বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়: সমস্যা ছাত্ররাজনীতি, নাকি ছাত্রলীগ

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন ওই সব প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা-পরিচালকেরা। একই সঙ্গে ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকেরাও সেখানে ছাত্ররাজনীতি ঢুকতে না দেওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন বলে সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে।

ছাত্রলীগ বিভিন্ন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে কমিটি করেছে বলে খবর প্রকাশের পটভূমিতেই এ উদ্যোগ। কোনো কোনো খবরে বলা হয়েছে, শীর্ষস্থানীয় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ এ রকম দাবিসংবলিত ১০ হাজারের বেশি ই–মেইল পেয়েছেন।

বিষয়টির গুরুত্ব অনস্বীকার্য এবং স্বভাবতই এর পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি গণমাধ্যমে আলোচিত হচ্ছে। তবে এসব আলোচনায় যে কথা বাদ পড়ছে, তা হলো যেসব বিপত্তি ও ঝামেলা এড়াতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে রাজনীতিমুক্ত বা ছাত্রসংগঠনমুক্ত রাখার কথা বলা হচ্ছে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সেই একই সমস্যাগুলোর সমাধান কী, তা নিয়ে কোনো আলোচনা নেই।

সাধারণভাবে যেসব বিশ্ববিদ্যালয়কে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বলা হয়, সেগুলো মূলত সরকারি বরাদ্দের ওপর নির্ভরশীল, আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় চলে মূলত শিক্ষার্থীদের টাকায়। হাতে গোনা কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির সুবাদে বিদেশে উচ্চতর শিক্ষা ও পেশাগত উৎকর্ষ লাভের সুযোগও প্রসারিত হয়ে থাকে।

তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলো, বিশেষ করে গত দুই দশকে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানগুলোর মান নিয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন আছে। কিন্তু এসব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে পার্থক্য লক্ষণীয়, তা হলো ছাত্র ও শিক্ষকদের দলীয় রাজনীতি। দলীয় লেজুড়বৃত্তির কারণে ছাত্ররাজনীতিতে পেশিশক্তি ও অস্ত্রের অনুপ্রবেশ ঘটায় সহিংসতা এখন তার নিত্যসঙ্গী। সহিংসতা শিক্ষকরাজনীতিতে যদিও ঢোকেনি, কিন্তু তা মোটেও কলুষমুক্ত নয়। রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদলের সঙ্গেও এটি সম্পর্কিত।

দলীয় রাজনীতির উপস্থিতিই মূলত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় ফারাক। দুর্ভাগ্যের বিষয় রাজনীতি ক্রমেই জ্ঞান ও যুক্তিনির্ভরতার বদলে পেশিশক্তিনির্ভর হয়ে পড়ায় ছাত্ররাজনীতির সমার্থক হয়ে দাঁড়িয়েছে গেস্টরুম, র‍্যাগিং, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এবং কথিত বড় ভাইদের সঙ্গে সহমত হওয়া।

গেস্টরুম সংস্কৃতি এবং ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশগ্রহণের বাধ্যবাধকতা নিয়ে যে আতঙ্ক আমি আমার পরিবারেই অনেকের চোখে-মুখে দেখেছি, তা খুবই হতাশার। ক্ষমতাসীন দলের একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অবশ্য জাতীয় রাজনীতিরই প্রতিফলন, যা ঘটছে মূলত গণতন্ত্রে আস্থা হারিয়ে কর্তৃত্ববাদ প্রতিষ্ঠার ঝোঁকের কারণে।

বর্তমান ছাত্রলীগ যে লাগামছাড়া অন্যায়-অনাচার করছে এবং রাজনৈতিক যোগসূত্রের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যে নির্বিকার বা প্রশ্রয়দাতার ভূমিকা নিয়েছে, তা অস্বীকারের কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং, সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য আর না বাড়িয়ে বরং ছাত্ররাজনীতির ধারায় আমূল পরিবর্তন কীভাবে আনা যায়, সেদিকেই সবার নজর দেওয়া প্রয়োজন।

২০১৬ সালে এস এম হলে গেস্টরুম নির্যাতনের শিকার ফরিদপুরের হাফিজুর মোল্লার মৃত্যুর পর আশা করা হয়েছিল, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর কর্তৃপক্ষ সাবধান হবে, এগুলো বন্ধে কঠোর হবে। কিন্তু তা হয়নি। গত ফেব্রুয়ারিতে এক সমীক্ষায় দেখানো হয়, মহামারিজনিত দীর্ঘ বন্ধের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রথম পাঁচ মাসে হলগুলোয় ১৮ শিক্ষার্থী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষার্থীদের মানবাধিকারবিষয়ক প্ল্যাটফর্ম ‘স্টুডেন্টস অ্যাগেইনস্ট টর্চার (এসএটি)’ তাদের প্রতিবেদন প্রকাশ করে জানায়, ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরাই এসব নির্যাতনে জড়িত। ক্ষমতার সঙ্গে অন্যায় ও অনিয়মের এই যে যোগসূত্র, তা আর ছিন্ন হয়নি। গেস্টরুম, র‍্যাগিং, ভর্তি ও সিট–বাণিজ্য—কোনোটিই বন্ধ হয়নি, বরং বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় যাঁরা চালান, তাঁরা হয় নির্বিকার, নয়তো ক্ষমতাসীন দলের কাছে আত্মসমর্পণ করে বসে আছেন।

ছাত্রলীগ যেন পত্রিকার শিরোনামে স্থায়ীভাবে জায়গা করে নিয়েছে। পত্রিকার পাতা খুললেই কোনো না কোনো বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে তাদের এমন কৃতিত্বের কথা পড়তে হচ্ছে, যাতে দেখা যাচ্ছে, কারও মৃত্যু হয়েছে, নয়তো হাসপাতাল ঘুরে আসতে হয়েছে কিংবা হল থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হয়েছে।

বেশি দিনের পত্রিকা দেখার প্রয়োজন হবে না, গত দুই সপ্তাহের পত্রিকা দেখলেই এ রকম সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতার বিচিত্র খবর পাওয়া যাবে। শুধু ঢাকায় নয়, রাজশাহী, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, বরিশাল, খুলনা—নানা প্রান্তেই এসব ঘটছে। ছাত্রীরাও পিছিয়ে নেই। ইডেন কলেজের এক নেত্রীর রেকর্ডকৃত অডিওতে যে ধরনের ভাষা শোনা গেছে, তার সবটা মুদ্রণযোগ্য নয়।

এসব ঘটনার একটিতেও প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিরা কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে শোনা যায়নি। উপরন্তু দু-একটি ক্ষেত্রে ছাত্রলীগের কথায় বিশ্ববিদ্যালয়ের হলের প্রাধ্যক্ষ, প্রক্টরিয়াল কাজে নিয়োজিত শিক্ষক নিরীহ শিক্ষার্থীকে পুলিশের কাছে তুলে দিয়েছেন বলে খবর বেরিয়েছে। শিক্ষক অভিযোগ করেছেন, ওই শিক্ষার্থী সরকারবিরোধী অপপ্রচারে লিপ্ত কিংবা শিবির করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারের বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করা যাবে না—এমন মনোভাব কোনো শিক্ষক পোষণ করেন, তা ভাবাই যায় না। জানি না ওই সব শিক্ষক চীন বা উত্তর কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা পেয়েছেন কি না। সরকারবিরোধী প্রচারের ওপর নজরদারি ও পুলিশি দায়িত্ব ওই সব ছাত্র-শিক্ষক কীভাবে করায়ত্ত করেছেন, তার জবাব পাওয়া প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ওই শিক্ষক দলীয় রাজনীতিতে জড়িত অথবা অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চতর পদ বা সরকারের কোনো কমিশন বা প্রতিষ্ঠানে বেশি সুযোগ-সুবিধার নিয়োগ পেতে অতি উৎসাহী হয়ে দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে কাজ করছেন।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এত দিন এসব বিপদ থেকে মুক্ত ছিল বলেই তা সংরক্ষণে তারা সচেষ্ট। বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেনকে উদ্ধৃত করে পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে, যেখানে তিনি বলেছেন, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তাদের নিজ নিজ ট্রাস্টিদের টাকায় প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। সরকার সেখানে এক টাকাও দেয় না। সংগত কারণেই এসব প্রতিষ্ঠানে তাঁদের (ট্রাস্টিদের) মতামতই প্রাধান্য পাওয়া উচিত।

ট্রাস্টিদের চাওয়া হলো, তাঁদের ক্যাম্পাসগুলো হবে রাজনীতিমুক্ত। স্পষ্টতই তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবসা হিসেবে দেখছেন এবং ব্যবসার যাতে কোনো ক্ষতি না হয়, সেই স্বার্থ রক্ষার কথাই তাঁরা বলেছেন। দেশের সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়, বিশেষ করে উচ্চশিক্ষার পরিবেশ যে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, তা নিয়ে তাঁদের কোনো মাথাব্যথা নেই। এ অবস্থান যে শিক্ষায় বৈষম্য তৈরি করছে, সেটা তাঁদের না বোঝার কথা নয়। তবু তাঁরা বলবেন না যে ছাত্ররাজনীতির সংস্কার করা হোক, তাহলে কোথাও তা বন্ধ করার প্রশ্ন উঠবে না।

আরও পড়ুন

সংবাদমাধ্যমে এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনির একটি বক্তব্য ছাপা হয়েছে। সরকার এ ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ করবে না জানিয়ে তিনি বলেছেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি চালু নাকি নিষিদ্ধ করা হবে, এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষার্থীরা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। তিনি আরও বলেছেন, ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করলে এর ফল খুব ভালো হয় না; তাঁর এমন মন্তব্যের সঙ্গে দ্বিমত করার কিছু নেই।

কিন্তু তাঁর দলের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন ছাত্রলীগ যে নজিরবিহীন নৈরাজ্য তৈরি করেছে, তার দায়িত্ব কে নেবে এবং তা থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়ও তো তাঁকে বলতে হবে। তিনি নিজে ছাত্রজীবনে ছাত্রলীগ করেছেন, তাঁর দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একসময় ছাত্রলীগের নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের সময়ের ছাত্রলীগের সঙ্গে কি এখনকার ছাত্রলীগের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যাবে?

তখনো ছাত্রনেতাদের দাপট ছিল, কিন্তু গেস্টরুম বলে কিছু ছিল না। ভর্তি ও সিট–বাণিজ্য ছিল না। তাঁরা নিজেরা ঠিকাদারি ও মন্ত্রণালয়ে তদবিরবাজি করেছেন বলে শুনিনি।

আরও পড়ুন

পত্রিকাতেই খবর বেরিয়েছে, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে সংগঠনটির শতাধিক কেন্দ্রীয় নেতার একটি অভিযোগপত্র আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর গ্রহণ করেনি। হতে পারে সংগঠনটির ভেতরেই ভাগ–বাঁটোয়ারার দ্বন্দ্বের পরিণতি হলো এক পক্ষের বিরুদ্ধে আরেক পক্ষের অভিযোগ।

কিন্তু বর্তমান ছাত্রলীগ যে লাগামছাড়া অন্যায়-অনাচার করছে এবং রাজনৈতিক যোগসূত্রের কারণে বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষ যে নির্বিকার বা প্রশ্রয়দাতার ভূমিকা নিয়েছে, তা অস্বীকারের কোনো অবকাশ নেই। সুতরাং, সরকারি–বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য আর না বাড়িয়ে বরং ছাত্ররাজনীতির ধারায় আমূল পরিবর্তন কীভাবে আনা যায়, সেদিকেই সবার নজর দেওয়া প্রয়োজন। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চাইলেই ছাত্রলীগের এসব অনাচার বন্ধ করতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, তারা তা আদৌ চায় কি না।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক