সমাজবিজ্ঞানের গবেষণার মনোযোগের প্রধান কেন্দ্র হলো মানুষ ও তার কল্যাণে কাজ করা। আর গবেষণাগার হিসেবে বিবেচনা করা হয় মানবসমাজকে। গবেষণার জন্য আকর্ষণীয় একটি ক্ষেত্র হচ্ছে নগরে অবস্থিত বস্তি কিংবা নগরের কাছাকাছি অবস্থিত প্রান্তিক জনগোষ্ঠী। আমাদের রাজধানীর প্রাণকেন্দ্রে গড়ে ওঠা কড়াইল ও অন্য বস্তিগুলো ঠিক তেমনই এলাকা, যা গবেষক ও এনজিও কর্মীদের কাজের একটি বড় ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করেন, অথচ কড়াইল বস্তিতে গবেষণার জন্য তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য যেতে হয়নি, এমন গবেষক খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিলই হবে। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত এ ধরনের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বাসস্থান গবেষকদের জন্য একটি আদর্শ স্থান। স্বদেশি থেকে শুরু করে বিদেশি গবেষক এবং দাতা সংস্থা ও এনজিওগুলোর কর্মকাণ্ড কড়াইল বস্তিতে ব্যাপকভাবে বিস্তৃত।
বাংলাদেশকে একসময় বলা হতো এনজিওর স্বর্গরাজ্য। সে বিবেচনায় তাদের উপস্থিতি কড়াইলের মতো বস্তিতে থাকবে, সেটিই স্বাভাবিক। এমন জনগোষ্ঠীকে ঘিরে বেসরকারি খাতের নানাবিধ কর্মকাণ্ড ও প্রাতিষ্ঠানিক উপস্থিতি এই বস্তির জনগণের জীবনমানের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে। সে তুলনায় সরকারি প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি বেশ কম বা তেমন একটা নেই বললেই চলে। এর সঙ্গে রয়েছে অগ্নিকাণ্ডসহ নানাবিধ দুর্যোগ, যা তাদের প্রাত্যহিক জীবনে নানা ঝুঁকি তৈরি করে।
রাষ্ট্র তাদের জীবনমান উন্নয়নে খুব একটা অগ্রাধিকার না দিলেও বেসরকারি সংস্থাগুলো তাদের কার্যক্রমের মাধ্যমে কড়াইলের মতো এলাকার সমস্যার কিছুটা সমাধান ব্যতীত অন্য অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধান করতে পারছে না। সীমিত সুযোগ ও সামর্থ্যের কারণে তাদের কাছে সেটি আশা করাও বোধ হয় সঠিক প্রত্যাশা নয়।
সেই বিবেচনায় রাষ্ট্রের উচিত এ ধরনের পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা সাজানো। ঠিক এ জায়গায় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে এ পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে তাদের অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতে পারে।
রাজনৈতিক দলগুলোর ইশতেহারে বড় বড় প্রতিশ্রুতি থাকলেও এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকেন্দ্রিক প্রস্তাবনা পরিষ্কারভাবে উল্লেখ থাকে না। যদিও অনেকে বলে থাকে, একটি বৈষম্যহীন দেশ তারা গড়তে চায়, কিন্তু তারা সেটি কীভাবে করতে চায়, তার বিস্তারিত রোডম্যাপ বা কর্মপরিকল্পনা থাকে না। যে কারণে সাধারণ মানুষও সেই বিষয়গুলো সম্পর্কে খুব একটা আশাবাদী হতে পারেন না কিংবা একধরনের ধোঁয়াশায় থাকেন।
আমরা সব সময় দেখি, ভোটের রাজনীতিতে নির্বাচনের সময় এই ভোটারদের কদর বেড়ে যায়। তখন এই প্রান্তিক ভোটাররাই গুরুত্বের একটি জায়গায় চলে আসেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তাঁদের স্বার্থ কতটা বিবেচিত হয়, সে এক প্রশ্ন। অথচ উন্নয়নের অন্যতম একটি লক্ষ্য হওয়া উচিত এই প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমানের উন্নয়ন।
আমরা যত দিন প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে জাতীয় স্বার্থে রূপান্তরিত করতে না পারব, তত দিন উন্নয়নের সুফল আমাদের মতো সুবিধাভোগীদের ঘরেও পৌঁছাবে না। বিভিন্ন উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখতে পাই, তাদের অবকাঠামো গড়ে তোলা হয় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থকে মাথায় রেখে। স্বাস্থ্যসেবা থেকে শুরু করে সব সেবা তাদের জন্য উন্মুক্ত রাখা হয়। অথচ আমাদের এখানে এক স্বাস্থ্যসেবার পেছনেই দৌড়াতে দৌড়াতে আমাদের সর্বস্বান্ত হতে হয়। বাংলাদেশের বড় বড় হাসপাতালের খরচের দিকে তাকালে মনে হয়, অসুস্থ হওয়াটা যেন এক আজন্ম পাপ এ দেশে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের উন্নয়ন ভাবনা ও পরিকল্পনায় বেশির ভাগ সময় ‘ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’ বা ‘টপ ডাউন’ দৃষ্টিভঙ্গির বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে, যা অনেক সময় সঠিক ও ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে না। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পকে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চাহিদার আলোকে বিবেচনা করতে হবে। এর সঙ্গে উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসব জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের বয়ানকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আমরা বিএনপির স্বাস্থ্যসেবার প্রস্তাবনার কথা নিয়ে আসতে পারি, যেখানে তারা সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে আসতে চায়। যদি তারা সেটি বাস্তবতায় নিয়ে আসতে পারে, সেটি হবে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তবে যুক্তরাজ্যের ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসের (এনএইচএস) মডেলের হুবহু বাস্তবায়নের চিন্তা থেকে তাদের বের হয়ে আসতে হবে। কেননা আমরা বিগত সময়ে দেখেছি, পশ্চিমা মডেলগুলো হুবহু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বাস্তবায়নযোগ্য হয় না।
এর সুফল পেতে হলে অবশ্যই বাংলাদেশের পটভূমিতে এ মডেলগুলোর অভিযোজন জরুরি। যেমনটা চীন করে দেখিয়েছে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাফল্যের মধ্য দিয়ে। তারা হুবহু মার্ক্সীয় ধারণার প্রয়োগ করেনি; বরং নিজদের দেশের সাপেক্ষে একটি টেকসই ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। আমাদেরও বৈশ্বিক নানা ব্যবস্থা থেকে ভালো উদাহরণটি নিয়ে আমাদের সামাজিক পটভূমিতে তার প্রয়োগ করতে হবে। তা না হলে এর মধ্য দিয়ে অনেক অর্থ বিনিয়োগ হবে, কিন্তু তার ফলাফল প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় পৌঁছাবে না; বরং সেই প্রকল্প হবে প্রশ্নবিদ্ধ।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিয়ে আমাদের উন্নয়ন ভাবনা ও পরিকল্পনায় বেশির ভাগ সময় ‘ওপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া’ বা ‘টপ ডাউন’ দৃষ্টিভঙ্গির বহুল ব্যবহার হয়ে থাকে, যা অনেক সময় সঠিক ও ইতিবাচক ফল নিয়ে আসে না। ফলে দারিদ্র্য বিমোচন কিংবা উন্নয়ন প্রকল্পকে দরিদ্র ও পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর চাহিদার আলোকে বিবেচনা করতে হবে। এর সঙ্গে উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসব জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্যের বয়ানকেও গুরুত্ব দিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আমরা বিখ্যাত গবেষক রবার্টস চেম্বারসের প্রস্তাবনাকে মাথায় রাখতে পারি, যেখানে তিনি বলেছেন দরিদ্র মানুষের চোখে দারিদ্র্যের সংজ্ঞা ভিন্ন—যেখানে দারিদ্র্যের পাশাপাশি মানসিক চাপ, ভয়, নিরাপত্তাহীনতা ও মর্যাদাপূর্ণ সামাজিক জীবনের অভাবকেও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখতে হবে। দারিদ্র্যের অভিজ্ঞতাকে এ বিষয়গুলো আরও ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় নিয়ে যায়। যে কারণে দরিদ্র বা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী সমাজের মূলধারায় সব সময় অদৃশ্য থাকে, অথচ আমাদের নাগরিক জীবনকে সহজ করার পেছনে তাদের অবদান অনস্বীকার্য।
এসব কারণে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের মাধ্যমে তাদের প্রধান সমস্যাগুলো আগে চিহ্নিত করতে হবে। দারিদ্র্যকে দেখতে হবে ‘বটম আপ’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, সেটিকে অনুধাবন করতে হবে ভুক্তভোগীর বয়ানের মধ্য দিয়ে।
এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে, গ্রামীণ জনপদের সমস্যা শহুরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সমস্যা থেকে ভিন্ন হলেও কিছু জায়গা আছে, যা সব প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য একই রকম, যেমন কর্মসংস্থানের অভাব ও বাসস্থানের সমস্যা। বিশেষ করে আমাদের নজর দিতে হবে নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টির দিকে, যা বিএনপির নির্বাচনী প্রচারে আমরা দেখি, সেটি প্রশংসার দাবি রাখে। অন্য রাজনৈতিক দলগুলোও এ দৃষ্টিভঙ্গির অনুকরণ করতে পারে। তবে এ নতুন কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর পাশাপাশি প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর বিষয়টিও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় রাখতে হবে। এ ক্ষেত্রে ‘মেগা প্রকল্প’ এড়িয়ে স্থানিক জনগোষ্ঠীর স্বার্থসংবলিত কর্মসংস্থানের জন্য বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ নিতে হবে, যা হতে হবে টেকসই।
আমাদের মনে রাখতে হবে, দারিদ্র্য কোনো ব্যক্তিগত ব্যর্থতা নয়; বরং এটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মাধ্যমে গড়ে ওঠে। যে কারণে নৃবিজ্ঞানী পল ফার্মার দারিদ্র্যের এ সমস্যাকে একটি কাঠামোগত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এ প্রচেষ্টায় রাষ্ট্র যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার, তেমনি রাজনৈতিক দলগুলোও অন্যতম স্টেকহোল্ডার। তাই এ দুই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানকে এখানে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
বিগত দুই দশকে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর জনগণের যে আস্থাহীনতা গড়ে উঠেছে, জনগণের সে আস্থা ফিরে পেতেও এ দৃষ্টিভঙ্গি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। সামনে যেহেতু নির্বাচন, তাই আমরা প্রত্যাশা করব রাজনৈতিক দলগুলো প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা পালনের অঙ্গীকার নিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নের মাধ্যমে নিজেদের জনবান্ধব দলে পরিণত করবে। আর সেটি করতে পারলেই উন্নয়নের সুফল পৌঁছে যাবে পিছিয়ে পড়া সব জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায়।
বুলবুল সিদ্দিকী অধ্যাপক, রাজনীতি ও সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়
*মতামত লেখকের নিজস্ব
