বিক্ষোভ তীব্র হচ্ছে সবখানে, ইসরায়েল এখন কী করবে?

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গাজা যুদ্ধ ও ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধের দাবিতে বড় আন্দোলন শুরু হয়েছে।

গাজায় ইসরায়েলি হত্যাযজ্ঞ এখন সপ্তম মাসে এসে পড়েছে। ইসরায়েলের বসতি স্থাপনকারী ও উপনিবেশবাদী সরকার অবরুদ্ধ গাজার কয়েক লাখ মানুষের ওপর বিরতিহীনভাবে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।

২০০ দিনের আগ্রাসনের পর গত (২৩ এপ্রিল পর্যন্ত) সরকারি হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এ সময়ে ৩০২৫টি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং নির্মমভাবে প্রাণ হারিয়েছেন সাড়ে ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে ১৫ হাজার ৭৮০টি শিশু রয়েছে।

সাত হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিখোঁজ রয়েছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ধ্বংসস্তূপের নিচে তাদের কবর রচিত হয়েছে। মোট ৭৬ হাজার মানুষ আহত হয়েছেন। বেশির ভাগ বেসামরিক অবকাঠামো তারা ধ্বংস করে ফেলেছে।

এর মধ্যে গাজার ৭০ শতাংশ বাড়িঘর, ১২টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৩৬টির মধ্যে ৩৩টি হাসপাতাল ধ্বংস হয়েছে। আর অধিকৃত পশ্চিম তীরে ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত ইসরায়েল সেনাবাহিনী ও অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরা হামলা চালিয়ে ৪৮৬ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছেন, আহত করেছেন ৪ হাজার ৭০০ জনের বেশিজনকে।

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর চরম শয়তানি কৌশল হচ্ছে ‘দুর্ভিক্ষ কৌশল’। নেতানিয়াহু ও তার যুদ্ধ মন্ত্রিসভার পরিকল্পনা হলো, না খাইয়ে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা। গণহত্যা বিষয়ে পণ্ডিতেরা এ ঘটনাকে ‘হলোকাস্টের’ প্রত্যাবর্তন বলেছেন।

নেতানিয়াহুর বর্ণবাদী সরকারের অপরাধের ফিরিস্তি এখানেই শেষ নয়। দুর্নীতিগ্রস্ত নেতানিয়াহু দ্য ইউনাইটেড নেশনস রিলিফ অ্যান্ড ওয়ার্কস এজেন্সি ফর প্যালেস্টাইন রিফিউজিকে (ইউএনআরডব্লিউএ) খুব মিথ্যাভাবে ‘সন্ত্রাসীদের’ সহযোগিতা ও প্ররোচনার অভিযোগ তুলে গাজা, রাফা ও পশ্চিম তীরে তাদের মানবিক ত্রাণ কার্যক্রম পরিচালনা বন্ধ করে দেয়। ইসরায়েলের এই মিথ্যা অভিযোগের পেছনে নির্লজ্জভাবে পশ্চিমা সরকারগুলোও ছুটতে শুরু করে। খাবারের অভাবে ফিলিস্তিনিরা যখন মরছেন, তখন তারা ৪৫০ মিলিয়ন ডলারের সহযোগিতা বন্ধ করে দেয়।

ইসরায়েলের এই অভিযোগের ব্যাপারে অনুপুঙ্খ তদন্ত করা হয়েছে। তদন্তে নেতৃত্বে দেন ফ্রান্সের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যাথরিন কলোননা। তিনটি সুপ্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক সংস্থা এই তদন্তে অংশ নেয়। তারা তাদের তদন্তে এমন কোনো তথ্যপ্রমাণ পাননি, যাতে প্রমাণিত হয়, গাজায় ইউএনআরডব্লিউএর ১২ জন কর্মীর সঙ্গে হামাস অথবা ইসলামিক জিহাদের সংশ্লিষ্টতা আছে।  

তদন্তের এই ফলাফল বের হওয়ার পর এখন কি কিছু দেশের সরকার ইউএনআরডব্লিউএর মাধ্যমে তাদের ত্রাণসহায়তা শুরু করবে? সেটি করা হলে নেতানিয়াহুর যুদ্ধ-লক্ষ্যে বড় ধাক্কা আসত। নাকি তারা এখনকার মতো ইসরায়েলের মিথ্যাচারের কাছে নিজেদের সমর্পণ করেই যাবে?

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ২০০ দিন ধরে ইসরায়েলি বোমা হামলা ও স্থল অভিযানের মুখে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লড়াই, গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার ছবি, প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিকদের খবর, ছবি, ভিডিও এবং বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর দুর্দশার চিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্বকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। আর সেই বিক্ষোভ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

দ্বিতীয়টা যদি ঘটে, তাহলে ফিলিস্তিনিদের এই বিশ্বাস আরও ন্যায্য হবে যে পশ্চিমা বিশ্ব ইসরায়েলি সরকারের মিথ্যাচারের কাছে জিম্মি হয়ে গেছে। অতিসম্প্রতি গাজায় ইসরায়েলি বর্বরতা নিয়ে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিবেদন প্রকাশ পেয়েছে। সেটি হলো, গাজায় হাসপাতালগুলোর ওপর হামলা এবং ফিলিস্তিনিদের স্বাস্থ্যসেবা নিতে বাধা দেওয়া। এই প্রতিবেদনের লেখক তালেং মফোকেং। তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার একজন চিকিৎসক এবং জাতিসংঘের বিশেষ সংস্থা রাইট টু হেলথের বিশেষ প্রতিবেদক।

মফোকেং তাঁর প্রতিবেদনে জোর দিয়েছেন, গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের বেসামরিক অবকাঠামো ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় তথ্য সংগ্রহে তাঁদের কতটা কঠিন সমস্যার মুখে পড়তে হয়েছে। যা হোক, তিনি তাঁর প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে বলেছেন, বিশ্ব গাজায় একটি ‘গণহত্যা’ দেখছে।

জেনেভায় সংবাদ সম্মেলনে মফোকেং বলেন, নির্বিচার বোমা হামলা করে ইসরায়েল শুধু ফিলিস্তিনিদের অপূরণীয় ক্ষতি করেনি; ইসরায়েল ও দেশটির মিত্ররা জ্ঞানত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে ফিলিস্তিনেদের দুর্ভিক্ষ, দীর্ঘমেয়াদি অপুষ্টি ও পানিশূন্যতার দিকে ঠেলে দিয়েছে। বিশ্বনেতাদের প্রতি তিনি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ‘মানুষ মারা যাচ্ছে। আমি আবারও আপনাদের প্রতি আহ্বান জানাই, আপনারা আপনাদের সব শক্তি ও কর্তৃত্ব ব্যবহার করে শান্তি আনুন এবং গাজায় গণহত্যা বন্ধ করুন।’

এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গাজা যুদ্ধ ও ইসরায়েলি নৃশংসতা বন্ধের দাবিতে বড় আন্দোলন শুরু হয়েছে। অধ্যাপক সামি আল-আরিয়ান খুব নিখুঁতভাবে চলমান আন্দোলনের সারসংক্ষেপ করেছেন।

আল-আরিয়ান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেটা ঘটছে, সেটি অভূতপূর্ব। আমি চার দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বাস করছি। এর মধ্যে ২৮ বছর পার হয়েছে বিভিন্ন একাডেমিক দায়িত্ব পালন করে। আমার সময়ে জায়নবাদবিরোধী কোনো ভাষ্য উপস্থাপন করা ছিল বিশাল এক চ্যালেঞ্জ। কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সেটি করতে শিক্ষার্থীরা যে সাহস, মানবিকতা, সৃষ্টিশীলতা ও সংকল্প দেখিয়ে চলেছেন, সেটি আমাকে গর্বিত করে। যুক্তরাষ্ট্রের সমাজ থেকে জায়নবাদী শক্ত মুঠো দুর্বল ও আলগা হয়ে যাচ্ছে।’

সর্বোপরি গাজায় সন্ত্রাস চালিয়ে যাওয়ার সব ধরনের প্রচেষ্টা নেওয়ার পরও ইসরায়েল সেটিতে ব্যর্থ হচ্ছে। প্রকৃতপক্ষে, ইসরায়েল তার ভয়ংকর গণহত্যা চাপা দিতে সংবাদমাধ্যমে যাতে ‘সন্ত্রাসবাদ থেকে নিজেকে সুরক্ষার অধিকার ইসরায়েলের রয়েছে’ এমন একটি সংকীর্ণ প্রেক্ষাপট থেকে যে সংবাদ পরিবেশন করা হয়, সে জন্য প্রচুর সম্পদ ঢালছে।

লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ২০০ দিন ধরে ইসরায়েলি বোমা হামলা ও স্থল অভিযানের মুখে ফিলিস্তিন প্রতিরোধ যোদ্ধাদের লড়াই, গাজা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার ছবি, প্রত্যক্ষদর্শী, সাংবাদিকদের খবর, ছবি, ভিডিও এবং বাস্তুচ্যুত পরিবারগুলোর দুর্দশার চিত্র ইসরায়েলের বিরুদ্ধে বিশ্বকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছে। আর সেই বিক্ষোভ দিন দিন বেড়েই চলেছে।

  • মিডল ইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
    ইকবাল জাসাত, দক্ষিণ আফ্রিকাভিত্তিক মিডিয়া রিভিউ নেটওয়ার্কের নির্বাহী