বিএনপি ও ছাত্রনেতাদের তর্ক–বিতর্কে কার লাভ

দেশের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে এক নির্দলীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক বললেন, জুলাই–আগস্টের গণ–অভ্যুত্থানের পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছিল, তার প্রতি সর্বস্তরের মানুষের বিপুল সমর্থন ছিল। কিন্তু মাত্র সাড়ে পাঁচ মাসে সেই জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়েছে এবং জনমনে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে।

৫ আগস্টের আগে আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা ও রাজনৈতিক দলের অভিন্ন প্রতিপক্ষ ছিল স্বৈরাচারী সরকার।  ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সেই সরকার বিদায় নেওয়ার পর জনগণের প্রত্যাশা ছিল, আন্দোলনকারী সব পক্ষের সমর্থন ও সহযোগিতা নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার দক্ষতার সঙ্গে দেশ পরিচালনা করবে। অন্তত তারা জনগণের মৌলিক সমস্যাগুলো সমাধানে ব্রতী হবে, কিন্তু বাস্তবে তেমনটি কমই ঘটছে।

হালে নির্বাচন নিয়ে বিএনপির নেতৃত্ব ও একাধিক উপদেষ্টা–ছাত্রনেতার মধ্যে যে বাহাস চলছে, তার পেছনেও সরকারের প্রতি সংশ্লিষ্ট পক্ষের অনাস্থা কাজ করেছে। সরকার যদি ঠিকঠাকমতো দেশ চালাতে পারত, জনগণের মধ্যে স্বস্তি ফিরে আসত, নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এত তাড়াহুড়া করত না। একের পর এক সিদ্ধান্ত থেকে পিছু হটায় অনেকেই সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারছে না, আবার অনেকে ভাবছেন, একটু চাপ দিলেই দাবি আদায় হয়ে যাবে।

অর্থবছরের মাঝামাঝি সময়ে শতাধিক পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানোয় ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন মহল থেকে প্রতিবাদ জানানো হলে একাধিক নীতিনির্ধারক বললেন, বাজারে এর তেমন প্রভাব পড়বে না। এরপর যখন সত্যি সত্যি প্রভাব পড়ল, সরকার কিছু পণ্যের ওপর থেকে বর্ধিত ভ্যাট তুলে নিতে বাধ্য হলো। সরকারি কর্মচারীদের মহার্ঘ ভাতার ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছে। সমকাল–এর খবর অনুযায়ী মহার্ঘ ভাতা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছে সরকার। আগামী অর্থবছরের বাজেটে যুক্ত হতে পারে। শুক্রবার আজকের কাগজ–এর খবর: কড়া বার্তা দিয়ে সরল কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ৯০ দিন পার হলে খেলাপি ঘোষণার সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে জুলাইয়ে। এপ্রিলে এটি চালু হওয়ার কথা ছিল।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর অন্তর্বর্তী সরকার নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে না পারলে নির্বাচনের জন্য আরেকটি সরকার লাগবে বলে যে মন্তব্য করেছেন, তা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড়। জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করবে, খুবই ভালো কথা। কিন্তু সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে তাঁরা নির্বাচনে অংশ নিতে চাইলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো বিষয়টি মেনে নেবে না বলেও জানান বিএনপি মহাসচিব।

এই বক্তব্যের পর তথ্য উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুকে বলেছেন, বিএনপির মহাসচিবের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত অরেকটি এক–এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে। বিএনপি কয়েক দিন আগে ‘মাইনাস টুর’ আলোচনা করলেও এখন ক্ষমতায় যাওয়ার পথ সুগম করার জন্য নিরপেক্ষ সরকারের নামে আরেকটি এক-এগারো সরকারের প্রস্তাব করছে।
এক এগারো সরকারের প্রধান লক্ষ্যবস্তু ছিল বিএনপি। সে ক্ষেত্রে তারা আরেকটি ১/১১কে সাদরে ডেকে আনবে, এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। বরং তাদের পক্ষ থেকে এ ধরনের অভিযোগ করা হয় যে বিভিন্ন পক্ষ রাষ্ট্রক্ষমতা ব্যবহার করে তাদেরই ক্ষমতার বাইরে রাখার চেষ্টা চালাচ্ছে।

ছাত্র ও অভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে মাইনাস করার পরিকল্পনা ৫ আগস্ট থেকেই শুরু হয়েছে জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেছেন, ‘আমরা ৩ আগস্ট থেকে বলে আসছি, আমরা কোনো প্রকারের সেনাশাসন বা জরুরি অবস্থা মেনে নেব না। আমাদের বারবার ক্যান্টনমেন্টে যেতে বলা হলেও আমরা যেতে অস্বীকার করি। শেষ পর্যন্ত বঙ্গভবনে আলোচনা ও বার্গেনিংয়ের (দর-কষাকষি) মাধ্যমে অধ্যাপক ইউনূসকে প্রধান করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।’

বিএনপি মহাসচির বক্তব্যের জবাব দিয়েছেন উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ, জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সমন্বয়ক সারজিস আলম ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের আহ্বায়ক হাসনাত আবদুল্লাহও।

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের দুটি লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও গণতন্ত্রে উত্তরণ। প্রথমটি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। এ বিষয়ে ডান বাম মধ্য সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। গণতন্ত্রে উত্তরণেই নানা সমস্যা ও জটিলতা দেখা দিয়েছে। ছাত্রনেতারা কোনো প্রস্তাব দিলে বিএনপির নেতৃত্ব এর বিরোধিতা করছেন। আবার বিএনপির প্রস্তাবও সুনজরে দেখছেন না ছাত্রনেতারা।

আসিফ মাহমুদ লিখেছেন, ‘উপদেষ্টাদের কেউ নির্বাচন করলে সরকার থেকে বের হয়েই করবে।’ সেই সঙ্গে তিনি সরকারের কাজে রাজনৈতিক দলের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত বলেও মন্তব্য করেছেন। স্বাভাবিক প্রশ্ন আসবে, কারা হস্তক্ষেপ করছেন? সরকারই বা সেটা মানছে কেন? তাহলে সরকারের ভেতরে কি কোনো অদৃশ্য সরকার আছে?

ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানের দুটি লক্ষ্য ছিল শেখ হাসিনা সরকারের পতন ও গণতন্ত্রে উত্তরণ। প্রথমটি নিয়ে কোনো সমস্যা হয়নি। এ বিষয়ে ডান বাম মধ্য সবাই ঐক্যবদ্ধ ছিলেন। গণতন্ত্রে উত্তরণেই নানা সমস্যা ও জটিলতা দেখা দিয়েছে। ছাত্রনেতারা কোনো প্রস্তাব দিলে বিএনপির নেতৃত্ব এর বিরোধিতা করছেন। আবার বিএনপির প্রস্তাবও সুনজরে দেখছেন না ছাত্রনেতারা।

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন না করার জন্যই বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দল এক দশক (২০১৪–২০২৪) ধরে আন্দোলন করেছে। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের কেউ রাজনৈতিক দল করতে আগ্রহী হলে বিএনপির মহাসচিব প্রশ্ন তো করতে পারেনই। এটাকে ভিন্ন চোখে দেখার সুযোগ নেই। সরকারের উচিত, তাদের অবস্থান পরিষ্কার করা। অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে একটি অধ্যাদেশ জারি করার ক্ষেত্রে নীতিগত সিদ্ধান্ত  হয়েছিল যে এই সরকারের কেউ পরবর্তী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না এবং তাঁরা একটি অবাধ ও সুষ্ঠ নির্বাচন করে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। কিন্তু সেই অধ্যাদেশ শেষ পর্যন্ত জারি না হওয়ায় অনেকের মধ্যেই সংশয় দেখা দিয়েছে।

আরও পড়ুন

বিএনপির মহাসচিবের আশঙ্কার জবাবে উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন, তার মধ্য দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কের অবসান হতে পারত। কিন্তু সেই সঙ্গে তিনি ও তাঁর সহযোগী ছাত্রনেতারা যেই মন্তব্য করেছেন, সেটা উদ্বিগ্ন হওয়ার মতো। তিনি সরকারি কাজে রাজনৈতিক দলগুলোর হস্তক্ষেপের কথা বলেছেন। নাহিদ ইসলাম সরকারে সব পক্ষের অংশীদারত্ব রয়েছে ও সব পক্ষ নানা সুবিধা ভোগ করছে বলেও মন্তব্য করেছেন।

এখানে সব পক্ষ মানে কি বিএনপি, জামায়াত ও ছাত্রনেতারা? এই আন্দোলনের একটা বড় অংশ ছিল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। তাঁরা সরকারের কাছ থেকে বিজয়ের হিস্যা দাবি করেননি।  এমনকি আন্দোলনের শহীদ ও আহতদের তালিকাটাও সরকার চূড়ান্ত করতে পারেনি।

গণতান্ত্রিক সমাজে নিজের মত প্রকাশ করার ও দল করার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের আছে। কিন্তু সেই দলের সঙ্গে রাষ্ট্র বা প্রশানযন্ত্রের কোনো রূপ–সংশ্লিষ্টতা আছে  কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে।  ছাত্রনেতারা মনে করেন, পুরোনো রাজনীতি জনগণের আশা–আকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে পারছে না। তাই নতুন দলের উদ্যোগ নিয়েছেন তারা। এটা নিয়ে বিএনপি বা অন্য কোনো পুরোনো দলেরও উদ্বিগ্ন হওয়ার কারণ নেই। সবাই নিজ নিজ কর্মসূচি নিয়ে জনগণের কাছে যাবেন। জনগণই ঠিক করবেন কে নির্বাচিত হবেন বা কে সরকার গঠন করবেন।

  • সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি