মুঠোফোনে বিজয় কি-বোর্ড চাপিয়ে দেওয়া কি বৈধ

গত সোমবার ঘুম থেকে উঠেই ঢাকা থেকে প্রযুক্তি ও আইন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ একজন বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকের খুদে বার্তা পাই। তাতে তিনি একটি অনলাইন পোর্টালের একটি খবর পাঠিয়ে কিছুটা উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর মূলধারার সংবাদপত্রে খবরটি দেখার জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি।

এক দিন পর মঙ্গলবার প্রথম আলোর অনলাইনে খবরটি পাওয়ার পর নিশ্চিত হই যে খবরটি ঠিক। খবরটি হলো, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) বাংলাদেশে সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতার কথা বলেছে।

কমিশন তার চিঠিতে বলেছে, আমদানি করা ও স্থানীয়ভাবে উৎপাদন করা সব অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোনে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড এপিকে ফাইল ব্যবহারের লক্ষ্যে বিটিআরসির তরঙ্গ বিভাগ থেকে বিনা মূল্যে ফাইলটি দেওয়া হবে। স্মার্টফোনগুলো কমিশন থেকে বাজারজাতকরণের অনুমতি নেওয়ার আগে এপিকে ফাইলটি ইনস্টল করে তা প্রদর্শন করতে হবে। না হলে অনাপত্তি দেওয়া হবে না।

চিঠি দেওয়ার দিন থেকেই নির্দেশনাটি কার্যকর হবে এবং তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিজয় অ্যান্ড্রয়েড এপিকে ফাইলটি সংগ্রহ করতে হবে। পুরো ব্যাপারে একধরনের তাড়া লক্ষণীয়, যা কিছুটা রহস্যময় বলে মনে হয়।

কাগজে-কলমে বিটিআরসি হচ্ছে একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান, কিন্তু কার্যত এবং আইনের ফাঁকফোকরের সুযোগে তা অনেকটাই সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। এখানে সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ তুলে ধরা যায়। দেশের সবচেয়ে বড় মুঠোফোন সেবাদাতা গ্রামীণফোনের নতুন সিম বিক্রির ওপর সাময়িক নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে গত বছরের ৬ নভেম্বর বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যামসুন্দর সিকদার বলেন, ‘সিম বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার কারণ, যেদিন পদ্মা সেতু উদ্বোধন হয়, সেদিন সেখানে নেটওয়ার্ক ভালো ছিল না। প্রধানমন্ত্রী নিজেই সেটা প্রত্যক্ষ করেছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব আমাদের সচিবকে ফোন করে অসন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন।’ তিনি বলেন, ‘এর আগেও প্রচুর অভিযোগ ছিল এবং এখনো আছে। সেবার মান খারাপ। এগুলো বিবেচনায় মন্ত্রী (টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার) গ্রামীণফোনের নতুন সিম বিক্রি বন্ধের জন্য বলেছিলেন।’

অ্যান্ড্রয়েড মুঠোফোনের বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহারের নির্দেশনায় মন্ত্রীর কোনো ভূমিকা আছে কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আনন্দ কম্পিউটারসের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য বলছে, বিজয় বাংলা কি-বোর্ড ও সফটওয়্যার আবিষ্কারের জন্য ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বিভিন্ন পুরস্কার পেয়েছেন। আপাতদৃষ্টে তাই স্বার্থের সংঘাতের (কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট) প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।

মুঠোফোনে আড়ি পাতায় সরকারের তোড়জোড়ের সঙ্গে বিটিআরসির নির্দেশনার যোগসূত্র থাকতে পারে—এমন ধারণা কি তাহলে নাকচ করে দেওয়া যায়? নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, সরকারের ভেতরেও ততই অস্থিরতা বাড়ছে বলে আভাস মিলছে। সে কারণেই কি একাধিক আইনের পরিপন্থী একটি নির্দেশনা জারি করে তা প্রতিপালনে সময় দেওয়া হয়েছে তিন দিন?

পরের প্রশ্নটি বিটিআরসির নির্দেশনার আইনগত বৈধতার। বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইন ২০০১-এর চতুর্থ অধ্যায়ে বিটিআরসির যেসব উদ্দেশ্য নির্ধারণ করা আছে, তাতে অন্তত দুটি জায়গায় (২৯-এর গ ও ছ) স্পষ্ট করে প্রতিযোগিতার ব্যবস্থা করার কথা আছে।

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত বাংলা লেখার সফটওয়্যার ও কি-বোর্ড অন্তত আরও দুটি খুবই জনপ্রিয় ও ব্যবহারবান্ধব। তাদের প্রতি বৈষম্য করে একটি বিশেষ অ্যাপকে একচেটিয়া বাজার দখলের সুযোগ করে দেওয়া স্পষ্টতই কমিশন প্রতিষ্ঠার আইনগত উদ্দেশ্যের পরিপন্থী।

উপরন্তু, এটি দেশে প্রচলিত আরেকটি আইন প্রতিযোগিতা আইন ২০১২-এর লঙ্ঘন। প্রতিযোগিতা আইনের মুখবন্ধেই বলা হচ্ছে, ‘যেহেতু দেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে ব্যবসা-বাণিজ্যে সুস্থ প্রতিযোগিতামূলক পরিবেশ উৎসাহিত করিবার, নিশ্চিত ও বজায় রাখিবার উদ্দেশ্যে ষড়যন্ত্রমূলক যোগসাজশ (Collusion), মনোপলি (Monopoly) ও ওলিগপলি (Oligopoly) অবস্থা, জোটবদ্ধতা অথবা কর্তৃত্বময় অবস্থানের অপব্যবহার–সংক্রান্ত প্রতিযোগিতাবিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ বা নির্মূলের লক্ষ্যে আইন প্রণয়ন করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়’—সে কারণেই সরকার আইনটি করেছে। আর আইনটি শুধু পণ্য নয়, সব ধরনের সেবার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যুক্তি দেওয়া হতে পারে গ্রাহক এটি বিনা খরচে পাচ্ছেন। এ রকম যুক্তিতে প্রশ্ন উঠবে এ জন্য সরকারের কাছ থেকে প্রতিষ্ঠানটি কোনো অর্থ বা সুবিধা নিচ্ছে কি না? বিষয়টি তো উদ্দেশ্যবিহীন হতে পারে না।

শুরুতে যে বিশ্ববিদ্যালয়শিক্ষকের (সংগত কারণেই নাম প্রকাশ করছি না) খুদে বার্তার কথা বলেছি, তিনি তাঁর বার্তায় যে উদ্বেগের কথা বলেছেন, তা হলো, বিজয় কি-বোর্ড ওপেন সোর্স প্রোডাক্ট না হওয়ায় তার উদ্দেশ্য কিংবা সম্ভাব্য অপব্যবহারের অভিযোগ যাচাই করা সম্ভব হবে না।

তাঁর ব্যাখ্যা হচ্ছে কি-বোর্ডের অ্যাপ হচ্ছে মুঠোফোনের সবচেয়ে স্পর্শকাতর অ্যাপ। কেননা, আমরা মুঠোফোনের সব কাজই কি-বোর্ডের সাহায্যে (কমান্ড) ব্যবহার করি। কি-বোর্ডের কমান্ড দূর থেকে অনুসরণ করা খুবই সম্ভব এবং তার মাধ্যমে ব্যবহারকারীর পাসওয়ার্ড থেকে শুরু করে তার সব কাজই অনুসরণ করা সম্ভব। ওপেন সোর্স কি-বোর্ডে এ রকম কিছু হলে তা যাচাই করা সম্ভব এবং ঝুঁকি অনেক কম।

একই আশঙ্কার কথা উল্লেখ করে ইউরোপে মুঠোফোন সেবাশিল্পে কর্মরত টেকসই উন্নয়নবিষয়ক লেখক ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলছেন, এই কি-বোর্ডের সবচেয়ে বড় ঝুঁকি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা হরণের বিপদ। ইন্টারনেট নিরাপত্তা ও ভিপিএন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ কে জি অরফানেডস ট্রাস্টেড রিভিউতে লিখেছেন, স্মার্টফোনের কি-বোর্ড যে আমাদের ডিজিটাল প্রাইভেসি বা ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর প্রভাব ফেলতে পারে, তা আমরা সাধারণত ভাবি না।

কিন্তু বাস্তবে সেটাই ঘটে। মেশিন লার্নিংয়ের ক্ষমতার সুবাদে অনেক স্মার্টফোনের কি-বোর্ড অ্যাপ আপনি কী টাইপ করছেন, তা অ্যাপ নির্মাতা কোম্পানির কাছে পাঠিয়ে দেয়। গুগল ও মাইক্রোসফটের কাছে এভাবে তথ্য যায় এবং তা নিয়ে খুব একটা হইচই হয় না, কেননা সেগুলো সুরক্ষিত থাকে। তবে মাইক্রোসফটের মালিকানাধীন সুইফটকির কি-বোর্ড থেকে বহু গ্রাহকের ই-মেইল ঠিকানা ফাঁস হওয়ার ঘটনা ঘটেছিল জানিয়ে অরফানেডস লিখেছেন, ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিগত তথ্য কি-বোর্ডের দুর্বলতার সুযোগে দুর্বৃত্ত বা শত্রুভাবাপন্ন সরকার হাতিয়ে নিতে পারে।

আরও পড়ুন

টেলিযোগাযোগ আইনে বিটিআরসির দায়িত্বগুলোর যে বিবরণ ৩০ অনুচ্ছেদে আছে, তার মধ্যে ১(চ) বলছে, ‘টেলিযোগাযোগে একান্ততা (প্রাইভেসি) রক্ষার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা’। বিজয় কি-বোর্ড ব্যবহারের বাধ্যবাধকতা আরোপ কীভাবে ওই দায়িত্বের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ হয়, তা কি কমিশন ব্যাখ্যা করবে?

কদিন আগে জাতীয় সংসদে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম মনিটরিংয়ের (নজরদারি) মাধ্যমে দেশ ও সরকারবিরোধী বিভিন্ন কার্যক্রম বন্ধে এনটিএমসিতে (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) ওপেন সোর্স ইন্টেলিজেন্স টেকনোলজির (ওএসআইএনটি) মতো আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজিত হয়েছে।

একই সঙ্গে একটি ইন্টিগ্রেটেড ল’ফুল ইন্টারসেপশন সিস্টেম (আইনসম্মতভাবে মুঠোফোন ও ইন্টারনেট মাধ্যমে যোগাযোগে আড়ি পাতার ব্যবস্থা) চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।’

আরও পড়ুন

মুঠোফোনে আড়ি পাতায় সরকারের তোড়জোড়ের সঙ্গে বিটিআরসির নির্দেশনার যোগসূত্র থাকতে পারে—এমন ধারণা কি তাহলে নাকচ করে দেওয়া যায়? নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে, সরকারের ভেতরেও ততই অস্থিরতা বাড়ছে বলে আভাস মিলছে। সে কারণেই কি একাধিক আইনের পরিপন্থী একটি নির্দেশনা জারি করে তা প্রতিপালনে সময় দেওয়া হয়েছে তিন দিন?

এখানে আরেকটি কথা না বললেই নয়। এই নির্দেশনার পর কেউ যদি তার মুঠোফোন থেকে বিজয় অ্যাপ ফেলে দিয়ে ‘রিদমিক’ বা ‘জাতীয়’ কি-বোর্ড ইনস্টল করে ব্যবহার করে, তাহলে কি তার বিরুদ্ধে মামলা হবে? বিচার হবে?

বিরোধী দল বিএনপির গণসমাবেশের আগে পুলিশ এবং ছাত্রলীগকে মুঠোফোন তল্লাশি করতে দেখা গেছে। এখন সেটা ঘরে ঘরে গিয়ে করা হবে? গ্রাহকের পছন্দের অধিকার এভাবে হুকুম জারি করে হরণ করা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। আশা করি, সরকারের বোধোদয় হবে এবং এ রকম বেআইনি আদেশ বিটিআরসি প্রত্যাহার করবে।

  • কামাল আহমেদ সাংবাদিক