‘নো মোবাইল ফোবিয়া’ শব্দবন্ধের সংক্ষিপ্ত রূপ ‘নোমোফোবিয়া’। অর্থাৎ মোবাইল ফোনের অনুপস্থিতিতে মানুষের যখন মানসিক অস্থিরতা, ভয় বা উদ্বেগ তৈরি করে, তখনই সেটিকে ‘ফোবিয়া’ বলা হয়।
আর ফোন হারিয়ে গেলে বা ফোনের চার্জ শেষ হয়ে গেলে বা যেকোনো কারণে মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারলে যদি অনেক বেশি অস্থিরতা ও মানসিক চাপ তৈরি হয়, তাকে নোমোফোবিয়া বলা হয়।
সম্প্রতি যশোরের স্বনামধন্য পাঁচটি স্কুল ও কলেজের প্রায় ১০০ শিক্ষার্থীর ওপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে, নোমোফোবিয়ার মতো মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত অর্ধেকের বেশি নবম, দশম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী।
এর মধ্যে একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে সমস্যাটি সবচেয়ে প্রকট। গবেষণায় নবম-দশম ও একাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীদের মধ্যে মৃদু নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ, মাঝারি নোমোফোবিয়ায় ৫৩ দশমিক ২ শতাংশ ও গুরুতর নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত শিক্ষার্থীর হার ২৮ দশমিক ১।
গবেষণায় একটি ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে, শিক্ষার্থীরা নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার পেছনে দায়ী ৪৩ দশমিক ৪ শতাংশ মা-বাবা, ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ বন্ধুবান্ধব, ১১ দশমিক ৩ শতাংশ সামাজিক ও পরিবেশগত কারণ।
এ সমীক্ষায় আরও দেখা যায়, নিঃসঙ্গতা ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ, অনলাইন ক্লাস ৩৮ দশমিক ৫ শতাংশ, আত্মবিশ্বাসহীনতা ২১ দশমিক ৬ শতাংশ ও ২৮ দশমিক ১ শতাংশ মা-বাবার বিচ্ছেদের কারণে মোবাইল ফোন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে এবং পরবর্তী সময়ে নোমোফোবিয়ায় আক্রান্ত হয়।
২০১৯ সালে ব্রিটেনের ২ হাজার ১৬৩ জন মোবাইল ব্যবহারকারীর ওপর পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, প্রায় ৫৩ শতাংশ ব্যবহারকারীর মোবাইল ফোন হারালে, ব্যাটারি বা ব্যালান্স শেষ হয়ে গেলে বা নেটওয়ার্ক না থাকলে অস্থির হয়ে পড়ে।
গবেষণায় দেখা যায়, প্রায় ৫৮ শতাংশ পুরুষ ও ৪৭ শতাংশ নারীর ফোবিয়া ছিল এবং ৯ শতাংশ তাদের মোবাইল ফোন বন্ধ থাকলে অতিরিক্ত চাপ অনুভব করে।
৫৫ শতাংশ ব্যবহারকারী জানিয়েছে, তারা বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখার জন্য মোবাইল ফোন ব্যবহার করতে না পারায় উদ্বিগ্ন থাকে।
জার্মানির সংবাদমাধ্যম ডয়চে ভেলের নোমোফোবিয়া–সংক্রান্ত এক জরিপে প্রায় ৮০০ জন অংশগ্রহণ করে। অংশগ্রহণকারীদের প্রায় অর্ধেকই নোমোফোবিয়াতে ভুগছে। এ থেকে উদ্বেগ ও বিষণ্নতার মতো রোগের সৃষ্টি হতে পারে।
দক্ষিণ কোরিয়ার রেডিওলজির অধ্যাপক ইয়ং সুক হই এক গবেষণায় অভিমত দিয়েছেন, যেসব কিশোর-কিশোরী স্মার্টফোনে বেশি সময় কাটায়, তাদের মস্তিষ্কে রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটার ফলে এ বিষয়ে আসক্তি রয়েছে বলে বাহ্যিক প্রতীয়মান হয়।
এতে তাদের মধ্যে হতাশা ও উদ্বেগ কাজ করে। এ ছাড়া মুঠোফোন সব সময় ঠিক জায়গায় আছে কি না, তা নিয়ে মন সব সময় সতর্ক থাকে। মোবাইল হারানো বা চুরির ভয় থেকে মনের মধ্যে একধরনের সমস্যা তৈরি হয়।
বিশেষত মার্কেটে কিংবা বাইরে গেলে প্রায়ই আমরা পকেটে কিংবা ব্যাগে হাত দিয়ে দেখতে থাকি যে মোবাইল ফোনটা যথাস্থানে আছে কি না।
মোবাইল ব্যবহার অপরিহার্য হলেও এর অপব্যবহারে রয়েছে শারীরিক, মানসিক, সামাজিক সমস্যাসহ নানাবিধ সমস্যা।
এতে উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হয়, উদ্বেগ সৃষ্টি করে, ঘাড় ও মেরুদণ্ডে ব্যথা করে, চোখের সমস্যা হয়, আঙুল ও কবজিতে চাপ ব্যথা অনুভূত হয় এবং উৎপাদনশীলতা কমে যায়। মানসিক সমস্যা যেমন মনোযোগের অভাব, বিভ্রান্তি ও হতাশার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে।
সামাজিক আচরণে পরিবর্তন ঘটে। অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা কমে যায় এবং সম্পর্কের অবনতি হতে পারে। ঘুমের ব্যাঘাত যেমন অতিরিক্ত মোবাইল ব্যবহারের ফলে ঘুমের সমস্যা হতে পারে। সময় অপচয় করা ইত্যাদি।
একটু সচেতনতা, একটু ত্যাগ, একটু মেনে নেওয়ার মাধ্যমে আমরা অনেক জটিল সমস্যার সমাধান করতে পারি। এটিও তার ব্যতিক্রম নয়। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে কয়েকটি কাজ করতে হবে—
১. দিনের নির্দিষ্ট একটি সময় মোবাইল থেকে দূরে থাকতে হবে।
২. ঘুমানোর সময় মোবাইল বিছানায় রাখা যাবে না। সম্ভব হলে বন্ধ কিংবা সাইলেন্ট করে রাখতে হবে। ঘুমের ক্ষেত্রেও একটি নির্দিষ্ট সময় মেনে চলতে হবে।
৩. কার সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে, কোন কাজ করতে গেলে সময় কেটে যায়—এই মানুষ এবং কাজগুলোকে চিহ্নিত করে, সে ব্যাপারগুলো নিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে হবে।
৪. বাসায় কিছুক্ষণের জন্য ফোন রেখে বাইরে বের হওয়ার অভ্যাস করতে হবে।
৫. মোবাইলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম যতটা সম্ভব কম ব্যবহার করতে হবে। ল্যাপটপ কিংবা ডেস্কটপের মতো মাধ্যমগুলো ব্যবহারের চেষ্টা করতে হবে। এতে সমস্যা একটু হলেও দূর হবে।
৬. দীর্ঘক্ষণ মোবাইল ব্যবহারের পরিবর্তে দৈনিক কিছু বই পড়ার অভ্যাস করতে হবে।
৭. বন্ধু, আত্মীয়স্বজন বা প্রিয়জনের সঙ্গে ফোনে কথা বলা কমিয়ে দিয়ে মুখোমুখি দেখা করার সুবিধাজনক নিয়ম তৈরি করতে হবে।
অফলাইনে সামাজিক যোগাযোগ রাখার যে অভ্যাস করোনাকালে আমাদের চলে গিয়েছিল, সেটিকে আবার সজীব করতে হবে।
নোমোফোবিয়া আধুনিক যুগের একটি মরণব্যাধি। এটি মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে। মোবাইল ব্যবহারে সচেতনতা, আত্মনিয়ন্ত্রণ ও বিকল্প ইতিবাচক ব্যবহারই পারে মানবসভ্যতাকে রক্ষা করতে।
ড. এস এম তাজউদ্দিন সহযোগী অধ্যাপক (ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ), ক্যান্টনমেন্ট কলেজ, যশোর।