে) মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রাইমা ফেশি (প্রাথমিক) উপাদান পেয়েছেন এবং যদি তাঁকে আটক না করা হয়, তিনি প্রমাণ নষ্ট করা বা সাক্ষীদের হুমকি দিয়ে তদন্তপ্রক্রিয়ায় বাধা দিতে পারেন। আদালত প্রসিকিউশনের এই দাবি গ্রহণ করেন।
তবে ট্রাইব্যুনালের পরোয়ানা জারি হওয়ার আগে থেকেই জনাব চৌধুরী কারাগারে ছিলেন।

ট্রাইব্যুনালের পরোয়ানা জারির পাঁচ সপ্তাহ আগে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর সাদাপোশাকধারী পুলিশ জনাব চৌধুরীকে তাঁর বনানীর বাড়ি থেকে পুলিশের গোয়েন্দা শাখা (ডিবি) অফিসে নিয়ে যায়।

পরের দিন ভোরে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে জনাব চৌধুরীকে জানানো হয়, ১৯ জুলাই উত্তর বাড্ডায় বিক্ষোভের সময় সুমন সিকদার নামের এক ব্যক্তিকে হত্যার ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

ওই মামলায় ১৭৯ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়েছিল এবং তাঁর মধ্যে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নাম ছিল না। তবে পুলিশ আদালতে দাবি করে, ওই মামলায় আরও ‘২৫০’ জন অজ্ঞাতনামা আসামি আছেন এবং জনাব চৌধুরী তাঁদের একজন।

ম্যাজিস্ট্রেট বাদীপক্ষের কথা শুনে তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য চার দিনের পুলিশ হেফাজতে রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এরপর তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়।

গ্রেপ্তারের সময় এবং পরের ১০ মাসের হত্যাকাণ্ডে তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর জড়িত থাকার কোনো প্রমাণ (ফটো, ভিডিও, ব্যাংক হিসাবের বিবরণ, মুঠোফোনের বার্তা ইত্যাদি) পুলিশ উপস্থাপন করতে পারেনি। তাঁর পরিবারের ভাষ্য অনুযায়ী, রিমান্ডে পুলিশ তাঁকে হত্যাকাণ্ড–সম্পর্কিত কোনো প্রশ্নই করেনি।

বাড্ডার মামলায় জনাব চৌধুরী আগেই কারাগারে ছিলেন, তাই আইসিটির গ্রেপ্তারি পরোয়ানা অনুযায়ী এক সপ্তাহ পর, ২৭ অক্টোবর চৌধুরীকে (আরও ১৩ জন আসামির সঙ্গে) ট্রাইব্যুনালে হাজির করা হয় এবং ‘গ্রেপ্তার দেখানো’ হয়। (আইসিটি বিডি মিসসেলেনিয়াস কেস নম্বর ০৩ অব ২০২৪)।

আরও পড়ুন

এ সময় কীসের ভিত্তিতে প্রসিকিউশন তাকে গ্রেপ্তার করছে সে সম্পর্কিত কোনো তথ্য তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী পাননি। আইসিটির নিয়ম অনুযায়ী, একজন আসামিকে গ্রেপ্তারের ‘সময় বা পরে’ ‘অভিযোগের একটি কপি’ সরবরাহ করতে হবে। জনাব চৌধুরীর আইনজীবী অভিযোগের কপি পান নভেম্বরের শেষ দিকে।

৯ নভেম্বর তারিখের ‘প্রাথমিক অভিযোগ’ নামের এই নথিতে বলা হয়েছে, চৌধুরী একজন ‘গুরুত্বপূর্ণ আসামি’। এখানে তাঁর বিরুদ্ধে চারটি অভিযোগ আনা হয়েছে। নথিতে লিখিত বেশির ভাগ কথাই অপরাধের সঙ্গে তাঁর জড়িত থাকা বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সাধারণ বক্তব্য; কিন্তু আইসিটি তদন্তকারীরা এখানে সুনির্দিষ্ট দুটি বিষয় উত্থাপন করেছেন।

প্রথম অভিযোগের বিষয়টি হলো, সাবেক জ্বালানি উপদেষ্টা আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ও সাধারণ মানুষকে স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রেতাত্মা হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, জনাব চৌধুরী এবং ১৪-দলীয় জোটের নেতারা মিলে একটি বৈঠক করেন, যেখানে দেশব্যাপী কারফিউ জারি করা এবং ‘কারফিউ চলাকালীন ছাত্র-জনতার ওপর গুলি চালানো’র সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কিন্তু পাবলিক রেকর্ড (বা যা প্রকাশিত হয়েছে এমন তথ্য) অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাই বা আগস্ট মাসে জনাব চৌধুরী কোনো ১৪ দলীয় জোটের বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না। তাই এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁর সম্পৃক্ত থাকার সুযোগই ছিল না।

আরও পড়ুন

একইভাবে জনাব চৌধুরী ছাত্র বা অন্যদের ‘স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রেতাত্মা’ বলে উল্লেখ করেছেন, তা–ও পাবলিক রেকর্ডে নেই। এই ভাষা অন্য বিভিন্ন ব্যক্তি জনসমাবেশে বলেছেন।

অভিযোগের এই দুটি গুরুতর তথ্যগত ভুল তাঁর প্রাথমিক গ্রেপ্তারি এবং চলমান আটক থাকার বৈধতা-দুটি বিষয়কেই প্রশ্নবিদ্ধ করে।

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, আইসিটির অভিযোগে ২০২৪ সালের ১৯ জুলাই সুমন সিকদার হত্যার কোনো উল্লেখ নেই, যে অভিযোগে জনাব চৌধুরী প্রথম গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। হত্যাকাণ্ডের অভিযোগে তাঁর অন্তরিণ থাকা আরও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।

জনাব চৌধুরীর বিরুদ্ধে আনা ‘অভিযোগের’ এসব ত্রুটির বিষয়ে আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম বলেন, ‘বিষয়টি এখনো তদন্তাধীন। তদন্ত শেষ হলে প্রমাণের ভিত্তিতে অভিযোগ গঠনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তদন্ত সম্পূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত এ বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করা ঠিক হবে না।’

মে মাসে অর্থাৎ আটক হওয়ার সাত মাস পর জনাব চৌধুরী আইসিটিতে জামিনের জন্য আবেদন করেন; কিন্তু এই ট্রাইব্যুনালের নিয়ম অনুসারে এখানে কাউকে গ্রেপ্তার বা জেলে রাখার জন্য প্রমাণ দেখানো বাধ্যতামূলক নয় (অন্যান্য আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালের নিয়ম থেকে একটি উল্লেখযোগ্য ব্যত্যয়)। আইসিটির নিয়ম অনুসারে এতটুকুই যথেষ্ট যে অভিযুক্তকে আটক রাখা ‘সঠিক ও কার্যকর তদন্ত করার জন্য দরকার’।

জামিনের আবেদনে ‘প্রমাণের' ত্রুটির বিষয়টি তাঁর আইনজীবীরা তোলেনি। তারা তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর বয়স ও স্বাস্থ্যের ভিত্তিতে জামিন চান। এর জবাবে প্রধান প্রসিকিউটর আদালতে বলেন, ‘এ মুহূর্তে তাঁকে জামিন দেওয়ার মতো কোনো যুক্তি নেই’ এবং ‘তদন্ত শেষ হওয়ার আগে তাঁকে জামিন দেওয়া ন্যায্য বা সঠিক হবে না।’

বিচারকেরাও এই যুক্তির সঙ্গে একমত হন। আদালতের আদেশে বলা হয়, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার মতো কোনো শক্ত কারণ খুঁজে পাচ্ছি না। তাই জামিনের আবেদন খারিজ করা হলো।’

ট্রাইব্যুনালের এই আদেশে তদন্ত কতটা এগিয়েছে বা চৌধুরীর বিরুদ্ধে কী প্রমাণ আছে, সে বিষয়ে কিছুই উল্লেখ করা হয়নি। অক্টোবর মাসে তাঁর গ্রেপ্তারের পর থেকে আইসিটির কোনো তদন্তকারী বা প্রসিকিউটর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদও করেনি।

চলতি আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত আইসিটির অধীন ৮৪ জন আটক হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগী দলগুলোর রাজনীতিবিদ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী কর্মকর্তা এবং একজন সাবেক বিচারক।

লন্ডনের জি৩৭ চেম্বার্সের আন্তর্জাতিক-অপরাধ আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান (যিনি আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটরের বিশেষ উপদেষ্টা হিসেবে আছেন) বলেন, তাঁর পক্ষে ‘কোনো নির্দিষ্ট মামলা বা ট্রাইব্যুনালের সামনে উত্থিত হতে পারে, এমন বিষয়ে ‘জনসমক্ষে মন্তব্য’ করা ঠিক হবে না। তিনি আরও বলেন, ‘অভিযোগে কোনো ফ্যাকচুয়াল (নির্দিষ্ট তথ্যবিষয়ক) ভুল আছে কি না, তা আদালতের প্রক্রিয়ায় প্রমাণ দিয়ে চ্যালেঞ্জ করার বিষয়, বাইরের মন্তব্যের বিষয় নয়।’

আইসিটির আটক–সংক্রান্ত নিয়ম ন্যায়নিষ্ঠ প্রক্রিয়া নিশ্চিতের জন্য যথাযথ কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করেননি জনাব ক্যাডম্যান। তিনি দাবি করেন, কাউকে আটক রাখা হবে কি না, তা প্রকৃতপক্ষে বিচারকদের সিদ্ধান্তের বিষয়।

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর জামিন না পাওয়াটা উদ্বেগজনক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাঁর আটক থাকা সম্ভব করে তুলেছে আইসিটির এমন একটি বিধান যা প্রমাণ ছাড়াই নির্বিচার আটককে অনুমোদন করে—সোজা কথায়, প্রমাণবিহীন আটককে বৈধতা দেয়। অপর দিকে প্রসিকিউটর ও বিচারকেরা কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন বলেই মাসের পর মাস কাউকে জেলে রেখে দেওয়া যেতে পারে তাতে অস্বস্তির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।

‘সংক্ষেপে বলা যায়, ট্রাইব্যুনালের কাঠামো অনুযায়ী তদন্তের জন্য প্রাথমিক ভিত্তি থাকলে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থে আটক প্রয়োজন বলে ট্রাইব্যুনাল বিবেচনা করলে আটকাদেশ দেওয়া যেতে পারে। কোনো আটকাদেশ দেওয়ার আগে বিচারকদের সন্তুষ্ট হতে হবে যে আইনে নির্ধারিত ন্যূনতম মানদণ্ড পূরণ হয়েছে’—টবি ক্যাডম্যান বলেন।

তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর জামিন না পাওয়াটা উদ্বেগজনক। অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়, তাঁর আটক থাকা সম্ভব করে তুলেছে আইসিটির এমন একটি বিধান যা প্রমাণ ছাড়াই নির্বিচার আটককে অনুমোদন করে—সোজা কথায়, প্রমাণবিহীন আটককে বৈধতা দেয়। অপর দিকে প্রসিকিউটর ও বিচারকেরা কেবলমাত্র আওয়ামী লীগ সরকারের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন বলেই মাসের পর মাস কাউকে জেলে রেখে দেওয়া যেতে পারে তাতে অস্বস্তির কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছেন না।

অথচ যে অপরাধে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তাতে সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ আছে কি না, সে বিষয়ে কোনো উদ্বেগ প্রদর্শন তাঁরা করছেন না।

সরকারের উচিত প্রমাণ ছাড়াই আটকের অনুমোদন দেওয়া আইসিটির বিধানে পরিবর্তন আনা। একই সঙ্গে আইসিটি প্রসিকিউটর এবং ট্রাইব্যুনালের উচিত বর্তমানে আইসিটিতে আটক প্রত্যেক ব্যক্তির বিরুদ্ধে তাঁদের কাছে থাকা প্রমাণ পুনর্মূল্যায়ন করা এবং যাঁদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ–সংশ্লিষ্টতার কোনো গ্রহণযোগ্য প্রমাণ নেই, তাঁদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া। আইসিটির বিচারের গ্রহণযোগ্যতার জন্য এই পদক্ষেপ আবশ্যক।

  • ডেভিড বার্গম্যান: সাংবাদিক।

    *মতামত লেখকের নিজস্ব